ডেস্ক রিপোর্ট: যুদ্ধ বিরতি হয়েছে কিন্তু ‘অপারেশন সিঁদুর’ শেষ হয় নি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হঠাৎ যুদ্ধ বিরতি ঘিরে যখন দেশের মানুষের মধ্যে খানিকটা অসন্তোষ দানা বেঁধেছে, তখন সেনাবাহিনীর তরফেই আশ্বস্ত করা হল, ‘অপারেশন সিঁদুর’ জারি থাকবে। চার দিনের সংঘর্ষের পর শনিবার বিকেল থেকে সংঘর্ষ বিরতিতে যায় ভারত ও পাকিস্তান। এই চার দিনে ভারতের তিন বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানের কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, রবিবার সন্ধ্যায় তার স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরলেন তিন বাহিনীর ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস’। নিজেদের তরফে কী ক্ষতি হয়েছে, তাও জানানো হয়েছে ‘ডিজেএমও’-দের সাংবাদিক সম্মেলনে।
পহেলগাঁও হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গি ঘাঁটিগুলিকে ধ্বংস করাই ছিল ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর আসল লক্ষ্য। কিন্তু জবাবে পাকিস্তান ভারতের সামরিক পরিকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা শুরু করলে পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক পরিকাঠামোতে প্রত্যাঘাত করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় ভারত। সাংবাদিক সম্মেলনে এই কথা জানিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেন ভারতের তিন বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা। এক ঘন্টার সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সামরিক অভিযানের যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য সামনে আনেন স্থলবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই, বিমানবাহিনীর এয়ার মার্শাল একে ভারতী ও নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল এএন প্রমোদ।
খতম শতাধিক জঙ্গি সন্ত্রাসবাদী
পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও পাকিস্তানের ভেতরে ভারতের সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল জঙ্গি শিবিরগুলি। ‘অপারেশন সিঁদুরে’ নয়টি জঙ্গিঘাঁটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন লেঃ জেনারেল ঘাই। মৃত্যু হয়েছে শতাধিক জঙ্গি সন্ত্রাসবাদীর। নিহতদের মধ্যে ইউসুফ আজহার, আব্দুল মালিক রাউফ ও মুদসসর আহমেদের মতো ভয়ঙ্কর জঙ্গিও রয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ার আইসি ৮১৪ ফ্লাইট ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ও পুলওয়ামা হামলায় যুক্ত জঙ্গিও ভারতের মিসাইল হামলায় নিকেশ হয়েছে। নিশানা নিখুঁত থাকায় জঙ্গিদের বাইরে কোনও নিরীহ নারীপুরুষের মৃত্যু হয় নি বলে দাবি করেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই।

জঙ্গি সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিগুলি ভারতের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হানায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান ভারতের বেসামরিক পরিকাঠামো ও ধর্মীয়স্থানের পাশাপাশি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে। গত ৮-৯ মে রাতে পাকিস্তানের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন ও কয়েকটি বিমান ভারতের আকাশসীমায় ঢোকার চেষ্টা করলে দেশের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। পাকিস্তানের অধিকাংশ ড্রোন ও চালকবিহীন বিমানকে আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেন তিন বাহিনীর কর্তারা। ভারতের আকাশ সীমায় প্রবেশকালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কয়েকটি বিমানকেও ধ্বংস করা হয়েছে।

তাদের সামরিক পরিকাঠামোগুলি পাকিস্তানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, এটা দেখার পরেই কেবল পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটিগুলিতে প্রত্যাঘাত করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের তিন বাহিনী। ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয় সাংবাদিক সম্মেলনে। শুক্রবার (৯ মে, ২০২৫) রাতে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমানঘাঁটিতে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলে পড়ার ঘটনায় শাহবাজ শরিফের প্রশাসনে ত্রাসের সঞ্চার হয়। রাজধানী ইসলামাবাদের পাশেই অবস্থিত এই বিমানঘাঁটিটি পাকিস্তানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্র। ভারতের হামলায় বিমানঘাঁটিটির বড় রকমের ক্ষতি হয়েছে বলে স্বীকার করেছে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ।
পাক সেনার ৩৫-৪০ জওয়ান নিহত
সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতীয় বায়ুসেনার এয়ার মার্শাল একে ভারতী জানান, “পাকিস্তানের চাকলালা, রফিকি, রহিম ইয়ার খান, সরগোদা, জাকোকাবাদ এবং ভুলারির মতো সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালানো হয়েছে।” ভারতের আক্রমণে পাকিস্তানের বায়ুসেনার একাধিক ঘাঁটি, আর্মির কমান্ড সেন্টার ও অন্যান্য সামরিক পরিকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকিস্তানের কোনও ধরণের অসামরিক পরিকাঠামোতে আঘাত করা থেকে বিরত ছিল ভারতীয় বাহিনী। তাদের আক্রমণে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের হতাহত হওয়ার অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন ভারতের সামরিক বাহিনীর আধিকারিকরা। ভারতের প্রত্যাঘাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৫-৪০ জন জওয়ান নিহত হয়েছেন বলে তিন বাহিনীর কর্তারা জানিয়েছেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ নাভাল অপারেশনস’ ভাইস অ্যাডমিরাল এএন প্রমোদ জানান, “চাইলেই উত্তর আরব সাগরে মোতায়েন ভারতীয় নৌবাহিনীর রণতরীগুলি থেকে যে কোনও মুহূর্তে করাচি বন্দর সহ পাকিস্তানী নেভির যে কোনও ঘাঁটিতে আঘাত করা যেতো।” পহেলগাঁও ঘটনার পরপরই পাকিস্তানকে জবাব দিতে নৌসেনা প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন ভাইস অ্যাডমিরাল প্রমোদ। বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্ত, একাধিক ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেটের পাশাপাশি ডুবোজাহাজও পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাত করার জন্য প্রস্তুত ছিল। উত্তর আরব সাগরে এখন ভারতীয় নৌসেনাদের আধিপত্য চলছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলি রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়ে নিজেদের বন্দরের কাছাকাছি সমুদ্রে ভাসমান।
ভারতের পাঁচ জওয়ানের বীরগতি প্রাপ্তি
সংঘর্ষে ভারতের তরফে ক্ষয়ক্ষতির কথাও জানিয়েছেন তিন বাহিনীর কর্তারা। পাঁচজন জওয়ানের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে ভারত। দেশ রক্ষায় বীর জওয়ানদের আত্মবলিদানের কথা স্মরণ করে সাংবাদিক সম্মেলনে শোক প্রকাশ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই, এয়ার মার্শাল একে ভারতী ও ভাইস অ্যাডমিরাল এএন প্রমোদ। সংঘর্ষ চলাকালে কাশ্মীরে পাকিস্তানের গোলায় নিহতদের মধ্যে আছেন বায়ুসেনার চিকিৎসক ডাঃ সুরেন্দ্রকুমার মোগার, স্থলবাহিনীর জওয়ান এম মুরলী নায়েক, ল্যান্সনায়েক দীনেশ শর্মা, রাইফেলম্যান সুনীল কুমার ও বিএসএফের জওয়ান মহম্মদ ইমতিয়াজ।

সংঘর্ষে রাফাল যুদ্ধবিমানের কোনও ক্ষতি হয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন সাংবাদিকেরা। জবাবে এয়ার মার্শাল ভারতী বলেন, ক্ষয়ক্ষতি সংঘর্ষের অনিবার্য পরিণতি। রাফালও তার বাইরে নয়।” ভারত কোনও রাফাল হারিয়েছে কিনা, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানান নি এয়ার মার্শাল। সংঘর্ষ এখনও চলমান। এই পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের সুবিধা হতে পারে, এমন কোনও মন্তব্য করা থেকে তিনি বিরত থাকবেন বলে জানিয়েছেন এয়ার মার্শাল ভারতী। তবে পাকিস্তানের আকাশে অভিযানে গিয়ে বিমানবাহিনীর সকল পাইলট অক্ষত ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
Feature image source: NNDC.