গোয়ার পর ত্রিপুরা: অভিষেক বাংলার বাইরে ডাহা ফেল, বাংলাতেও কি সফল? - nagariknewz.com

গোয়ার পর ত্রিপুরা: অভিষেক বাংলার বাইরে ডাহা ফেল, বাংলাতেও কি সফল?


বাংলার বাইরে অভিষেকের দৌড় তো বোঝা গেল। বাংলাতে অভিষেক একার কাঁধে দলকে পার করতে সক্ষম- সেই প্রমাণ‌ও কিন্তু এই যাত্রায় পাওয়া গেল না। লিখলেন নির্বাণ রায়-

তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে কালীঘাটের সমান্তরাল ক্যামাক স্ট্রিটেও যে ক্ষমতার একটি পৃথক ভরকেন্দ্র তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক মহলের কোনও সন্দেহ নেই। দল ছাড়িয়ে রাজ্য প্রশাসনের ভেতরেও ক্যামাক স্ট্রিটের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে খবর। ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে বসে যিনি তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের গুরু দায়িত্ব পালন করছেন, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে দলের ভেতরে এতদিনে একটি যথেষ্ট শক্তিশালী অক্ষও তৈরি হয়েছে। এবং সেই অক্ষের ভেতরে ও বাইরে যাঁরা আছেন, তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টিও রাজনৈতিক মহলের কাছে আর বিশেষ চাপা নেই। তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড‌ই যদি হন দলের ভবিষ্যৎ কর্ণধার, তবে ভাবী কর্ণধারের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়ার জন্য ত্রিপুরার ভোট‌ই কি যথেষ্ট নয়?

মেঘালয়ে সাফল্যটা মূলত মুকুল সাংমার

ভোট ত্রিপুরার পাশাপাশি মেঘালয়, নাগাল্যান্ডেও হয়েছে। কিন্তু মেঘালয়ে তৃণমূলের সাফল্য দিয়ে ত্রিপুরার ব্যর্থতাকে আড়াল করার জায়গা নেই। মেঘালয়ে তৃণমূল ৫টি আসন ও ১৩.৭৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। কিন্তু এই সাফল্যের কৃতিত্ব কতটা মেঘালয়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমার আর কতটা বাংলা থেকে যাওয়া তৃণমূল নেতৃত্বের তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বুঝতে অসুবিধা হ‌ওয়ার কথা নয়। গারো জনগোষ্ঠীর এই জনপ্রিয় নেতাকে দু’বছর আগে কংগ্রেস থেকে ভাঙিয়ে এনেছেন মমতা-অভিষেক। দল ভাঙানো যদি কৃতিত্বের হয়, তবে তা দাবি করতেই পারেন তৃণমূলের দুই শীর্ষ নেতা। মুশকিল হচ্ছে উত্তরপূর্বাঞ্চলের নেতারা এক ডালে বেশিদিন থাকেন না। মেঘালয়ের মুকুল কতদিন তৃণমূলের দাঁড়ে বাঁধা থাকেন, এই নিয়ে শনিবার থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সংবাদ মাধ্যমে।

গোয়ায় ৪৭.৫০ কোটি খরচ করে সাড়ে চার শতাংশ ভোট

ছোট রাজ্য দিয়ে দলের সর্বভারতীয় পরিচয়ের বিস্তৃতি ঘটানোর পরিকল্পনা তৃণমূলের অনেক দিনের। আগে মুকুল রায় সেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। পরে প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে অভিষেক তেড়েফুঁড়ে নামেন ছোট ছোট রাজ্যগুলিতে তৃণমূলের জমি শক্ত করার কাজে। অভিষেকের গোয়া অভিযান ব্যর্থ হ‌ওয়ার পরপরই প্রশান্ত কিশোর তৃণমূল থেকে কেটে পড়েন। ভারতের ক্ষুদ্রতম রাজ্য জয় করতে ভোটে ৪৭.৫৪ কোটি টাকা খরচ করে তৃণমূল। যা বিজেপির খরচের থেকেও অনেক বেশি। এ তো গেল শুধু ভোটের খরচ। তার আগে অন্য দল থেকে লুইজিনহো ফেলেইরোর মতো বাতিল ঘোড়া কেনাকাটা করতে তৃণমূলের কত খরচ হয়েছে কে জানে। তৃণমূলের বাংলার বিধায়কেরা ফেলেইরোকে রাজ্যসভায় পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন মমতার হুকুমে। লুইজিনহো ফেলেইরো এখন মমতা-অভিষেকের কী কাজে আসছেন, তা তাঁরাই ভাল বলতে পারবেন।

গোয়ায় ভোট প্রচারে সবথেকে বেশি খরচ করেছিল তৃণমূল, বিজেপির থেকেও। ফটো – সংগৃহীত

গোয়া ভোটের আগে অভিষেক যত তর্জন-গর্জন করেছিলেন, বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলির ফাইল‌ ফুটেজে সে’সব সংরক্ষিত আছে। সাড়ে সাতচল্লিশ কোটি টাকা খরচ করে শেষ পর্যন্ত গোয়া থেকে এসেছিল সাড়ে চার শতাংশ ভোট। বাংলার বাইরে তৃণমূলকে সম্প্রসারণের প্রধান সেনাপতি অভিষেক। গোয়া যুদ্ধে তৃণমূলের শোচনীয় পরাজয়ের পরে অভিষেকের সেনাপতিত্ব নিয়ে দলে কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন কিনা জানা যায় নি। তবে পরিস্থিতি আঁচ করে মমতা যে গোয়ার নির্বাচন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন, তা পরিষ্কার।

ত্রিপুরায় জলের মতো টাকা ঢেলে নোটার কাছেও হার

গোয়ার অনেক আগে থেকেই ত্রিপুরা নিয়ে তৃণমূলের আকুপাকু। বাঙালির দ্বিতীয় রাজ্যে নিজের নাম রৌশন করার মমতার চেষ্টা খুবই স্বাভাবিক। বাঙালি অধ্যুষিত ত্রিপুরার‌ জনজীবনের উপর পশ্চিমবঙ্গের প্রভাব নিয়ে কোনও দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু বহু বছর ধরে অনেক চেষ্টার পরেও ত্রিপুরার রাজনীতিতে দাগ কাটতে ব্যর্থ তৃণমূল। একুশে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে নবান্নে প্রত্যাবর্তনের পর ত্রিপুরা বিজয়ের দায়িত্ব অভিষেকের ঘাড়েই ছেড়ে দিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। দায়িত্ব পেয়ে হাঁকডাকের পাশাপাশি দৌড়ঝাঁপ‌ও কম করেন নি অভিষেক। ত্রিপুরায় দলের সংগঠন বিস্তারের লক্ষ্যে কংগ্রেস থেকে ভাঙিয়ে এনেছেন প্রয়াত সন্তোষমোহন দেবের কন্যা সুস্মিতা দেবকে। অসমের সুস্মিতাকে বাংলা থেকে রাজ্যসভায় পাঠানো হয়েছে বাংলার তৃণমূল নেতাদের বঞ্চিত করে। ভোটে হেরে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় নাকেখত মেরে তৃণমূলে ফিরে এলে অভিষেক রাজীবকে ঘাড়ে ধরে আগরতলায় পোস্টিং দিয়ে দেন। বেচারা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আদাজল খেয়ে ত্রিপুরাতেই পড়েছিলেন। অভিষেক নিজে একটা সময় দমদম-সিঙারবিল উড়ানে নিত্যযাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। অভিষেকের নির্দেশে বাংলা থেকে গুচ্ছের নেতানেত্রী, অভিনেত্রী দল বেঁধে আগরতলা যাতায়াত করেছেন। দামি হোটেলে থেকে ভালমন্দ খানাপিনা সেরে দামি গাড়িতে চেপে ত্রিপুরা রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। অন্য দল ভাঙিয়ে নেতা আমদানি। বিধায়ক ক্রয় সব‌ই হয়েছে। বাংলা থেকে তৃণমূলের আয় এখন ভাল‌ই। কাজেই ত্রিপুরায় দেদার ব্যয় করতে অভিষেকের বাধে নি। কিন্তু এত খরচাপাতির পরেও পৌনে দুই বছরে ত্রিপুরায় দলের সংগঠন মজবুত অথবা মমতার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি- দুটির একটি করতেও সফল হন নি তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড।

ত্রিপুরায় তৃণমূলের প্রচারে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও সাংসদ তথা অভিনেত্রী নুসরাত জাহান। ফটো- সংগৃহীত

অভিষেকের নেতৃত্বে ত্রিপুরায় তৃণমূলের তৎপরতা দেখে একটা সময় রাজনৈতিক মহলের মনে হয়েছিল, উত্তরপূর্বাঞ্চলের বাঙালি অধ্যুষিত এই রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের উত্থান অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবে অন্য কিছু ঘটল। ভোট আসার আগেই হালে পানি না পেয়ে কার্যত রণেভঙ্গ দিলেন অভিষেক। গোয়ায় তবু ভোট পর্যন্ত হম্বিতম্বি চালিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু বাঙালি প্রধান ত্রিপুরায় মনোনয়ন পর্বেই আগরতলা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে শিলং নিয়ে মেতে ওঠেন তিনি। ৬০ সদস্যের বিধানসভায় মাত্র ২৮টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার পর ভোট কাটুয়ার ‘রোল প্লে’ করা ছাড়া তৃণমূলের আর কিছুই করণীয় ছিল না ত্রিপুরায়। কিন্তু প্রচারে জলের মতো টাকা ঢেলেও ঘাসফুলের ভোট জুটেছে নোটার থেকেও ঢের কম। ০.৯ শতাংশ ভোট পাওয়া একটি দলের রাজ্য দফতরের দরজা খোলার লোক পাওয়া যাবে তো?

সাগরদিঘিতেও সফল নন সেকেন্ড ইন কমান্ড

গোয়া, ত্রিপুরায় ব্যর্থতার পর অভিষেকের পাইপলাইনে আর কোনও রাজ্য আছে কিনা জানা যায় নি। বাস্তববাদী মমতা হয়তো এবার বহির্বঙ্গে অযথা সময় ও টাকা নষ্ট না করে ভাইপোকে বাংলায় মন দিতে বলতে পারেন। তবে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূলের শোচনীয় পরাজয়ের পর বাংলাতেও কি অভিষেকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না? সাগরদিঘি উপনির্বাচনের প্রচারে মমতা সময় দেন নি। সাগরদিঘিতে তৃণমূলের ভোট বৈতরণী উতরানোর সব দায়িত্ব ছিল দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের উপরে। ৬৮ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের বিধানসভা সাগরদিঘিতে তৃণমূল শুধু পরাস্ত‌ই হয় নি ১৬ শতাংশ ভোট হাতছাড়া করেছে। বাংলার বাইরে অভিষেকের দৌড় তো বোঝা গেল। বাংলাতে অভিষেক একার কাঁধে দলকে পার করতে সক্ষম- এই প্রমাণ‌ও কিন্তু এই যাত্রায় পাওয়া গেল না।

Feature photo is representational. Photo Credit- ANI.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *