চিন কেন ওমিক্রন বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ? চিনে প্রস্তুত করোনা টিকার কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে।
ডেস্ক রিপোর্ট: কোভিডের উৎপত্তি চিনে। পৃথিবীর প্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয় উনিশের ডিসেম্বরে চিনের উহান শহরে। দেশকে কোভিড শূন্য করতে শি জিনপিংয়ের সরকার প্রথম থেকেই বজ্র আঁটুনি দিলেও তা কার্যত ফস্কা গেরোয় পরিণত হয়েছে বলে সন্দেহ করতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক মহল। সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এই তিন বছরের মধ্যে দেশকে একদিনের জন্যও সংক্রমণ শূন্য করতে ব্যর্থ চিন সরকার। উল্টে করোনা ভাইরাসের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট বা উপরূপের দাপটে চিনে এখন ঝড়ের গতিতে নতুন করে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চিনকে নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
তথ্য গোপন না করতে চিনকে পরামর্শ হু’র
রাজনৈতিক অসন্তোষ হোক আর করোনা সংক্রমণ- তথ্য গোপনে বেজিংয়ের জুড়ি নেই। করোনা নিয়েও চিন বহু তথ্য চেপে যাওয়ায় বিশ্ববাসীকে তার চড়া খেসারত দিতে হয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিযোগ। তাই করোনার নতুন উপরূপ ওমিক্রন বিএফ.৭- এর জেরে চিন জুড়ে ফের সংক্রমণের ঢেউ উঠতেই বেজিংকে সতর্ক করলেন হু-র প্রধান টেড্রস অ্যাডানম গেব্রিয়েসাস। হু প্রধান বলেন, ” আশা করছি এই বার অন্ততঃ চিন সরকার সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য লুকোবে না এবং আমাদের সুপারিশগুলি পর্যালোচনা করে দেখবে।” শি জিনপিংয়ের সরকারের প্রতি এই অবিশ্বাস কেন অমূলক নয়, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন হু প্রধান। কোভিড ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত চিন থেকে পর্যাপ্ত তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের হাতে আসে নি বলে জানিয়েছেন টেড্রস। চিনের কাছে করোনা সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে যা পাওয়া গেছে, তাতে সন্তুষ্ট নয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংক্রমণের কারণ অনুসন্ধানে হুর বিশেষজ্ঞ দল চিনে গেলেও শি জিনপিংয়ের সরকার তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় নি বলে অভিযোগ।
পর পর তিন ঢেউয়ের সামনে চিন
অনেক ভাইরাস বিশেষজ্ঞ এমনও অনুমান করেছেন, উহানে চিন সরকারের গবেষণাগার থেকেই কোভিডের সূত্রপাত। এই অভিযোগ চিন জোরেশোরে অস্বীকার করলেও ঠিক কী কারণে এবং কোথা থেকে নোভেল করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি তার কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত দিতে ব্যর্থ বেজিং। এদিকে চলতি শীত মরশুমেই নাকি ওমিক্রন বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টের কারণে পর পর তিনটি মারাত্মক ঢেউয়ের সম্মুখীন হবে চিন। মহামারীবিশেষজ্ঞ ও ‘চাইনিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর প্রধান হু জুনইউ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সংক্রমণের যে ঢেউ উঠেছে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত তা চলবে। দ্বিতীয় ঢেউ উঠবে জানুয়ারির ২১ তারিখ, চিনা চান্দ্র নববর্ষ উদযাপনের সময়। তৃতীয় ঢেউ শুরু হবে ফেব্রুয়ারির শেষে এবং তা মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলবে বলে মনে করেন হু জুনইউ।
১০ লক্ষ চিনার মৃত্যু হতে পারে
যখন কোভিড ভীতি সামলে উঠে গোটা পৃথিবীই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে চলেছে তখন চিন থেকে উৎসারিত ওমিক্রন বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টের কারণে কি আবার আমাদের কড়া বিধিনিষেধের কবলে পড়তে হবে? করোনার নতুন উপ প্রজাতি আগের প্রজাতিগুলির তুলনায় কতটা বেশি বা কম সংক্রমক কিম্বা মৃত্যুহার কম না বেশি- এই সব তথ্য জানতে উদগ্রীব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। শোনা যাচ্ছে, চিনের হাসপাতালগুলি করোনা রোগীতে উপচে পড়ছে। আইসিইউতে শয্যা ফাঁকা নেই। কিন্তু পরিসংখ্যান ও মৃত্যু নিয়ে সরকার তথ্য গোপন করছে কিনা, এই সংশয় থেকে মুক্ত হতে পারছে না হু। চিন সরকার বড় সংখ্যায় মৃত্যুর কথা অস্বীকার করলেও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ, বেজিং প্রশাসন মৃত্যুর সংখ্যা চেপে যাচ্ছে। বিএফ.৭-এর ধাক্কায় চিন বেসামাল বলেই খবর মিলছে। সংক্রমণের যে তীব্রতা, তাতে বহু লোকের মৃত্যুর আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারছেন না এপিডেমিওলজিস্টরা। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, তৃতীয় ঢেউ পর্যন্ত দশ লক্ষেরও বেশি চিনা নাগরিক কোভিডে মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে।
চিনা টিকার মান নিয়েই প্রশ্ন
বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্ট নতুন করে চিনকে ত্রস্ত করে তুলেছে। বাকি পৃথিবীর কাছেও এই ভ্যারিয়েন্ট নতুন নয়। কিন্তু কোথাও এখনও পর্যন্ত চিনের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয় নি। গত অক্টোবরে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিতে ওমিক্রন বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ পাওয়া গেলেও তা আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি। আমেরিকায় মোট কোভিড সংক্রমিতের মাত্র পাঁচ শতাংশের দেহে মিলেছিল বিএফ.৭ ভ্যারিয়েন্ট। ব্রিটেনে ৭.২৬ শতাংশ। যেই ভ্যারিয়েন্ট পৃথিবীর বাকি দেশগুলি সামলে দিতে পারল চিন কেন তা পারল না? এই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। চিনে প্রস্তুত টিকার কি প্রতিরোধ সক্ষমতাই কম? তাই লকডাউন একটু শিথিল হওয়া মাত্রই ঝড়ের বেগে সংক্রমিত হচ্ছে চিনের মানুষ? কারও মতে আবার কড়া বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে থাকতে থাকতে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ারই সুযোগ পান নি চিনের নাগরিকেরা। তাই কোভিড বিধি আলগা হওয়ার মাত্রই দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরা। চিন থেকে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া করোনা অতিমারিতে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের প্রাণ গিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ কোটির উপরে। লকডাউনের জেরে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী জুড়ে স্বাভাবিক জনজীবন। বাইশের মাঝামাঝি থেকেই কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে ছন্দে ফিরতে শুরু করে মানুষের জীবন। গণটিকাকরণের হাত ধরেই দেশে দেশে সংক্রমণের গতিতে লাগাম টানা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
চিন থেকে কি আবার কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীতে? আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক মহল। তাই সতর্ক হু। চিন সংক্রমণে বিপর্যস্ত- এই সংবাদ কানে আসা মাত্রই বুধবার দিল্লিতে জরুরি বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মান্ডবীয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এখনও পর্যন্ত ভারতে ওড়িশা ও গুজরাট থেকে মোট পাঁচজনের দেহে ওমিক্রন বিএফ.৭ উপরূপের খোঁজ মিলেছে। পাঁচজনই উপসর্গবিহীন বলে জানা গেছে। তবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে দ্রুত মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাস আরও শক্তি সঞ্চয় করলে ফের মৃত্যু হার ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে বলে চিকিৎসকদের আশঙ্কা। ভারতে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষের ডবল ডোজ টিকাকরণ সম্পূর্ণ। যদিও বুস্টার টিকা নিয়েছেন মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ। বুস্টার টিকার সংখ্যা বাড়িয়েই করোনার নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্টের মোকাবিলা করতে চাইছে সরকার।
Feature Image Credit- Brenda Goh/ Reuters.