'দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস': লিগের পরিকল্পনা বানচালে সদিচ্ছাই ছিল না ওয়াভেল,গান্ধী,নেহেরুর - nagariknewz.com

‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’: লিগের পরিকল্পনা বানচালে সদিচ্ছাই ছিল না ওয়াভেল,গান্ধী,নেহেরুর


জিন্নাহর হুমকি কানেই তুললেন না‌ কেউ! বলেকয়েই কলকাতায় দাঙ্গা বাঁধাল লিগ। দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস নিয়ে লিখলেন উত্তম দেব-

১৯৪৬-এর ১৬ অগাস্ট অপরাহ্নের পর থেকে কলকাতা শহরেই নির্ধারিত হয়ে যায় ভারতের ভাগ্য।‌ ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত দেশভাগে সম্মত না হলে কলকাতা থেকে করাচি- হিন্দুস্তান রক্তস্নানে ভাসিয়ে দেওয়া হবে, এই ছিল মহম্মদ আলি জিন্নাহর পরিকল্পনা। তখন মুসলিম লিগের লোকেরা স্লোগান দিত- ”হাত মে বিড়ি, মু মে পান/ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।” লিগের প্রকৃত লড়াইটা শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকেই।‌ ‘জঙ্গ’ শুরু করার জন্য কলকাতা‌ই যে সব থেকে ‘বেহেতর’ স্থান, এটা বুঝে ছিলেন জিন্নাহ। জিন্নাহ পরিকল্পনা চেপেও রাখেন নি। কিন্তু জিন্নাহর হুমকিকে ধর্তব্যের মধ্যে নেয় নি ক্লিমেন্ট এটলির সরকার। এমনকি নিস্পৃহ থাকেন জ‌ওহরলাল নেহেরুও। ক্যাবিনেট মিশন মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে তেমন কান দিচ্ছে না বুঝতে পেরেই তড়পাতে শুরু করেন জিন্নাহ। ছেচল্লিশের জুলাইয়ে কোন‌ও রাখঢাক না করে জিন্না হুমকি দিলেন, “আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু তোমরা যদি যুদ্ধ চাও আমরা তোমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধা করব না। যুদ্ধে হয় আমরা ভারতকে ভাগ করব নয় ধ্বংস করব।‘

জিন্নাহর হুমকি কানেই তুললেন না‌ কেউ!

ব্রিটিশ সরকার দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর করবেই, ততদিনে এটা পরিষ্কার। একটা এস্পার-উস্পার করতে যুদ্ধের হুমকিটা ভাইসরয় লর্ড আর্চিবল্ড্ পারসিভাল ওয়াভেল ও কংগ্রেস নেতৃত্ব- উভয়েরই উদ্দেশ্যেই দিয়েছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ। কিন্তু না গভর্নল জেনারেলের প্রশাসন জিন্নাহর হুমকিকে সিরিয়াসলি নিয়েছিল না নেহেরুর কোন‌ও ভাবান্তর হয়েছিল। তাঁর সহজাত ভাব বিলাস না শয়তানি- ঠিক কোন কারণে জিন্নাহর হুমকিকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন নেহেরু, এই প্রশ্নের নিষ্পত্তি সহজ নয়। তবে নেহেরু সহ কংগ্রেস নেতৃত্ব সময়ে সতর্ক হয়ে গেলে অগাস্টে রক্তস্নান থেকে রক্ষা পেত কলকাতা। সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বরে বেলেঘাটায় গান্ধীর অনশনের কথা বলতে গিয়ে অনেক গান্ধীভক্তের আজও গলা ধরে আসে। কিন্তু মুসলিম লিগ দাঙ্গা বাঁধাতে পারে, এটা অনুমান করার মতো বুদ্ধি ছেচল্লিশের জুলাইয়ে গান্ধীর লোপ পেল কীভাবে?

১৯৪৬-এর ১৬ অগাস্ট বিকেলে মনুমেন্টের নীচে লিগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র সভা।

১৬ অগাস্ট দুপুর পর্যন্ত মুসলিম লিগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ প্রতিরোধে কোন‌ও পরিকল্পনা ছিল না প্রশাসনের। অথচ বেশ বলে কয়েই নিজের বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে ছিলেন জিন্নাহ। লিগের তরফে পরিকল্পনায় কোন‌ও খুঁত ছিল না। খুব জেনেবুঝেই মুসলিম লিগ সরকার নিয়ন্ত্রিত অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের ‘এপিসেন্টার’ হিসেবে। কলকাতায় একবার জবরদস্ত দাঙ্গা শুরু করতে পারলে তার অভিঘাত যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, তা বোঝার মতো বুদ্ধি লিগ নেতৃত্বের থাকলেও ইংরেজ সরকার ও কংগ্রেস নেতৃত্বের ছিল না। মুসলিম লিগের জন্য পূর্বের কলকাতা তখন দুর্ভেদ্য ঘাঁটি, পশ্চিমের লাহোর‌‌ও কলকাতার কাছে কিছু নয়।

নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন গভর্নর ব্যারোজ

১৯৪৬ এর ১৬ অগাস্ট ছিল শুক্রবার। দিনটি বেছে নেওয়ার তাৎপর্য সহজেই অনুমেয়। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোর‌ওয়ার্দি। গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক‌ জন ব্যারোজ। বিকেলে মনুমেন্টের নিচে সমাবেশ‌ ডাকল মুসলিম লিগ। সমাবেশ ডেকেই জুম্মাবারটিকে ‘পাবলিক হলিডে‘ হিসেবে ঘোষণা করতে গভর্নর ব্যারোজকে টোপ দিলেন সোর‌ওয়ার্দি। টোপ গিলে ১৬ অগাস্ট গণছুটি ঘোষণা করে দিলেন ব্যারোজ। মসজিদে মসজিদে জুম্মার নমাজ শেষে সকলের একমাত্র গন্তব্য যেন হয় মনুমেন্টের মাঠ, সেই মতো ব্যবস্থা করা হল। পাড়ায় পাড়ায় লিগের নেতাকর্মীদের হাবভাব দেখে হিন্দুদের মধ্যে আশঙ্কার একটি চোরাস্রোত ব‌ইলেও তাদের আশ্বস্ত করতে কোনও আগাম পদক্ষেপই করেন নি গভর্নর ব্যারোজ। প্রধানমন্ত্রী সোর‌ওয়ার্দির অভিসন্ধি হয় ব্যারোজ বোঝেন নি নয় বুঝেও হাত গুটিয়ে ছিলেন।

অমৃতবাজার পত্রিকায় ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’-এর খবর।

১৬ অগাস্ট সকাল দশটার পর থেকে একটা উত্তেজনার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল নগর কলকাতায়। সরকারের গণছুটির বিরোধিতা করেছিল কংগ্রেস।‌ হিন্দুরা যথারীতি দোকানপাট খুলেছিলেন। তবে মিছিল করে সভাস্থলে যাবার পথে জোর করে দোকান বন্ধ করে দিচ্ছিল লিগের কর্মীসমর্থকেরা। মিছিলকারীদের হাতে ছিল বাঁশের মোটা মোটা লাঠি এমনকি লোহার রড‌‌ও। মনুমেন্টের তলায় লিগের সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহিদ সোর‌ওয়ার্দি। সমাবেশে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত হয়েছিল। গরম গরম ভাষণ দিয়ে জনতাকে তাতিয়ে দিলেন দু’জনেই। ‘সভায় আসার পথে মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছে ‘ মঞ্চ থেকে এই কথা বলে আগুনে ঘি ঢাললেন নাজিমুদ্দিন। সভা ফেরত জনতা মহানগরীর পথে পথে কী করেছিল তার প্রমাণ পরের দিনের আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়– “প্রত্যক্ষ সংগ্রামের তান্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করিলাম। আমরা পূর্ব হ‌ইতেই যাহা আশঙ্কা করিয়াছিলাম, তাহাই বাস্তবে পরিণত হ‌ইল। কলিকাতার রাজপথ বার বার নাগরিকদের রক্তে স্নাত ‌হ‌ইয়াছে। কিন্তু প্রতিবার‌ই এই সংগ্রাম চলিয়াছিল নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে। নিরস্ত্র নিরীহ অহিংস জনসাধারণ ও ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করিয়া ইংরেজ রাজপুরুষ আপনার ক্ষমতা মত্ততার নিষ্ঠুর পরিচয় দিয়াছে। এই আন্দোলনে যাঁহারা শহিদ হ‌ইয়াছেন তাঁহারা জাতীয় জীবনে চিরস্মরণীয় হ‌ইয়া থাকিবেন। কিন্তু আজিকার এই সংগ্রামকে আমরা কী আখ্যা দিব? নরহত্যা, লুটতরাজ, অত্যাচার প্রভৃতি যত কিছু অন্যায় সমস্ত‌ই অনুষ্ঠিত হ‌ইয়াছে। আজ জাতীয় জীবন কলুষ কালিমালিপ্ত। নিরীহ পথচারীর ওপর আক্রমণ চালাইয়া অসহায় পরিবারবর্গের ওপর অত্যাচার করিয়া ঘরবাড়ি পুড়াইয়া যে সংগ্রাম তাহার জঘন্য রূপকে প্রকাশ করিল তাহা জাতীয় ইতিহাসের কলঙ্কস্বরূপ।”

প্রথম দু’দিন পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়

১৬ অগাস্ট সন্ধ্যার পর থেকে তিলোত্তমা কলকাতাকে দোজখে পরিণত করল দাঙ্গাবাজরা। সভাস্থল থেকে সোজা লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে চলে যান বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোর‌ওয়ার্দি । সারারাত সেখানেই ছিলেন তিনি। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ নয় বরং প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রেখে দাঙ্গা ছড়িয়ে দিতেই লালবাজার কন্ট্রোল রুমে ঘাঁটি গেড়েছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী– সোর‌ওয়ার্দির দিকে অভিযোগ এমন‌ই। ১৬ অগাস্ট রাতে সোর‌ওয়ার্দি যে লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন এটা কোনও গুজব নয় । অনেক সাংবাদিক এই দৃশ্য দেখেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত সাংবাদিক শঙ্কর ঘোষ‌ও একজন। সোর‌ওয়ার্দি স্বয়ং এই ঘটনা অস্বীকার করার সুযোগ পান নি। তিনি সাফাই দিয়ে বলেছিলেন, ‘কন্ট্রোল রুমে ছিলাম কথা সত্য তবে পুলিশ যাতে ঠিকঠাক কাজ করে এটা দেখার জন্য‌ই সেখানে ছিলাম। ‘ যদিও ১৬ তারিখ রাত কিম্বা ১৭ তারিখ সারাদিনের ঘটনা সোর‌ওয়ার্দির দাবির সত্যতা প্রমাণ করে না। এর পর থেকেই কলকাতার হিন্দুরা হোসেন শহিদ সোর‌ওয়ার্দির নাম দেয় ‘ছোরাবর্দি সাহেব‘।

বাবাকে খুন করেছে। শিশুকেও রেহাই দেয় নি নরপিশাচের দল।

১৭ অগাস্টের যেই বর্ণনা আনন্দবাজার দিচ্ছে দেখা যাক– ‘দ্বিতীয় দিবসেও ( শনিবার ) কলিকাতা নগরী কান্ডজ্ঞানহীন উচ্ছৃঙ্খল জনতার কবলে সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থায় ছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক গত দুই দিবসে মোটের ওপর দুই শতাধিক হত এবং ১৫০০ আহত হ‌ইয়াছে। গতকল্য নগরীর রাজপথসমূহ হ‌ইতে অসংখ্য মৃতদেহ অপসারণ করা হ‌ইয়াছে। এখনো বহু মৃতদেহ রাস্তায় পড়িয়া আছে। আইন ও শৃঙ্খলার পরিবর্তে অরাজকতার বিজয়রথ‌ই যেন নগরীর ওপর দিয়া তাহারা চালাইয়াছে। বস্তুত গতকল্য প্রাতঃকাল হ‌ইতে‌ অপরাহ্ন পর্যন্ত উত্তর ও মধ্য কলিকাতায় অব্যাহত গতিতে ছুরিকা ও লাঠি চলিয়াছে। অবশেষে সন্ধ্যা সমাগমে অবস্থা কতকটা শান্তভাব ধারণ করিলেও প্রায়শই চোরাগোপ্তা আক্রমণের সংবাদ পাওয়া গিয়াছে।‘ ১৮ অগাস্টের আনন্দবাজার জানাচ্ছে ১৭ তারিখ সকালে তাদের দফতর‌‌ও আক্রান্ত হয়েছিল– ‘অরাজক অঞ্চলে অবস্থিত বলিয়া আমাদের অফিসের কার্য্যাদি প্রায় সমস্ত‌ই বন্ধ ছিল। তজ্জন্য আজ দুইদিন পর্যন্ত আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড মাত্র দুই পৃষ্ঠা করিয়া প্রকাশ হ‌ইতেছে। গতকাল প্রাতে গুন্ডাগণ আমাদের অফিস বাটী আক্রমণ করিয়াছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমরা উহা প্রতিহত করিতে সমর্থ হ‌ইয়াছিলাম। প্রধান অফিসগৃহের নিকটবর্তী মেছুয়াবাজার স্ট্রীটস্থ আমাদের মেসবাড়িও অনুরূপভাবে আক্রান্ত হ‌ইয়াছিল। কিন্তু মেসের অধিবাসীদের সাহস ও কৌশলে তাহা রক্ষা পায়। অফিসের সম্মুখস্থ আমাদের গুদামঘরে এবং অফিস সংলগ্ন পোষ্ট অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়, আমাদের রিপোর্টারগণের গাড়ি রাস্তায় বাহির করা মোটেও সম্ভব হয় নাই।‘

এক বছরের মধ্যেই দেশভাগ

১৬ থেকে ১৮ অগাস্ট– মুসলিম লিগের একদিনের সমাবেশের জেরে টানা তিনদিন বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল কলকাতা মহানগরী। তখন কলকাতায় হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৭৩ শতাংশ । মুসলমান ২৩ এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষ ৪ শতাংশ। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসে ঠিক কত জীবনহানি হয়েছিল হিসেব নেই। একটি হিসেবে কমপক্ষে বিশ হাজার মানুষ খুন হয়ে যায় তিনদিনের দাঙ্গায়। তখন কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ৪০ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫৫৬। কোনও সন্দেহ নেই যে, কিলিংস টা ছিল গ্রেট! কলকাতাকে কেন্দ্র করে মুসলিম লিগের রণকৌশল নিঃসন্দেহে সফল হয়েছিল। এরপর লাহোর থেকে নোয়াখালি– সারা ভারতবর্ষে দাঙ্গার আগুন জ্বলে ওঠে। মানুষের খুনে লাল হয়ে যায় দেশের মাটি। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে সম্ভ্রমহারা নারীর কান্নায়। বলা যায়, অক্ষরে অক্ষরে তাঁর ওয়াদা রক্ষা করেছিলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ। ভারতকে কার্যত ধ্বংস এবং ভাগ দুটোই করেছিলেন তিনি। ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’-এর এক বছর পূর্ণ হ‌ওয়ার দু’দিন আগেই জিন্নাহর পাকিস্তান লাভ।

তথ্যসূত্র- ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৬-১৯৬৪ পত্রপত্রিকার ভাষ্য’- সুকুমার বিশ্বাস।
ফটো- লাইফ ম্যাগাজিন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *