পরিষদীয় রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দলের ধার ও ভার কতটা , বুঝতে পারছে কি রাজ্য বিজেপি ? - nagariknewz.com

পরিষদীয় রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দলের ধার ও ভার কতটা , বুঝতে পারছে কি রাজ্য বিজেপি ?


                                 উ ত্ত ম  দে ব 

সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানে শাসকদলের থেকে বিরোধীদলের প্রচারের আলো বেশি শুষে নেওয়ার সুযোগ থাকে । ওয়েস্টমিনিস্টেরিয়াল সিস্টেমের বিশেষত্বটাই এমন । যেই দেশে এই পদ্ধতির জন্ম , সেই ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে বিরোধী দলের ছায়া মন্ত্রিসভা পর্যন্ত থাকে । ভারতের পরিষদীয় ব্যবস্থায় অপজিশন বেঞ্চে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের রেওয়াজ না থাকলেও বিরোধী দলের নেতা ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান মর্যাদা পান। আইনসভার ভেতরে বিরোধীদল সংখ্যার বিচারে শক্তিশালী হলে তো কথাই নেই এমনকি সংখ্যার দিক থেকে কমজোরি বিরোধীদল‌ও শাসকদলকে টেনশনে রাখতে সক্ষম । দেশে সংসদীয় রাজনীতির ৬৯ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় তুখোড় পার্লামেন্টেরিয়ানদের তালিকায় শাসকদলের নেতাদের থেকে বিরোধী দলের নেতাদের সংখ্যাই বেশি লম্বা । লোকসভা , বিধানসভার ভেতরে ট্রেজারি বেঞ্চকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করার ক্ষমতা থাকে বিরোধীদের । জ‌ওহরলাল নেহেরু যতদিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ততদিন সংসদের ভেতরে বিরোধী সদস্যের সংখ্যা কুড়িয়ে বাড়িয়ে সওয়াশ পেরোয় নি । কিন্তু বাহান্ন থেকে বাষোট্টি – প্রথম তিনটি লোকসভায় সামান্য সংখ্যক বিরোধী সদস্যদের মধ্য থেকেই হীরেন মুখোপাধ্যায় , অটলবিহারী বাজপেয়ী , রামমনোহর লোহিয়া , মিনু মাসানি , একে গোপালন , হরিবিষ্ণু কামাথ এবং ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর মতো সাংসদদের দাপটে তটস্থ থাকতে হত প্রধানমন্ত্রীকে । পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর মতো নেতার উত্থান বিধান রায়ের জামানায় বিধানসভার ভেতরে বিরোধী দলের নেতা হিসেবেই ।

জ্যোতি বসু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় – বিরোধী দলে থেকে লড়তে লড়তেই সরকার প্রধান হয়েছেন সবাই ।

পরিষদীয় রাজনীতিতে লোকসভা-বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে বিরোধী রাজনীতির যেমন যথেষ্ট পরিসর থাকে তেমনি বিরোধী রাজনীতি সফল করে তোলার একটা আর্ট‌ও আছে ।৯৫২ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির পরিসর বামপন্থীদের দখলে । এর‌ পনেরো বছর পরেই রাজ্যে ক্ষমতার স্বাদ পায় বামেরা । পরিষদীয় রাজনীতির সূত্রপাত থেকেই বিজেপির পূর্বসূরি জনসংঘ পশ্চিমবঙ্গে নিতান্তই প্রান্তিক শক্তি । ৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল জনতা পার্টি থেকে বেরিয়ে জনসংঘীরা অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি গঠন করে । প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৩৬ বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় কদাচিৎ একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করতে সমর্থ হয়েছে দলটি । ২০৬র বিধানসভা নির্বাচনে প্রথমবারের মতো তিনটি আসন জেতে বিজেপি । উনিশের লোকসভা নির্বাচনে অর্ধেকের থেকে তিনটি আসন কম পেয়েছে বিজেপি । তখন থেকেই বিজেপির নেতারা আওয়াজ তোলেন উনিশে হাফ একুশে সাফ । অর্থাৎ ২০২ এর বিধানসভা নির্বাচনে শাসক তৃণমূলকে সাফ করে দিয়ে একেবারে নবান্ন দখলের হুঙ্কার দিতে থাকে গেরুয়া ব্রিগেডের সেনাপতি থেকে সৈনিক সকলে । মোদী ও অমিত শাহ আদাজল খেয়ে বাংলা দখলে নামলেও শেষ পর্যন্ত নবান্ন থেকে‌ নীলসাদা হাওয়াই চটি পরিহিতাকে উৎখাত করতে ব্যর্থ । বঙ্গ অভিযান ব্যর্থ হ‌ওয়ায় দিল্লির দীনদয়াল মার্গ থেকে কলকাতার হেস্টিংস – বিজেপির রথীমহারথীরা মুষড়ে পড়েছেন ভীষণ । উঁচুতে ওঠা ভাল কিন্তু টাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে নীচে পড়লে আঘাতটাও ততোধিক গুরুতর হয় । পশ্চিমবঙ্গ জয়ের ব্যাপারে বিজেপির প্রত্যাশা দোসরা মে সকাল নটা পর্যন্ত এতটাই গগনচুম্বী ছিল যে বিকেলের পর যখন দেখা গেল ভোটের ফল প্রত্যাশার ধারেকাছেও পৌঁছায় নি তখন পরাজয়ের আঘাত সঙ্গত কারণেই পদ্ম শিবিরের হৃদয়ে মোক্ষম লাগল ।  


সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় শাসকদলের চেয়ে বিরোধী দলের অ্যাডভান্টেজ কোন‌ও অংশে কম নয় । ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস বাদ দিয়ে বাদবাকি রাজনৈতিক দল বিরোধী বেঞ্চ থেকেই ট্রেজারি বেঞ্চে গেছে । সংসদে বিজেপি তিন থেকে ৩০৩ হয়েছে । 


বিজেপির বঙ্গবিজয়ের স্বপ্ন পাঁচ বছরের জন্য আছাড় খেলেও একুশের ফাইনালে রানার্স‌আপ হ‌ওয়ার সুবাদে বিধানসভায় তারাই বিরোধীদল । শুধু প্রধান বিরোধী দল‌ই নয় পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হ‌ওয়ার পর থেকে এই প্রথম রাজ্যের আইনসভায় বাম ও কংগ্রেস খাতা খুলতে ব্যর্থ হ‌ওয়ায় একমাত্র বিরোধী দলের নাম‌ও বিজেপি‌ই । একুশ থেকে ছাব্বিশ পাঁচ বছরের জন্য – ৩৮.৩ শতাংশ ভোট ও ৭৭টি আসন নিয়ে রাজ্য বিধানসভায় একমাত্র বিরোধী দলের দায়িত্ব বিজেপির স্কন্ধে । পশ্চিমবঙ্গের পরিষদীয় রাজনীতিতে নিতান্তই অনভিজ্ঞ বিজেপির জন্য এটা একটা বিশাল প্রাপ্তি । এই সাতাত্তর আসন যদি বিজেপি না পেয়ে বামেরা পেতো তবে ফল প্রকাশের রাতে আলিমুদ্দিনের মোজাফফর আহমদ ভবন লাল আলো দিয়ে সাজানো হত। কারণ সিপিএম নেতারা ভাবতেন , এবার তাহলে সত্যিই আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু । সংসদীয় রাজনীতিতে সাতাত্তরের অর্ধেক আসন পেয়েও ঘুরে দাঁড়ানো যায় । ২০০৬ এর বিধানসভায় মাত্র তিরিশটি আসন পাওয়ার তিন মাসের মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা করেও দেখিয়েছেন । 

সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় শাসকদলের চেয়ে বিরোধী দলের অ্যাডভান্টেজ কোন‌ও অংশে কম নয় । ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস বাদ দিয়ে বাদবাকি রাজনৈতিক দল বিরোধী বেঞ্চ থেকেই ট্রেজারি বেঞ্চে গেছে । সংসদে বিজেপি তিন থেকে ৩০৩ হয়েছে । ৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতের কোনও রাজ্যে সরকার গড়তে পারে নি বিজেপি । সংসদীয় ব্যবস্থায় সফল বিরোধী দল‌ই পরবর্তী কালে সরকারে যেতে পারে । সফল বিরোধী দল হ‌ওয়া রাজনীতির একটি আর্ট ‌। বাংলার বিজেপি বিরোধী রাজনীতিতে সফল হবে কিনা তা সময়‌ই বলবে । কিন্তু সফল হতে গেলে সেই আর্টটা বিজেপিকে জানতে হবে । 

পশ্চিমবঙ্গের পরিষদীয় রাজনীতিতে বিজেপির সত্যিকারের যাত্রা শুরু হল একুশ থেকেই । 

বিজেপির ( জনসংঘকে ধরে ) সবথেকে বড় দুর্বলতা হল দীর্ঘ ৭৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তারা ছিল প্রান্তিক ও গৌণ শক্তি । এই কারণেই বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে সরকার বিরোধী রাজনীতি করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নেই দলটির । বিজেপির বিজয়ী বিধায়কদের মধ্যে অধিকাংশের‌ই পরিষদীয় রাজনীতির কোনও অভিজ্ঞতা নেই । বিরোধী দলকে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয় । সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয় কখন বেকায়দায় পড়ে সরকার । হাতে গরম ইস্যু পাওয়া মাত্রই হাউসের ভেতরে ও বাইরে চেপে ধরতে হয় সরকারকে , শাসকদলকে । গণতন্ত্রে জনগণ সবসময় ডিসেন্ট মুড বা বিক্ষুব্ধ মেজাজে থাকে । এই মেজাজটা সবসময় সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকে । বিরোধী দলের কাজ‌ই হল জনগণের ডিসেন্ট মুডটাকে সর্বদা সার-জল দিয়ে তাজা রাখা । প্রধান বিরোধী দলের নেতার কাজে  পরিশ্রমী , বাক্যে চৌকস , বুদ্ধিতে চতুর তদুপরি ক্যারিশ্মাটিক হ‌ওয়া আবশ্যক । আজকের বিরোধী দলনেতাই কালকের সরকার প্রধান ।

আগামী পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিকে বাংলার বিজেপি , বাঙালির বিজেপি হয়ে উঠতে হবে । নাগপুরের কপিবুক পলিটিক্স যে বাংলায় খুব একটা খাটে না সেই শিক্ষা লাভ  নিশ্চয় দোসরা মের পরের দিন থেকেই হয়ে গেছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের । বিরোধী রাজনীতির বিরাট পরিসরটিকে যোগ্য ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে রাজ্য বিজেপি কতটা ভালভাবে ব্যবহার করতে পারবে তার ওপরেই নির্ভর করবে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভবিষ্যত । বিজেপি কী পারবে , কতটা পারবে তা সময়‌ই বলবে তবে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপি যে সত্যিকারের বিরোধী দল হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।  




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *