চাকরির তো দফারফা, শুধু ভাতা দিয়ে বাঙালির পেট ভরবে?

চাকরির তো দফারফা, শুধু ভাতা দিয়ে বাঙালির পেট ভরবে?


পাছা উপুড় করে গ্রাম গ্রাম থেকে টাকা তুলেছিল শাসকদলের লোকেরা। প্রত্যেকবার নিয়োগের সময় বিষয়টা মহোৎসবে পরিণত হয়েছিল। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বেরোনো মাত্র আনন্দে নেতাদের বিপি হাই হয়ে যেত। ঘাপলা মানে ঘাপলার বাপ! টাকা খাওয়ার নেশায় পাগল হয়ে গিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি কাগজপত্র পর্যন্ত ঠিকঠাক রাখে নি। এই দলটা চরম লোভী আর আকাটমূর্খদের আস্তাবল। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এত ভয়াবহ জালিগিরি যে, রাজ্য সরকারের ঠিক করা দেশের বাঘা বাঘা উকিলেরা পর্যন্ত এজলাসে দাঁড়িয়ে মক্কেলকে ‘ডিফেন্ড’ করতে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছেন। একজনের চাকরি গেলেও শুনতে খারাপ লাগে আর এখানে তো সংখ্যাটা ২৬ হাজার ছুঁই ছুঁই। কিন্তু দোষটা কার? রায়দান কালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন, তাঁদের সামনে ভিন্ন কোনও রাস্তা খোলা ছিল না।
তোলামূল ধরেই নিয়েছিল, কোনও কিছুতেই কিছু হবে না। রাজনৈতিক নেতাদের গায়ে অত্যাশ্চর্য গ্রিজ লাগানো থাকে। তাদের শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অর্পিতার বুড়ো নাগর বাদে সবাই জামিন পেয়ে গেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের  রায় পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটা বিশাল সামাজিক বিপর্যয়। চাকরি হারিয়ে কেউ পাগল হবে। কার‌ও পরিণতি আরও মর্মান্তিক হতে পারে। ইউরোপের কোনও দেশ হলে, জাপান-কোরিয়া হলে প্রশাসনের প্রধান সব দায়িত্ব মাথায় নিয়ে দফতর থেকে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি চলে যেতেন। বাকি জীবনে আর রাজনীতি করতেন না।
২০১৪ কি ২০১৫ সালে তৃণমূলের একজন সাধারণ কর্মী আমাকে বলেছিল, “দাদা প্রাইমারির নিয়োগ নিয়ে বাজার থেকে নির্বিচারে টাকা তোলা হচ্ছে। ভগবান না করুন কিন্তু ভবিষ্যতে রাজ্য জুড়ে একটা বিরাট ঝামেলা বাঁধতে পারে।” আজকে তাঁকে আমার খুব বড় দ্রষ্টাপুরুষ বলে মনে হচ্ছে। এস‌এসসি-র নিয়োগ নিয়ে আজ যে রায় সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে, নিঃসন্দেহে তার সামাজিক অভিঘাত ভয়ঙ্কর!
অনেকেই রায়কে বাড়াবাড়ি, অমানবিক বা ‘ঠগ বাছতে গা উজাড়’ টাইপের বলছেন বটে। কিন্তু রাজ্য সরকার তো দেশের সেরা সেরা আইনজীবীদের বছরভর পোষে। কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির মতো আইনজীবীরা যে সরকারের হয়ে রোজ এজলাসে দাঁড়িয়ে মামলা লড়েন, তাঁরা কী করলেন? মক্কেলের মুখ রক্ষা করার মতো কোনও আর্গুমেন্ট তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে করতে পারলেন না! গত ১৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গে কতবার অ্যাডভোকেট জেনারেল বদল হয়েছে, একবার খোঁজ নিয়ে দেখবেন। হাইকোর্টে মামলার পর মামলায় রাজ্যের হয়ে লড়তে গিয়ে তাঁদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। এবং অনেক দুঁদে আইনজীবীই সেই গুরু দায়িত্ব ত্যাগ করে শেষ পর্যন্ত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
কেন রাজ্যের হয়ে মামলা লড়তে গিয়ে দক্ষ আইনজীবীরাও আদালতে কূল পান না? এই জামানায় প্রাইমারি, এস‌এসসি, সিএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির মাথায় যাদের বসানো হয়েছিল বা এখনও বসে আছেন, তাঁরা শুধু লোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত‌ই নন, কাজে কী পরিমাণ অপদার্থ, অজ্ঞ, অনভিজ্ঞ, তাঁদের সঙ্গে কোনও না কোনও কারণে যাঁরা মুখোমুখি হয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি ভাল জানেন। এদের অনেকেই দাফতরিক কাজে কীভাবে নিখুঁত ‘পেপার ওয়ার্ক’ করতে হয়, তা জানেন না। আইন সম্পর্কে, কোনও কাজের আইনি পরিণতি সম্পর্কে এদের কোন‌ও ধারণাই নেই। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আদালতে আবেগ চলে না। আদালত দেখে ‘ডকুমেন্টস’। আদালতের ভাষায় যাকে বলে ‘তথ্য-প্রমাণাদি’, তা যথাযথভাবে কোর্টের সামনে হাজির না করতে পারলে মামলায় হার নিশ্চিত।
যোগ্য আর অযোগ্যতে না খুনোখুনি বেঁধে যায়। দরকার ছিল নাটের গুরুঠাকুরাইনকে ঘাড়ে ধরে গদী থেকে টেনে নামিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখন দেখতে হচ্ছে, টাকা দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছে আর মেধায় যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি। আযোগ্যদের চাকরি বাঁচাতে পুরো প্যাঁচটা লাগিয়েছেন রাজ্যের অলক্ষ্মী। টাকা খেয়ে আর সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বিচারে যে সব নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে, সেই গাফিলতি ঢাকতে গিয়ে পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়াকে বেআইনি করে ফেলা হয়েছে। এই জন্যই তো আদালতে পদে পদে ধরা খাচ্ছে রাজ্য ও এস‌এসসি।
ইন্ডোরে হোক আর আউটডোরে- হম্বিতম্বি করে লাভ নেই। সুপ্রিম কোর্টের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। সব খুলে বলুন। হাতেপায়ে ধরুন। চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উদ্দেশে এই কথা। পর্ষদ ইতিমধ্যেই রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছে। আপনারাও করুন। ধরিবাজ মহিলা এখনও টাউটারি করে যাচ্ছেন। ওনার উদ্দেশ্য একটাই- পুরো মামলাটিকে জট পাকিয়ে দিয়ে অযোগ্যদের যে কোনও মূল্যে বাঁচানো। সুপ্রিম কোর্টে এক বছর ধরে শুনানি হয়েছে। শুনানি শুরুর পর থেকেই বিচারপতিদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, নিয়োগ দুর্নীতির গভীরতা কত মারাত্মক! নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সব পক্ষ নিজের নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য এমন কিছু তথ্য ধামাচাপা দিয়েছেন ও এখনও দিতে চাচ্ছেন, যাতে কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির মতো দুঁদে আইনজীবীরাও সুপ্রিম কোর্টকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সবদিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা না করে ২৫,৭৫৩ জনের নিয়োগ বাতিল করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত দেশের শীর্ষ আদালত নেয় নি। নিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি আইনের চোখে নেই। থাকতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করে আগের নির্দেশের উপর ‘স্টে অর্ডার’ দিলেই একমাত্র এদের নিয়োগ আগের অবস্থায় ফিরতে পারে। ‘স্টে অর্ডার’ না দিলে মামলা চলা কালেও নিয়োগ বাতিল‌ই থাকবে। ২৫,৭৫৩ জনের চাকরিনাশ নিঃসন্দেহে বিরাট সামাজিক বিপর্যয়। হাইকোর্টের নির্দেশ মতো তালিকা ধরে ধরে অযোগ্যদের চাকরি বাতিল করলে আজ এই দিন দেখতে হত না। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ২৫,৭৫৩ জনের মধ্যে প্রকৃত যোগ্যের সংখ্যা পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি নয়।
ত্রিপুরায় ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ১০,৩২৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল হয়েছিল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে। ২০১০ ও ২০১৩ সালে দুই দফায় এদের সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল। তখন বাম আমল। মানিক সরকার মুখ্যমন্ত্রী। মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেংকারি, হালের নিট, হ্যানো-ত্যানো আরও অনেক ঘটনাই উদাহরণ হিসেবে টানছেন বাংলার শাসকদলের নেতারা কিন্তু ত্রিপুরায় নিয়োগ বাতিলের ঘটনাটি মুখেও আনছে না।
গত ১৪ বছরে সুপ্রিম কোর্ট-হাইকোর্টের বিস্তর রায় রাজ্য সরকারের অনুকূলে গেছে। ‘সুপারনিউমেরারি’ পদ মামলায় যেমন সদ্য‌ই সুপ্রিম কোর্টে বড় স্বস্তি পেল রাজ্য সরকার। সিঙ্গুর জমি অধিগ্রহণ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রীতিমতো আইনের বাইরে গিয়ে রাজ্যের পক্ষে নির্দেশ দিয়েছিল। এস‌এসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় যেহেতু সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের হার হয়েছে, অত‌এব ইহা চক্রান্ত! সুপ্রিম কোর্টে ২৫,৭৫৩ জনের নিয়োগ বাতিল হয়ে যাওয়াটা বাংলার বিরুদ্ধে চক্রান্ত। কিন্তু বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য ত্রিপুরায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ১০,৩২৩ জনের চাকরি যাওয়াটা চক্রান্ত নয়। মাত্র ৮ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু সবজান্তা কুণাল ঘোষের পর্যন্ত স্মরণে নেই! ২০১৮ সালের ভোটে ত্রিপুরায় বামফ্রন্টের হারের পেছনে ১০,৩২৩ জনের নিয়োগ বাতিলের ঘটনা একটা বড় কারণ বলে মনে করা হয়। বাংলার শুধু ২৫,৭৫৩ জনের চাকরিই যায় নি। নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে ভবিষ্যতে আর‌ও বেশি সংখ্যক চাকরি আদালতে খারিজ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা। ওবিসি শংসাপত্র বাতিল মামলা সুপ্রিম কোর্টে ঝুলছে। মামলার জেরে রাজ্য সরকারের দফতরে সমস্ত ধরণের নিয়োগ বন্ধ। কী ভয়াবহ অবস্থা! নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে শুধু ভাতা দিয়ে বাঙালির পেট ভরবে?


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *