হরিয়ানার কারনালের হিন্দু শরণার্থী পরিবারের মেয়ে কল্পনা চাওলা। কখনও কোনও বাধার মুখে হার মানে নি জেদি মেয়েটা। ছোট্ট করে সেই গল্পই শোনালেনউত্তম দেব-
অনন্ত, অসীম মহাকাশ যেন হাতছানি দিয়ে মানুষকে ডাকে। রাতের মহাকাশ আমাদের বিস্মিত করে। রহস্যময় সেই অসীম মহাজগত দেখে আমাদের বড় ভাল লাগে। আবার একটু শিহরণও জাগে। মন তো মুহূর্তেই মহাশূন্যে পৌঁছে যায়। কিন্তু পৃথিবীর অভিকর্ষ বল কাটিয়ে দেহকে মহাকাশে নিয়ে যেতে পারেন কেবল নভশ্চরেরাই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যেন মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার জন্যই পৃথিবীর মাটিতে জন্ম নেন। তেমনই একজনের নাম কল্পনা চাওলা। কল্পনা যখন ছোট্টো, তখন স্বপ্নেও মেয়ে নক্ষত্রলোকে পৌঁছে যেতো। হ্যাঁ মেয়ে হয়েও মহাকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দেখাত স্কুল পড়ুয়া কল্পনা।
মেয়ে আকাশে উড়বে, প্লেন চালাবে, মহাকাশে যাবে! বাবা-মা, পরিবারের সবাই শুনেই চোখ কপালে তুলেছে। কিন্তু কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করে তবেই ছেড়েছিলেন কল্পনা চাওলা। হ্যাঁ! মেয়ে হয়েও এবং ভারতের মেয়ে হয়েও। ১৯৬২ সালের ১৭-ই মার্চ হরিয়ানার কারনালে এক হিন্দু পাঞ্জাবি পরিবারে কল্পনা চাওলার জন্ম। দেশভাগের পর পাকিস্তানের গুরজানওয়ালা ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে সপরিবারে কারনালে আশ্রয় নিয়েছিলেন কল্পনার ঠাকুর্দা। কল্পনা চাওলা নাসার মহাকাশ অভিযানে গিয়েছিলেন একজন আমেরিকান নাগরিক পরিচয়ে। কিন্তু তিনি ভারতের কন্যা। কল্পনা চাওলাই আমেরিকার নাগরিকত্ব পাওয়া প্রথম ভারতীয় অভিবাসী, যিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন। মানুষের মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে কল্পনা চাওলাই প্রথম ভারতীয় নারী নভশ্চর।

মহাকাশযাত্রার প্রতিটা সেকেন্ড ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনও মুহূর্তে সামান্য ভুলেও ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। মহাশূন্যে মহাকাশযানে দুর্ঘটনা মানেই মৃত্যু! মহাকাশে গিয়ে অনেক নভশ্চরই আর পৃথিবীতে ফিরে আসেন নি। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত ২০ জন অভিযাত্রীর দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মহাকাশ থেকে মাটির পৃথিবীতে ফেরেন নি আমাদের কল্পনাও। ২০০৩-এর ১-লা ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টায় টেক্সাসের আকাশে ‘স্পেস শাটল কলম্বিয়া’ জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেলে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার কল্পনা চাওলা সহ সাত মহাকাশচারী নিহত হন। ৪১ পূর্ণ হতে তখনও ৪৫ দিন বাকি কল্পনার। কারনালের ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির ছোটখাটো মেয়েটি মাটি থেকে প্রায় দু’লক্ষ ফুট উঁচুতে হারিয়ে গেল চিরদিনের মতো। নিহত অন্য ছয় নভোচররা হলেন মিশন কমান্ডার রিক হাসব্যান্ড, মিশন পাইলট উইলিয়াম ম্যাককুল, পেলোড কমান্ডার মিশেল অ্যান্ডারসন, পেলোড স্পেশালিস্ট আইলান রামান এবং মিশন স্পেশালিস্ট ডেভিড ব্রাউন ও লরেল ব্লেয়ার ক্লার্ক।
কল্পনা বলতেন শুধু পৃথিবী নয়, গোটা সৌরমন্ডলটাই আমার ঘর। ছোট থেকেই মেধাবী। ক্লাসে স্ট্যান্ড করতেন। কিন্তু জাগতিক কোনও বিষয়ে নয় ছোট্ট কল্পনার মন পড়ে থাকত নক্ষত্রলোকে। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর মেয়ে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার জেদ ধরল। শুনে কল্পনার বাবা বেনারসী লাল চাওলা আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, “একমাত্র ছেলেরাই এই সাবজেক্ট নিয়ে পড়ে তুমি বরং ডাক্তারি বা শিক্ষকতার মধ্যে কোনও একটি বেছে নাও।”
বাবার পরামর্শে কান না দিয়ে মেয়ে শুনল বিবেকের কথা। কার্নালের দয়াল সিং কলেজ থেকে ‘বেসিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে’ ডিগ্রি লাভের পর চন্ডিগড়ের পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ‘অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং’ কোর্সে ভর্তি হন কল্পনা চাওলা। ‘অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং’-য়ের ক্লাসে কল্পনাই একমাত্র মেয়ে। অধ্যাপকেরা পর্যন্ত তাঁকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু বাড়িতে বাবা থেকে কলেজে অধ্যাপক-সহপাঠী- সবার কটাক্ষ, উপেক্ষা অগ্রাহ্য করেই ১৯৮২ সালে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ‘গ্র্যাজুয়েশন’ কমপ্লিট করেন কল্পনা।
দেশে থাকলে মহাকাশ অধরাই থাকবে, বুঝতে পেরে উচ্চতর শিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন কল্পনা। আবারও বাধ সাধলেন পিতৃদেব। কিন্তু বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই আমেরিকার ফ্লাইট ধরলেন কল্পনা। ১৯৮৪ সালে আর্লিংটনের ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস’ থেকে মহাকাশ প্রকৌশলে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ক্যাম্পাসেই জিন-পিয়ের হ্যারিসনের সঙ্গে কল্পনার পরিচয় ও প্রেম। তিরাশিতে বিয়ে। ১৯৮৮-তে ‘কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পিএইচডি। সেই বছরেই নাসার একটি গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ শুরু করে দেন কল্পনা চাওলা। ১৯৯৫ সালে নাসার ‘অ্যাস্ট্রোনট কর্পসে’ যোগদান এবং কল্পনার নভোচর জীবনের শুরু।

১৯৯৭ সালে কলম্বিয়া স্পেস শাটলের STS-87 মিশনের একজন নভশ্চর হিসেবে কল্পনা চাওলাকে বাছাই করে নাসা। সে বছরের ১৯ নভেম্বর আরও পাঁচ নভশ্চরের সঙ্গে কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে কলম্বিয়া স্পেস শাটলে চেপে মহাকাশের উদ্দেশে রওনা দেন কল্পনা। তৈরি হয় নতুন ইতিহাস। ভারতের মাটিতে জন্ম নেওয়া প্রথম যে নারী পৌঁছে গিয়েছিলেন মহাকাশে, তাঁর নামই কল্পনা।
সে যাত্রায় মহাকাশে ১৫ দিন ১৬ ঘন্টা ৩৫ মিনিটের মিশন শেষে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন কল্পনা চাওলা সহ ছয় নভোচর। পৃথিবীকে ২৫২ বার প্রদক্ষিণ করতে মহাশূন্যে ১ কোটি ৫ লক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন তাঁরা। ২০০০ সালের ২৭ জুলাই STS-107 মিশনের ‘ক্রু মেম্বার’ হিসেবেও কল্পনা চাওলাকে মনোনীত করেছিল নাসা। ২০০৩-এর ১৬-ই জানুয়ারি কল্পনা সহ সাত নভশ্চরকে নিয়ে মহাকাশে পাড়ি দেয় স্পেস শাটল কলম্বিয়া। ১৫ দিন ২২ ঘন্টা ২০ মিনিট ৩২ সেকেন্ড কক্ষপথে কাটিয়ে একাধিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা সফলভাবে শেষ করেছিলেন নভশ্চরেরা। মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে মহাকাশযানের পুনরায় প্রবেশের সময়েই ঘটল ভয়াবহ দুর্ঘটনা!

নাসার মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে সবথেকে বড় দুই বিপর্যয়ের একটি স্পেস শাটল কলম্বিয়ার ধ্বংস ও আকাশে সাত নভোচারীর মৃত্যু। পৃথিবীতে ফেরার পথে কেন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল স্পেস শাটল কলম্বিয়া? আসলে ১৬-ই জানুয়ারি STS-107 উৎক্ষেপণের সময়েই বিপর্যয়ের সূত্রপাত। মহাকাশ যানটির বাইরের জ্বালানি ট্যাঙ্ক থেকে তাপ নিরোধক ফোমের একটি টুকরো ভেঙে অরবিটারের বাম ডানায় থাকা তাপ সুরক্ষা যন্ত্রে আঘাত করলে যন্ত্রটি অকেজো হয়ে যায়। মহাকাশযানকে বায়ুমণ্ডলের ভয়ঙ্কর তাপ থেকে রক্ষা করাই এই যন্ত্রের কাজ। ১-লা ফেব্রুয়ারি পৃথিবীতে ফেরার দিন বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সাথে সাথেই কলম্বিয়ার ডানায় আগুন ধরে যায়। এরপরেই ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৬১ কিলোমিটার উঁচুতে বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যায় স্পেস শাটলটি।
আকাশে আগুনের ফুলকি ও কলম্বিয়ার ধ্বংসাবশেষ জ্বলতে জ্বলতে নিচে পড়ার হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন টেক্সাসের অসংখ্য মানুষ। ফ্লোরিডায় কেনেডি স্পেস সেন্টারের নিয়ন্ত্রণকক্ষের কর্মীরা নির্বাক, নিস্পন্দ। অসহায় হয়ে দেখলেন তাঁদের সাত সহকর্মীর চরম পরিণতি। অভিযান শেষে ফিরে এলে যাঁদের অভ্যর্থনা জানানোর কথা, তাঁদের দেহাবশেষ খুঁজতে বের হতে হয়েছিল নাসার অনুসন্ধানকারী দলকে। টেক্সাসের হেমফিল থেকে লুইসিয়ানার মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত কলম্বিয়ার ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়েছিল। ১১-ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে কল্পনা চাওলা সহ কলম্বিয়া স্পেস শাটলের সকল ক্রু সদস্যের দেহাবশেষ উদ্ধার করে ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হয়।
অভিযান শেষে জীবিত না ফিরলে কী করতে হবে ইচ্ছাপত্রে তা জানিয়ে গিয়েছিলেন কল্পনা। তা মেনেই শনাক্তকরণ শেষে কল্পনা চাওলার দেহাবশেষ হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী দাহ করা হয়েছিল এবং জিওন জাতীয় উদ্যানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর ভস্ম। ২০০৪ সালে মঙ্গল গ্রহের গুসেভ ক্র্যাটারের ভেতরে একটি পাহাড়ের সন্ধান পায় নাসার মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার স্পিরিট। কলম্বিয়া স্পেস শাটলের নামে পাহাড়টির নামকরণ হয় ‘কলম্বিয়া হিলস’। কলম্বিয়া হিলসের সাতটি শৃঙ্গের নাম কলম্বিয়া স্পেস শাটলের নিহত সাত নভশ্চরের নামে। লালগ্রহের মাটিতে পাহাড়ের চূড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতের কারনালের মেয়ে কল্পনা। পাহাড়ের মতোই অটল ছিল যাঁর প্রতিজ্ঞা।