অমৃতের সন্তান মানুষ, মানুষের মহাকুম্ভ তাই অমৃতময়

অমৃতের সন্তান মানুষ, মানুষের মহাকুম্ভ তাই অমৃতময়


১৪৪ বছর পর প্রয়াগে মহাকুম্ভ। ত্রিবেণীর পবিত্র জলে অবগাহন শেষে শঙ্খ বাজাচ্ছেন এক সাধু। সংগৃহীত ছবি

প্রয়াগে মহাকুম্ভ উপলক্ষে স্বাভাবিকভাবেই শুধু ভারত নয় গোটা বিশ্ব জুড়েই মহা আলোড়ন পড়ে গেছে। ১৩-ই জানুয়ারি থেকে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে যে মহাকুম্ভ মেলার শুরু তা শেষ হবে ২৬ ফেব্রুয়ারি। ৪৪ দিনের এই মহাকুম্ভে ৪৫ কোটিরও বেশি মানুষ ত্রিবেণী সঙ্গমে অবগাহন করবেন বলে জানা গেছে। মহাকুম্ভ মেলা শুধুমাত্র প্রয়াগরাজ বা এলাহাবাদেই অনুষ্ঠিত হয়। তবে প্রয়াগ ছাড়াও পালা করে পূর্ণকুম্ভ ও অর্ধকুম্ভের আসর বসে উজ্জয়িনী, হরিদ্বার ও নাসিকে।

মহাকুম্ভ মেলায় মকর সংক্রান্তির ভোরে শাহি স্নানের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন বিভিন্ন আখড়ার সাধুরা। সংগৃহীত ছবি

কুম্ভ মানে কলস। পুরাণ মতে সমুদ্র মন্থনকালে অমৃতে ভরা কলস উঠে এসেছিল। অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা ও অসুরের মধ্যে বেঁধে গিয়েছিল প্রচন্ড যুদ্ধ। দেবাসুরের যুদ্ধ দেখে দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্তের হাতে অমৃতের কলস তুলে দেন ভগবান বিষ্ণু। কাকের রূপ ধরে ঠোঁটে করে কলস নিয়ে উড়ে যান জয়ন্ত। সেই সময় কলস থেকে চলকে চার ফোঁটা অমৃত পড়ে যায় মাটিতে। প্রয়াগরাজ, উজ্জয়িনী, হরিদ্বার ও নাসিক- মর্ত্যের এই চার স্থানে অমৃতের চারটি ফোঁটা পড়েছিল বলে পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখ আছে। এই চার স্থানে তাই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে কুম্ভমেলা। বিশ্বাসীর বিশ্বাস কুম্ভমেলায় পৌঁছে বিশেষ বিশেষ যোগে একবার পুণ্যসলিলায় ডুব দিলেই সংসারচক্র থেকে চিরমুক্তি।

এ তো গেল পুরাণ ও কিংবদন্তির কথা। ইতিহাসেও কুম্ভমেলার উল্লেখ আছে। অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্যের হাত ধরে কুম্ভমেলার সূচনা বলে অনেক গবেষক মনে করেন। কোন‌ও কোন‌ও পন্ডিতের মতে তার‌‌ও আগে থেকে কুম্ভমেলা চালু আছে। সপ্তম শতাব্দীতে ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন প্রখ্যাত চিনা পরিব্রাজক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জুয়ানজাং বা হিউয়েন সাং। হিউয়েন সাংয়ের বিবরণীতে প্রয়াগে তিন নদীর সংগমস্থলে মেলা ও স্নানের কথা উল্লিখিত আছে। সম্রাট হর্ষবর্ধন সেই মেলায় স্নান সেরে নিজের পরিধেয়টুকু পর্যন্ত দান করে দিতেন বলে উল্লেখ করেছেন হিউয়েন সাং। এমন নয় যে সম্রাট হর্ষবর্ধন কুম্ভমেলার সূচনা করেছেন। আসলে মৌর্য ও গুপ্ত যুগ থেকেই প্রয়াগের সংগমস্থলে মকর সংক্রান্তিতে কুম্ভমেলা বসছে। পঞ্চম শতাব্দীতে ভারত ভ্রমণে এসে প্রয়াগরাজে কুম্ভমেলা চাক্ষুষ করেছেন অপর চিনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন‌ও।

মহাকুম্ভের ময়দানে মানুষের মহাসমুদ্র। ৪৪ দিনের মহাকুম্ভ মেলায় ৪৫ কোটির বেশি মানুষ তিন নদীর সংগমস্থলে অবগাহন করবেন। সংগৃহীত ছবি

মুমুক্ষু মানুষের মহামিলন মেলার নাম মহাকুম্ভ। কিন্তু যিনি মোক্ষ চান না, যিনি মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে পান, তাঁর কাছেও বর্ণময় কুম্ভমেলা এক পরম বিস্ময়। ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক থেকে কপর্দকহীন ভিক্ষুক, নবতিপর বৃদ্ধা থেকে অষ্টাদশী সুন্দরী, বলিউডের তারকা থেকে হলিউডের স্টার, এম‌আইটির প্রোফেসর থেকে আইআইটির প্রাক্তনী। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী থেকে সুযোগসন্ধানী পলিটিশিয়ান, যোগী থেকে ভোগী- মহাকুম্ভের ময়দানে মানুষের মহাসমুদ্রে কে নেই? শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ মর্ত্যের মরণশীল মানুষকে অভয় দিয়ে বলেছে হে মানব, তোমরাই অমৃতের সন্তান। মানুষের মহাকুম্ভ তাই অমৃতময়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *