প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর প্রতি ব্রাজিলের মানুষের ক্ষোভ এতটাই বেশি ছিল যে জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা লুলা যখন ফের রাস্তায় নামলেন, তখন দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বাছাই করার কাজটা তাদের জন্য বেশ সহজ হয়ে দাঁড়ায়।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দ্বিতীয় বারের জন্য জাইর মেসিয়াস বোলসোনারোর ব্রাসিলিয়ার প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে ফেরা হল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর থেকে কোনও রাষ্ট্রপ্রধানকেই প্রথম দফার শেষে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে প্রাসাদ থেকে নামায় নি ব্রাজিলের জনগণ। কিন্তু বোলসোনারো সেই হতভাগ্য রাষ্ট্রপতি, ভোটে হেরে এক দফাতেই যার চাকরি গেল। বছর শেষ হওয়ার আগেই জাইর বোলসোনারোকে তল্পিতল্পা নিয়ে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ থেকে সরে পড়তে হবে। কেন না, পয়লা জানুয়ারি ব্রাজিলের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ৭৭ বছরের বামপন্থী লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা।
লুলার নাটকীয় প্রত্যাবর্তন!
২০০৩ থেকে ১০-দুই দফায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন বামপন্থী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা লুলা ডা সিলভা। ব্রাজিলের রাজনীতিতে প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার সুবাদে ২০০৩-এই ইতিহাসে নিজের নাম তুলে ফেলেন লুলা। প্রকৃতির অকৃপণ দানে পরিপূর্ণ ব্রাজিলে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বীভৎস। আট বছরের শাসনে দরিদ্রদের জন্য কল্যাণমূলক পদক্ষেপ ও ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে বৈষম্য খানিকটা লাঘব করেছিলেন লুলা। ব্রাজিলের রাজনীতিতে লুলা ডা সিলভার জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু তাঁর শাসনামল একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ। ২০১৮-র এপ্রিলে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর ৫৮০ দিন জেলে থাকতে হয়েছিল লুলাকে। যদিও পরে লুলার বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েই বড়সড় প্রশ্ন ওঠে, মামলা সুপ্রিম ফেডেরাল কোর্টে গেলে শেষ পর্যন্ত কলঙ্কমুক্ত হন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। ফেডেরাল কোর্ট লুলা ডা সিলভাকে সাড়ে নয় বছরের কারাদন্ড দিলেও সুপ্রিম ফেডেরাল কোর্টের নির্দেশে ২০১৯-এর নভেম্বরে মুক্তি পান লুলা। জনপ্রিয় এই বামপন্থী নেতার ভোটে দাঁড়ানোর অধিকারও কেড়ে নিয়েছিল আদালত। ফলে, আঠারোর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেল থেকে লড়তে চেয়েও ব্যর্থ হন তিনি। একুশের এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার ফিরিয়ে দিতেই পরবর্তী নির্বাচনে বোলসোনারোকে হারাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন লুলা ডা সিলভা। সেই হিসেবে দেখলে ৭৭ বছরের বামপন্থী নেতার রাজনীতির লড়াইয়ের রিংয়ে প্রত্যাবর্তনকে নাটকীয় বললেও কম বলা হয়।
নিজের ফেরার রাস্তা নিজেই বন্ধ করেছেন বোলসোনারো
২০১৮-র নির্বাচনের রান-অফ পর্বে ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ব্রাজিলের ৩৮ তম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন জাইর বোলসোনারো। মাত্র চার বছরেই বোলসোনারোর জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামার কারণ কী? ব্রাজিলের রাজনৈতিক মহল মনে করছে, অতি দক্ষিণপন্থা ও সরকার পরিচালনায় একবগ্গা নীতিই বোলসোনারোর উপর জনগণের বিরক্তির অন্যতম কারণ। কোভিড অতিমারির সময় বোলসোনারোর বেপরোয়া চালচলন আন্তর্জাতিক মহলেও ধিকৃত হয়। অতিমারি যখন শীর্ষে, লকডাউনে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখনও দেশের দরিদ্রদের দুঃখ-দুর্দশা প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোকে কাতর করে নি। তিনি ব্যস্ত ছিলেন কর্পোরেট লবি ও ব্রাজিলের সম্পন্ন কৃষকদের মন জোগাতে। গোটা মেয়াদটাই পরিবেশ ইস্যুতে হাসিঠাট্টা করে কাটিয়ে দিয়েছেন এই প্রাক্তন সামরিক আধিকারিক। আমাজনের রেইন ফরেস্ট শুধু ব্রাজিলের নয় গোটা পৃথিবীর সম্পদ। কোনও রাখঢাক না করেই ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে খ্যাত আমাজনের বন উজাড়ে মদত দিয়েছেন বোলসোনারো।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/11/IMG-20221101-WA0006.jpg)
পরিসংখ্যান বলছে, বোলসোনারোর জামানায় তিন কোটির বেশি ব্রাজিলবাসী পেটভরে খেতে পায় না। দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি। এই পরিস্থিতিতে ২০২০ থেকেই প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর প্রতি মানুষের ক্ষোভ বাড়ছিল। আইনি জটিলতা কাটিয়ে লুলা ডা সিলভার ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার রাস্তা যখন নিষ্কন্টক হয়ে গেল, তখনই সবাই ধরে নিয়েছিল পরের ভোটে উতরানো বোলসোনারোর জন্য মোটেই সহজ হবে না। একটা বিষয় খুব পরিস্কার যে, নিজের ফেরার রাস্তা নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন কট্টর দক্ষিণপন্থী বোলসোনারো। প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর প্রতি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ক্ষোভ এতটাই বেশি ছিল যে জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা লুলা যখন ফের রাস্তায় নামলেন তখন দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বাছাই করার কাজটা ব্রাজিলবাসীর জন্য বেশ সহজ হয়ে দাঁড়ায়।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/11/IMG-20221101-WA0013.jpg)
ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রথম দফার ভোট হয়েছিল গত ২ অক্টোবর। প্রথম দফায় লুলা পেয়েছিলেন ৪৮.৩ শতাংশ ভোট। বোলসোনারোর জুটেছিল ৪৩.৬ শতাংশ। প্রথম দফায় কেউই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় রান-অফ ইলেকশন অবধারিত হয়ে পড়ে। ৩০ অক্টোবরের রান-অফ ইলেকশনে লুলা ডা সিলভা পেয়েছেন ৫০.৯ শতাংশ ভোট। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো পেয়েছেন ৪৯.১ শতাংশ ভোট। চূড়ান্ত রাউন্ডে অপ্রত্যাশিত ভাবে নিজের ভোট অনেকটাই বাড়িয়ে নিতে পারলেও এই যাত্রায় ক্ষমতায় ফেরা আর হল না বোলসোনারোর।
অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লুলা, রাখতে পারবেন তো?
বামপন্থী লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভার আট বছর দেশ শাসন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তদুপরি তাঁকে ব্রাজিলের ইতিহাসে সবথেকে জনপ্রিয় নেতা বলা হয়। অনেক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে এই ক্যারিশ্মাটিক বামপন্থী নেতা যখন প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে ফিরে এলেন, তখন তিনি ৭৭ বছরের বৃদ্ধ। তবে লুলার জীবনযাত্রায় বয়সের ছাপ পড়ে নি। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পরেই তিনি পথে পথে। গোটা দেশ চষে বেড়িয়েছেন ভোটের প্রচারে। অভিজ্ঞ লুলা ভালোই জানেন, ভোটে জেতার থেকে অনেক বেশি কঠিন ২১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের দেশ ব্রাজিলে সুশাসন কায়েম করা। বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম ভাষণেই লুলা বলেছেন- সবার আগে দরিদ্রদের ভাগ্য ফেরাতে চান তিনি। ভোট প্রচারে দেদার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লুলা। এখন জনগণ চাইবে, প্রতিশ্রুতিগুলি কার্যকর হোক। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর না হলে কিম্বা সুলভ মূল্যে খাদ্যদ্রব্য দরিদ্রদের হাতে তুলে না দিতে পারলে তাঁর জনপ্রিয়তাও যে দ্রুত কমতে থাকবে তা জানেন লুলা।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/11/IMG-20221101-WA0009.jpg)
আমাজনের জঙ্গল সাফ করে কৃষিজমি বাড়িয়েছেন প্রেসিডেন্ট জাইর মেসিয়াস বোলসোনারো। পরিবেশবাদীদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সেই জমি তুলে দেওয়া হয়েছে ধনী কৃষকদের হাতে। আমাজনের জঙ্গল ও সেখানকার আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন লুলা ডা সিলভা। ব্রাজিলের প্রভাবশালী ধনী কৃষকদের চাপ অগ্রাহ্য করে আমাজনকে রক্ষা করার কাজটা লুলার জন্য যথেষ্টই চ্যালেঞ্জের হবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
Photo credit- Verified FB page of Lula da Silva and Bolsonaro.