করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত ' কাঠগড়ায় ' মোদী সরকার , অতি আত্মবিশ্বাসেই কি পতন বিশ্বগুরুর ? - nagariknewz.com

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত ‘ কাঠগড়ায় ‘ মোদী সরকার , অতি আত্মবিশ্বাসেই কি পতন বিশ্বগুরুর ?


 

                                   অ রু ণ  কু মা র

কোভিড নিয়ে কি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিচ্ছেন মোদী ? নাকি আত্মপ্রচারের ? বিশে করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলার সময় কেন্দ্রীয় সরকারকে যতটা সফল দেখা গেছে একুশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ততটাই নড়বড়ে দেখাচ্ছে সরকারকে । বিশেষজ্ঞরা বলছেন দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে ভারত সরকার । গত অক্টোবর থেকেই ভারত জুড়ে করোনার সংক্রমণ রেখা ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করে । দু’একটি রাজ্য বাদ দিলে শীতে গোটা দেশেই পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে যায় । ৬ জানুয়ারি থেকে টিকাকরণ অভিযান‌ও শুরু করে দেয় সরকার । দেশে ভ্যাকসিনেশন শুরুর পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্র সহ অন্যান্য রাষ্ট্রে ভারতে উৎপাদিত ভ্যাকসিন রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক পরিসরে বেশ সুনাম‌ও কুড়ান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী । এর নাম দেওয়া হয় ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসিভক্তেরা বলতে শুরু করে দেন – মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় । 

যদিও কু গাইছিলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা । বারে বারে সরকারকে করছিলেন সতর্ক‌ও । ভারতের জনজীবন যখন করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে প্রায় স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছিল এবং তাতে মদত ছিল সরকারের‌ও তখন থেকেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন বিশেষজ্ঞরা । যদিও তাতে খুব একটা কর্ণপাত করার সময় পায় নি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকা সরকার । ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ফের সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রমাণ পাচ্ছিলেন চিকিৎসকেরা । যদিও তখন করোনা মোকাবিলায় চেয়ে চার রাজ্যের ভোট বিশেষ করে বাংলা দখল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মোদী । এমন‌ই অভিযোগ সমালোচকদের । কোভিড বিধি উপেক্ষা করে দেদারসে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ শুরু হয়ে গেল । একের পর এক সভায় উপস্থিত থাকলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী‌ও । ভোটের বাজনার আওয়াজে সবাই ভুলেই গেল করোনার কথা । এমনকি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক‌ও । বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ উপেক্ষা করে হরিদ্বারে কুম্ভ মেলার মহা জমায়েতেও ছাড়পত্র দিয়ে দিল প্রশাসন । মার্চ পেরিয়ে এপ্রিলে সরকারের হুঁশ ফিরল বটে কিন্তু ততদিনে হাতের বাইরে পরিস্থিতি ! 

বর্তমানে দেশে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা চার লক্ষ ছাপিয়ে যাচ্ছে । রোজ মারা যাচ্ছেন চার হাজারের বেশি মানুষ । আক্রান্তের সংখ্যায় শতাংশ বৃদ্ধি ! এগুলো সব সরকারি পরিসংখ্যান । প্রকৃত অবস্থা এর চেয়ে অনেক খারাপ বলে বিশেষজ্ঞ মহলের আশঙ্কা । মিউটেশনের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের যে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়্যান্ট তৈরি হয়েছে তার সংক্রমণ হার আগের ভ্যারিয়্যান্ট গুলোর চেয়ে অনেক মারাত্মক বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা । রোগীদের অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে । তাই মৃত্যু হার‌ও বেড়েছে । রোজ অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে । আইসিইউতে জায়গা নেই । করোনা রোগীদের বেড দিতে পারছে না হাসপাতালে গুলো । এমনকি মৃতদের শেষকৃত্য পর্যন্ত ঠিকভাবে করা যাচ্ছে না । এহেন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার । ক্ষমতায় আসার পর থেকে কখনও এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় নি মোদীকে । বিরোধীদের তোপের মুখে তো পড়তেই হচ্ছে এমনকি আদালত‌ও দু’কথা শুনিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারকে ।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে মৃত্যুমিছিল । নিভছে না চিতা স্থানাভাব কবরখানায়  !

সমালোচকেরা বলছেন , অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর আত্মপ্রচারের মোহে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তায় কান দেয় নি সরকার । তাই যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সত্যি সত্যিই দেশে আছড়ে পড়ল তখন প্রস্তুতির ঘাটতি পরিস্থিতিকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেল । এই মুহুর্তে করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের গোটা পরিকল্পনাটাই ভীষণ রকমের এলোমেলো মনে হচ্ছে । আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবাই পরিস্থিতির জন্য মোদী সরকারের দিকেই আঙ্গুল তুলছে । ল্যানসেটের সম্পাদকীয়তে তো রীতিমতো তুলোধুনো করা হয়েছে নরেন্দ্র মোদীকে । যখন সমস্ত রকমের রাজনৈতিক , সামাজিক , ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জনিত জমায়েত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল তখন মোদী নিজেই রাজনৈতিক প্রচারে ব্যস্ত থেকে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে মদত জুগিয়েছেন বলে কটাক্ষ করা হয়েছে ল্যানসেটের সম্পাদকীয়তে । অনিয়ন্ত্রিত ভিড় বা বিশাল জমায়েত যে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সুপার স্প্রেডারের কাজ করে তা প্রমাণিত । বিষয়টি নিয়ে সরকার সময়ে সজাগ হলে পরিস্থিতি এতটা নাও বিগড়োতে পারত বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা । 


করোনা শুধু স্বাস্থ্য বিপর্যয়‌ই নয় দেশের সার্বিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এই বিপর্যয় রোধে বিশে‌ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীকে যতটা সপ্রতিভ বলে মনে হয়েছিল ‌একুশে ততটাই অসহায় বলে মনে হচ্ছে ।


কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে এখন সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ কেন্দ্র ও রাজ্য গুলির মধ্যে সমন্বয় করে কোভিড পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা । অক্সিজেনের ঘাটতি মেটানো । কোভিড হাসপাতাল গুলির শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি । করোনা রোগীদের নিরাময়ে ব্যবহৃত হয় এমন ওষুধের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা । সর্বোপরি দ্রুত সবাইকে টিকার আওতায় আনা । এখন পর্যন্ত কোনও কাজই ঠিকমতো করে উঠতে পারছে না সরকার । টিকাকরণকে করোনা সংক্রমণ রোধের একটি বড় হাতিয়ার বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা । সরকার আঠারোর ঊর্ধ্বে সকলকে টিকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে । অথচ ৪৫ ঊর্ধ্ব নাগরিকদের দ্বিতীয় ডোজের টিকা দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে রাজ্য সরকার গুলিকে । ফলে সরকারের ঘোষণাই সার । দ্বিতীয় ডোজের টিকাকরণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আঠারো ঊর্ধ্ব নাগরিকদের টিকাকরণের কাজ স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে সরকার । যে গতিতে করোনার সংক্রমণ বেড়ে চলছে তাতে‌ রাশ টানতে দেশ জুড়ে পূর্ণাঙ্গ লকডাউন ছাড়া অন্য রাস্তা নেই বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল । রাজ্যে রাজ্যে পূর্ণ বা আংশিক লকডাউন শুরু হয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক কী চাইছে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না । এদিকে দেশের বিভিন্ন হাইকোর্ট কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে ভর্ৎসনা করেছে । চুপ নেই দেশের শীর্ষ আদালত‌ও । কোভিড মোকাবিলায় সরকার থেকে কখন কী করা হবে এই অপেক্ষায় বসে না থেকে বারো সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট । দেশের বারোজন বিশিষ্ট চিকিৎসককে নিয়ে গঠিত এই টাস্কফোর্স‌ই ঠিক করবে সংক্রমণ মোকাবিলায় কোন রাজ্যে কী পরিমাণ ওষুধপত্র , অক্সিজেন , বেড এবং প্রতিষেধক লাগবে । 

যে বিজেপি নেতারা কিছু দিন আগেও বলতেন মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় আজ তাঁদের কন্ঠেই হতাশা আর উৎকণ্ঠার সুর । পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে দলের । উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলেও অশনিসংকেত দেখছেন বিজেপির নেতারা । কোভিডকে ঘিরে জনরোষ যেভাবে বেড়েই চলেছে‌ দ্রুত পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হলে প্যান্ডেমিক মোকাবিলায় ব্যর্থতা‌ই যে চব্বিশের ভোটে মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধী শিবিরের সবথেকে বড় অস্ত্র হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । করোনা শুধু স্বাস্থ্য বিপর্যয়‌ই নয় দেশের সার্বিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এই বিপর্যয় রোধে বিশে‌ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীকে যতটা সপ্রতিভ বলে মনে হয়েছিল ‌একুশে ততটাই অসহায় বলে মনে হচ্ছে ।

Photo Credits – The Siasat Daily , The Gurdian , The Wire / PTI

 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *