প্রিগোঝিনকে কি শেষ পর্যন্ত চরম দন্ড‌ই দিলেন পুতিন? - nagariknewz.com

প্রিগোঝিনকে কি শেষ পর্যন্ত চরম দন্ড‌ই দিলেন পুতিন?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পুতিনের সঙ্গে ঝোঁকের বশে পাঙ্গা নেওয়ার মাশুল‌ই কি জীবন দিয়ে দিলেন রুশ ভাড়াটে যোদ্ধাদলের সর্দার ইয়েভজেনি ভিক্টোরোভিচ প্রিগোঝিন? ওয়াগনার প্রধানের মৃত্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রাথমিকভাবে যে ধোঁয়াশা ছিল, তা কেটে গেছে। রাশিয়ার সরকারি সূত্র থেকে ইতিমধ্যেই বিমান দুর্ঘটনায় প্রিগোঝিনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রিগোঝিনকে বহনকারী ব্রাজিলে নির্মিত ‘এমব্রেয়ার লিগ্যাসি জেট’ নামের বিমানটি বুধবার মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ উড়ে যাওয়ার পথে রাশিয়ার তিভের অঞ্চলের কুঝেঙ্কিনো গ্রামে ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির দশজন যাত্রীর মধ্যে ওয়াগনার প্রধান প্রিগোঝিন ছাড়াও তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড দিমিত্রি উৎকিন‌ও ছিলেন।

রাশিয়ার তিভের অঞ্চলে প্রিগোঝিনকে বহনকারী দুর্ঘটনাগ্রস্ত প্লেন জ্বলছে। ফটো ক্রেডিট- এনবিসি নিউজ

বিমান দুর্ঘটনার খবর প্রচার করার সময় বিভিন্ন রুশ সংবাদমাধ্যম থেকে প্রথমে শুধু এইটুকুই জানানো হয়েছিল, বিধ্বস্ত হ‌ওয়া বিমানটির যাত্রীতালিকায় ইয়েভজেনি প্রিগোঝিনের নাম আছে। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই ওয়াগনার প্রধানের ভাগ্য নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে যায় বিশ্ব জুড়ে। প্রিগোঝিন অভিশপ্ত বিমানটিতে ছিলেন নাকি নিয়তি তাঁকে কোন‌ওভাবে রক্ষা করেছে, তা নিয়ে তোলপাড় হয় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম। যদিও বৃহস্পতিবার সব জল্পনায় জল ঢেলে রুশ জরুরি ব্যবস্থাপনা দফতর জানিয়ে দিয়েছে, দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১০ যাত্রীর‌ই দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনে পুড়ে যাওয়ায় দেহগুলি শনাক্তকরণে ডিএন‌এ টেস্ট প্রয়োজন। তবে প্রাথমিকভাবে মৃতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে বলে ক্রেমলিনপন্থী নিউজ চ্যানেল সারগ্রাদ টিভি জানিয়েছে। চ্যানেলটি আরও জানিয়েছে, মৃতদের মধ্যে প্রিগোঝিন আছেন। তাঁর দেহ‌ও প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হয়েছে। পুতিনপন্থী সংবাদ মাধ্যম প্রিগোঝিনের মৃত্যু একপ্রকার নিশ্চিত করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন‌ও ধরে নিয়েছেন, ওয়াগনার প্রধানের ভাগ্যে চূড়ান্ত পরিণতি যা ঘটার ঘটে গিয়েছে।

যুদ্ধক্ষেত্রে ইয়েভজেনি ভিক্টোরোভিচ প্রিগোঝিন। প্রিগোঝিনকে কি সরিয়েই দিলেন পুতিন? ছবি- সংগৃহীত

প্রিগোঝিনের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা না অন্তর্ঘাত, আন্তর্জাতিক মহলে চর্চা এখন এই নিয়েই। যদিও রাশিয়ার ভেতরে ও বাইরে যাঁরা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিনকে চেনেন, প্রিগোঝিনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে তাঁদের মধ্যে খুব একটা সংশয় নেই। এই দলে রাশিয়ায় এক সময়ের বড় বিনিয়োগকারী আমেরিকান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী বিল ব্রাউডার থেকে সিআইএ’র প্রধান বিল বার্নস, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন‌ও আছেন। দু’মাস আগে ইউক্রেনের রণভূমিতে দাঁড়িয়েই পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন। পুতিনের তখন মনে হয়েছিল, প্রিগোঝিন পিঠে ছুরি মারল। অপমান অথবা নিজের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ- কোন‌ওটাই সহ্য করেন না পুতিন। পুতিনকে দুটোই করেছিলেন ওয়াগনার প্রধান। কিছুক্ষণের জন্য হলেও দুনিয়ার সামনে পুতিনকে অপদস্থ করেছিলেন ভাড়াটে যোদ্ধাদের এই সর্দার। দলবল নিয়ে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে মস্কোর উদ্দেশ্যে র‌ওয়ানা দিয়েছিলেন প্রিগোঝিন। ওয়াগনার প্রধানের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের সময়কালটা ছিল যদিও খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু এক রাতের জন্য হলেও ২৩ বছরের জামানায় পুতিনকে এতটা অসহায় আগে কখনও দেখায় নি।

ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও পুতিনের সঙ্গে চুক্তিতে এসে পিছু হঠে ইউক্রেনের রণাঙ্গন ছেড়ে সসৈন্যে বেলারুশ গমনের পর বুধবার বিমান দুর্ঘটনায় মাঝ আকাশে প্রিগোঝিনের মৃত্যু- সময়ের ব্যবধান মাত্র দুই মাস। যদিও ব্রিটিশ উদ্যোগপতি বিল ব্রাউডার মনে করেন, ওয়াগনার প্রধান যথেষ্টই ভাগ্যবান। কারণ, পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরেও তিনি দু’মাস সশরীরে ধরায় ছিলেন। প্রিগোঝিনের পরিণতি শোনার পর ব্রাউডার বলেন, “ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরেও প্রিগোঝিন এত দিন বেঁচেছিলেন, তাতেই আমি বিস্মিত হয়েছি।” বাইডেন বলেছেন, “আসলে কী ঘটেছে জানি না। তবে এই দুর্ঘটনায় মোটেই বিস্মিত ন‌ই। এতে পুতিনের হাত থাকতেই পারে।” রাশিয়ার রাজনীতিতে তাঁর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু তাঁকে কখনোই তেমন বিপদে ফেলতে পারেন নি, এমন অনেক দুর্বল শত্রুকেও রেয়াত করেন নি ভ্লাদিমির পুতিন। আর প্রিগোঝিনের বিদ্রোহের মুখে স্বয়ং পুতিন স্বীকার করেছিলেন যে দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পুতিন ঝানু গোয়েন্দা। সোভিয়েত ইউনিয়নের জামানায় টানা ১৬ বছর কেজিবিতে ছিলেন। ইয়েলৎসিনের আমলে রুশ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হয়েছিলেন। ইয়েভগেনি ভিক্টোরোভিচ প্রিগোঝিনের মতো খতরনাক ভাড়াটে ‘ওয়ারলর্ড’কে রুশ প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার প্রত্যাঘাত করার সুযোগ দেবেন, এটা মনে হয় প্রিগোঝিন নিজেও কল্পনার মধ্যে আনেন নি।

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ওয়াগনার প্রধান প্রিগোঝিন, যখন দোস্তি ছিল‌ দু’জনে। ছবি- সংগৃহীত

কেউটের লেজে পা দেওয়ার পরিণাম কী হতে পারে, তা বিলক্ষণ জানতেন ওয়াগনার প্রধান। ওয়াগনার আসলে ছিল পুতিনের নিজের তৈরি করা একটি সশস্ত্র বাহিনী। ঘনিষ্ঠ হোটেল ব্যবসায়ী প্রিগোঝিনকে এই বাহিনীর প্রধান হ‌ওয়ার যোগ্য বলে মনে হয়েছিল রুশ একনায়কের। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ক্রেমলিনের মিত্র বাশার আল আসাদের সরকারকে রক্ষা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল প্রিগোঝিনের ভাড়াটে সৈনিকেরা। ধীরে ধীরে প্রিগোঝিন আর ওয়াগনার অভিন্ন হয়ে ওঠে। ইউক্রেনের রণাঙ্গনে ওয়াগনারের সাফল্য প্রিগোঝিনকে উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদীদের হৃদয়ে নায়কের আসনে বসায়। আবার ইউক্রেন যুদ্ধে রণকৌশলের প্রশ্নে রুশ সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে প্রিগোঝিনের মতবিরোধের জেরেই তাঁকে পুতিনের বিরাগভাজন হতে হয়। প্রিগোঝিন পুনরায় ক্রেমলিনের আস্থাভাজন হয়ে ওঠার চেষ্টা চালালেও প্রিগোঝিন ও তাঁর ভাড়াটে বাহিনীর ব্যাপারে দু’মাস আগেই চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন পুতিন। প্রিগোঝিন পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পিছু হঠার পরেই সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নস বলেছিলেন, পুতিনের প্রতিশোধ সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আঁটঘাট বেঁধেই কি বুধবার প্রতিশোধটি নিয়ে ফেললেন এক্স কেজিবি অফিসার ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন?

Feature graphic is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *