হে যাদবপুরের বিপ্লবীগণ, সিসি ক্যামেরার বিরোধিতা না করে আগে মুখের কালি মোছো। মেন হস্টেলে ছাত্র মৃত্যু নিয়ে লিখলেন ঋতুপর্ণা কোলে-
নদীয়া জেলার বগুলা থেকে পদার্থ বিজ্ঞানের অনার্স ছেড়ে কেবল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ভালবেসে দক্ষিণ কলকাতার পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিল ছেলেটি। বয়স তখনও আঠারো স্পর্শ করে নি। ইচ্ছে ছিল বাংলা বানান নিয়ে গবেষণা করবে। সেই স্বপ্ন ৯ অগাস্ট রাতে হস্টেলের তিন তলার বারান্দা থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে। মৃত্যু ঘটে একটি স্বপ্নের। ঠিক কী হয়েছিলো ৯ই অগাস্ট রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হোস্টেলে?
র্যাগিংয়ের কারিকুলামে যৌন নির্যাতন মুখ্য
প্রথমে তো ঘটনাকে স্রেফ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ছেলেটির বাবা অভিযোগ আনেন, ছেলে আত্মহত্যা করে নি র্যাগিংয়ের সময় তাকে খুন করেছে হস্টেলের দাদারা। বাবা-মা তো জানতেন, ছেলের উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে হস্টেলে। সেই রাতে ঘটনার ঘন্টা খানেক আগেও ছেলেটি মাকে ফোন করে জানিয়েছিল, সে ভাল নেই। সত্য ধামাচাপা দিতে পারলে মেন হস্টেলের আবাসিকবৃন্দ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিঃসন্দেহে হাঁপ ছেড়ে বাঁচত। কে আর যেচে তিক্ত সত্যের মুখোমুখি হতে চায়। তবে সবাই ভন্ড বিপ্লবী নন। কারও কারও বিবেক আছে। ফেসবুক সত্যটা প্রথম জানিয়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক অধ্যাপক। তিনি বলেন, র্যাগিং-এর কারণে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের মৃত্যু ঘটেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে র্যাগিংয়ের জেরে মৃত্যু প্রথম কিন্তু সেখানে র্যাগিং নতুন নয়। মেন হস্টেলের র্যাগিং কী জিনিস, তা সেখানকার প্রাক্তন আবাসিক মাত্রেই জানেন। র্যাগিং মেন হস্টেলের কারিকুলামে পরিণত হয়েছে বহু আগেই। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় তা দিনে দিনে বেড়ে যে জায়গায় এসেছে, তাকে র্যাগিং না বলে সংগঠিত যৌন নির্যাতন বলা সঙ্গত। বগুলার ছেলেটির উপরে ঠিক কী কী শারীরিক, মানসিক অত্যাচার হয়েছিল, তা তদন্ত করে বের করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু নির্যাতনটা যে মূলতঃ যৌনগন্ধী, ঘটনার সূত্রপাত থেকেই তা স্পষ্ট।
মেন হস্টেল এক্সপোজড
আসলে ছেলেটি মরে মেন হস্টেলের ভেতরের কদর্য চিত্রটা ‘এক্সপোজ’ করে দিল। চরম কিছু ঘটার আগে পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকাই তো সমাজের দস্তুর। ছেলেটির মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সংবাদ মাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যম যাদবপুর ময়। যাদবপুরের মেন হস্টেলের অন্দর মহল সম্পর্কে চমৎকার যে সব তথ্য এই ক’দিনে উঠে এসেছে তা একে একে দেখে নেওয়া যাক-
• আইনের শাসন মেন হস্টেলে চলে না। সিনিয়ারদের রাজত্ব চলে।
• পাশ করে গেলেও প্রাক্তনীরা বছরের পর বছর গেস্ট সেজে সিট দখল করে রাখে এবং জুনিয়ারদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়, যাতে তারা হোস্টেল ছেড়ে চলে যায় আর সেই সিটে অনির্দিষ্টকাল তারা আরও আরামে থাকতে পারে।
• র্যাগিং-এর নামে চলত শারিরীকি, মানসিক অত্যাচার। যৌন নির্যাতনও ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার।
• অন্ধ, বিশেষভাবে সক্ষমদেরও নির্যাতনের হাত থেকে ছাড় ছিল না।
• হস্টেলের দাদাদের জন্য রাতে মদ, গাঁজা সরবরাহ করতে হত জুনিয়রদের।
• নগ্ন করে পরীক্ষা করা হতো পুরুষ কিনা!
• মা-বাবা, বোন সম্পর্কেও নোংরা কথা বলতে বাধ্য করা হত!
• ক্লাসের মেয়েদের শরীরের বর্ণনা দিতে হত কিংবা গোপনে তাদের ছবি তুলে আনতে হত।
• সিনিয়ারদের অবাধ্য হলেই চলত অকথ্য অত্যাচার।
সিনিয়ারদের জামাকাপড় কেচে দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার করে দেওয়ার মতো মামুলি শাস্তির কথা উল্লেখ না করাই ভাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তো বাম-অতিবাম রাজনীতির বারাণসী। তো বাম-অতিবামের বারাণসীতে এটা ছাত্রাবাস না কুখ্যাত গুয়ানতানামো কয়েদখানা? আজকাল তো জেলেও বন্দিদের এমন নির্যাতন সহ্য করতে হয় না।
তবুও অতিবামেদের যায় না ঢ্যামনামি
আঠারোতে পা না দেওয়া ছেলেটিকে উল্লিখিত প্রায় সবরকমের অত্যাচারের মুখেই পড়তে হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে। এমনকি তিনতলার সরু রেলিং-এ তুলে হাঁটানোর অভিযোগও উঠে আসছে। সেদিন যা যা হয়েছিল তদন্তে আরও স্পষ্ট হবে আশা করা যায়। ছেলেটিকে যে নগ্ন করে বারান্দায় ঘোরানো হয়েছিল, বিভিন্ন সূত্র থেকে তা জেনেছেন তদন্তকারীরা। অবাক লাগে, এতকিছুর পরেও যাদবপুরের কিছু অতি বাম ছাত্র সংগঠন ‘ইউজিসি’র গাইড লাইনের বিরোধিতা করে যাচ্ছে! এই বিপ্লবীদের কাছে কি একজনকে নগ্ন করাটা খুবই মামুলি ব্যাপার? হস্টেলকে টর্চার সেলে পরিণত করাই নামই কি বিপ্লব? ছোটভাইয়ের তুল্য সহআবাসিককে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে বুকে টেনে না নিয়ে নিগ্রহ করার নামই কি দিনবদলের স্বপ্ন দেখা?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে যাদবপুর অন্যতম। গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাদবপুরের খ্যাতি ইউরোপ-আমেরিকার অ্যাকাডেমিক পরিসরেও ছড়িয়েছে। তারপরেও নানা কারণে যাদবপুরের উপর সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই খাপ্পা। পড়ালেখার পাশাপাশি যাদবপুর বিখ্যাত ছাত্র রাজনীতির কারণেও। বাঙালির মনে এখন বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে রাজনীতি ভদ্রলোকের বিষয় নয়। পড়াশোনার জায়গায় রাজনীতি খুব খারাপ জিনিস। যাদবপুর সেই বিশ্বাসেই আঘাত করে বারবার। যাদবপুরের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি অধিকার আদায় করতে জানে বলেই পড়াশোনা শেষে চাকরির জন্য ভিক্ষার পাত্র নিয়ে ধর্নামঞ্চে বসে না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় ভাল, মেধাবী। পাশাপাশি প্রতিবাদী, প্রতিষ্ঠান বিরোধীও। এই থেকেই যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে অহংকার। সেই অহংকার থেকেই সমালোচনার মুখে পড়লে যুক্তির বদলে যাদবপুরের উন্নাসিক পড়ুয়াদের মুখে উঠে আসে “চান্স পেয়ে দেখা” জাতীয় অপমানজনক শব্দ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, যারা এই কথাগুলো বলে পড়ুয়াদের ভেতরে তারা সংখ্যায় বেশি নয়। অথচ এদের জন্যই গোটা বিশ্ববিদ্যালয় বদনাম কুড়োয়।
যারা ছেলেটিকে নির্যাতন করে মারল বা মরতে বাধ্য করল, তারা নিজেদের পাশাপাশি নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যতের কতবড় ক্ষতি করল, তারা তা উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে ধৃতদের আচরণে মনে হয় না। ছাত্র মৃত্যুর ঘটনার পর এরই মধ্যে ইউজিসিকে পরপর দুবার যে রিপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় পাঠিয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলেই জানিয়েছে ইউজিসি। অটোনমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটাস, গ্রান্ট ইত্যাদি এখন প্রশ্নের মুখে। এরপরেও যাদবপুরের কিছু অতি বিপ্লবী কত বড় নির্বোধ হলে চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে ক্যাম্পাসে, হস্টেলে সিসি ক্যামেরা বসানোর বিরোধিতা করতে পারে? এরা সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরার সামনে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়ে সেখানে মদ, গাঁজা খাওয়ার অধিকার ফলায় কোন মুখে?
তোমরা বিপ্লবী! শাস্তি তবে আরও বেশি
সমাজ বদলের ডাক দেয় যে যাদবপুর, বিদ্রোহের আগুন জ্বালায় যে যাদবপুর, তার নিজের গর্ভে কী ভয়ঙ্কর জমাট বাঁধা অন্ধকার তা জীবন দিয়ে বুঝিয়ে গেল বাংলা নিয়ে পড়তে আসা ছেলেটি। যাদবপুরের ছাত্র বলেই র্যাগিং-এর সঙ্গে সামান্যতমও যোগ থাকা প্রতিটা (অ)মানুষের নর্মাল শাস্তির থেকে বেশি করে শাস্তি হওয়া উচিত। “সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যা” সিনেমার শেষে আসারাম বাপুর শাস্তি কেন হওয়া উচিত, এই প্রসঙ্গে রামায়ণের একটা বক্তব্য তোলা হয়েছিলো। রাবণ এত বড় শিবভক্ত। তবু শিব কেন তার পরম ভক্তকে রক্ষা করেন নি? উত্তরে মহাদেব জানিয়েছিলেন, রাবণ যদি নিজে যা সে সেই রূপ নিয়েই সীতাকে হরণ করত তবুও তার শাস্তি খানিক কম হলেও হতে পারত। কিন্তু সে সাধুর ছদ্মবেশ নিয়েছিলো। “সাধু”……. শব্দটা লক্ষ্য করার মতো। যাকে মানুষ সহজে বিশ্বাস করবে, তারই ছদ্মবেশ। সেই পাপের কোনও ক্ষমা হয় না। বৃদ্ধ আসারামও তাই ছাড়া পায়নি।
যাদবপুরের র্যাগিংকারীরা এক একটা সাধুর ছদ্মবেশধারী। দিন বদলের ডাক কথায় কথায়। এরা প্রতিটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় ধৃতদের ফেসবুক দেওয়াল জুড়ে কত বড় বড় কথা! এ’সবই যে তাদের ছদ্মবেশ তা কীভাবে বুঝবে ওই বাচ্চা ছেলেটি। র্যাগিং কোথাও কাম্য নয় কিন্তু বাকি জায়গায় কেউ যাদবপুরের ছদ্মবেশ ধরে না। মানুষের পাশে থাকার মুখোশ পরে না, শ্রেণি সংগ্রামের ধ্বজা ধরে না। তাই এদের নির্মমতম শাস্তি হওয়া খুব দরকার। নাহলে হাতে গোনা যে কটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা প্রকৃতই ক্ষমতা রাখে অন্যায়ের চোখে চোখ রাখার, তারা সাধারণ মানুষের কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে দাঁড়াবে।
Feature image /graphic is representational.