তৃণমূলের অন্য রাজ্যে জমি পাওয়ার চেষ্টা বারে বারেই ব্যর্থ হয়েছে। মুকুল রায় ত্রিপুরায় পারেন নি। পিকে-অভিষেকের গোয়া প্রোজেক্ট তো পুরোই ফ্লপ।লিখলেন উত্তম দেব-
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সাফল্যটা ছিল নিঃসন্দেহে চোখ ধাঁধানো। মমতা মুখে কখনোই স্বীকার করবেন না কিন্তু বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নবান্নে কামব্যাক তৃণমূল সুপ্রিমোর কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল। সেই অপ্রত্যাশিত সাফল্যের জোশে মমতা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু নামে নয় কাজেও দলকে সর্বভারতীয় পরিচিতি দেওয়ার। তদুপরি পিকে এই ব্যাপারে মমতাকে তাতাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেন নি। রাজনৈতিক নেতা মাত্রেই ধুরন্ধর। আর পিকে এই ধুরন্ধরদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খান। তাহলে আইপ্যাকের বিহারী মালিক কতটা ধূর্ত হতে পারেন তা সহজেই অনুমান করা চলে। পিকে বেশ ভালোই জানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেত্রী। তিনি নবীন পট্টনায়েকের মতো রাজ্য নিয়েই তুষ্ট নন। জাতীয় রাজনীতিতেও পাঙ্গা নিতে উদগ্রীব। তৃণমূলের অন্দরে পিকের সবথেকে খাতিরের লোক অন্য কেউ নন অভিষেক। মমতা উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিন্তু তিনি বিচক্ষণ-কোন মাটিতে কতটুকু ফসল ফলতে পারে তা আগাম বুঝতে পারেন। অভিষেক ব্যানার্জি রাজনীতিতে দু’দিনের বৈরাগী, উপর থেকে বসিয়ে দেওয়া নেতা। পিসির দূরদর্শিতা আসতে তাঁর এখনও ঢের দেরি। দোসরা মের পর কাঁচাবুদ্ধির অভিষেককে স্বপ্নের সওদাগর বানাতে বেশি বেগ পেতে হল না আইপ্যাক কর্ণধারের। তৃণমূলের ভারত বিজয় অভিযানের পরিকল্পনা সহজেই অভিষেকের মাথায় গেঁথে দিলেন প্রশান্ত কিশোর। এরপর রাতারাতি দলকে কোচি থেকে রাঁচি বিখ্যাত করতে উঠেপড়ে লাগলেন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড।
দেখা গেল ভারত বিজয় অভিযানে নেমে তৃণমূলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দাঁড়াল ইধার-উধার খুচখাচ বিধায়ক ভাঙিয়ে কংগ্রেসের শক্তি হ্রাস করা আর যশোয়ান্ত সিনহা ও লুইজিনহো ফেলেইরোর মতো বানপ্রস্থ থেকে ফিরে আসা নেতাদের পদ দিয়ে পুনর্বাসিত করা। ভাড়াটে লোকদের দিয়ে চেন্নাই-তিরুবনন্তপুরমের কয়েকটি দেওয়ালে জোড়াফুল আর মমতার ছবিও আঁকালেন পিকে। সেই সব দেখে বাংলার মিডিয়া ফুকরিয়া উঠল – এই দ্যাখো দাক্ষিণাত্য দিদির দখলে এলো বলে। তৃণমূলের নেতারা দাবি করতে লাগলেন- মমতাই বিজেপি বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ও মোদীর বিকল্প মুখ।
১৪ থেকেই দলের আঞ্চলিক পরিচয় ঘোঁচাতে মরীয়া মমতা
জন্মলগ্নে একটি আঞ্চলিক দল হিসেবেই নির্বাচন কমিশনে তৃণমূলের নাম নথিভুক্ত হয়েছিল। এগারোতে আঞ্চলিক দল হিসেবেই কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। ২০১৪ থেকেই দলের আঞ্চলিক পরিচয় খন্ডাতে মরীয়া হয়ে ওঠেন মমতা। এক সময় অন্যান্য প্রদেশে তৃণমূলের সংগঠনে বিস্তারের দেখভাল করতেন মুকুল রায়। যদিও এই কাজে কখনোই সাফল্য পান নি মুকুল। দল ভাঙানোয় মুকুল রায়ের পারদর্শীতা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলার বাইরে বাঙালি অধ্যুষিত ত্রিপুরায় মুকুল রায়ের হাতযশে কংগ্রেসকে ভাঙিয়ে তৃণমূল প্রাথমিক সাফল্য পেলেও তা ধরে রাখতে পারে নি। বরং তৃণমূল ও কংগ্রেস- উভয়ের ঘর তছনছ করে দিয়ে দ্রুততম সময়ে ত্রিপুরায় অভাবনীয় সাফল্য পায় বিজেপি। প্রশান্ত কিশোর দলের ভোট বৈতরণী পারের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ঝাড়খণ্ড, অসম সহ কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনে বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয় তৃণমূল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির একটি কেন্দ্রে জোড়াফুল প্রতীকে দাঁড়িয়ে মাত্র ৯০৯টি ভোট পেয়ে জামানত খোয়ান রূপোলী পর্দার নায়ক বিশ্বজিৎ।
নির্বাচন কমিশনের খাতায় জাতীয় দল হিসেবে নাম তোলার শর্তগুলি খুব কঠিন নয়। শর্তপূরণ সাপেক্ষে ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে জাতীয় দলের মর্যাদা পায় অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস। খাতায়-কলমে জাতীয় দলের স্বীকৃতি মিললেও তাতে সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতায় বাস্তবিক কোনও অগ্রগতি ঘটে নি। উনিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশের আঞ্চলিক দলগুলির মুখ হওয়ার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একাধিক রাজ্য আঞ্চলিক দল ক্ষমতায় কিন্তু দলগুলির নেতাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ভিন্ন ভিন্ন। মমতার কথায় তাঁরা মাথা নাড়াবেন কেন? উনিশের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে একুশের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত সময়টা ছিল মমতার অস্তিত্ব রক্ষার পর্ব। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে চমকদার বিজয় লাভের পর খুব সঙ্গত কারণেই তৃণমূল সুপ্রিমোর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সেই আত্মবিশ্বাসে বাড়তি অক্সিজেন জোগায় পিকে-অভিষেকের ভোকাল টনিক। চব্বিশে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটা টার্গেট এই প্রথম সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ত্রিপুরা, মেঘালয়, মণিপুর, অসম অরুণাচল প্রদেশ এবং গোয়া – এইসব রাজ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন তৃণমূলের নেতারা। কলকাতার মিডিয়া পোঁ ধরে। গত জুন-জুলাই থেকে একেবারে হইহই-রইরই কান্ড।
তৃণমূলের গোয়া অভিযানে একমাত্র লাভবান লুইজিনহো ফেলেইরো
মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যদ্বাণী ছুঁড়তে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের জুড়ি নেই। গত ২৫ অক্টোবর দিনহাটায় উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়ে অভিষেক ঠিক কী বলেছিলেন একটু দেখে নিই- “আমরা ত্রিপুরায় গিয়েছি। গোয়াতেও ঢুকেছি। আরও ৫-৭টা রাজ্যে যাব। এটা কী মাস? অক্টোবর। সামনে নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি। হাতে তিন মাস সময় আছে। গোয়ায় বিধানসভা আসন ৪০টি। দল আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। তিন মাসে গোয়ায় জোড়াফুল ফুটবে। ওখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। আপনারা লিখে নিন। এর পর ত্রিপুরা, মেঘালয়, অসম এবং উত্তরপ্রদেশ-সহ একাধিক রাজ্যেও আমরা যাব। তার কারণ বাংলা পথ দেখিয়েছে। দেশকে পথ দেখাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
অভিষেকের এই হৈমন্তিক বজ্র নির্ঘোষের চারমাস তেরো দিন পর দেখা গেল চল্লিশ সদস্যের গোয়া বিধানসভায় ২৬টি আসনে লড়াই করে জোড়াফুল শিবিরের আসন শূন্য! দেশের ক্ষুদ্রতম রাজ্যের নির্বাচনে অকাতরে টাকা উড়িয়ে তৃণমূলের প্রাপ্তি সাকুল্যে ৫.২১ শতাংশ ভোট। গোয়ার প্রাচীনতম আঞ্চলিক দল মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টির( MGP) সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলে এইটুকুও যে জুটতো না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মমতার জহুরীর চোখ- গোয়া নিয়ে প্রথম দিকে খানিকটা উৎসাহ থাকলেও দু’একবার পানাজি ট্যুর করতেই তৃণমূল সুপ্রিমো বুঝে যান লস্ট কেস। মমতা এও বোঝেন,ভাইপো আর পিকে মিলে তাঁকে ভুল বুঝিয়েছে। অভিষেকের ঘাড়ে গোয়ার দায়িত্ব ঠেলে দিয়ে নিজে হাত গুটিয়ে নেন ভোটের বহু আগেই। ১০ মার্চ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর একটা বিষয় পরিস্কার-জাতীয় পরিসরে রাতারাতি বড় জায়গা নেওয়া তৃণমূলের জন্য মোটেই জলবৎ তরলং নয়। দিনের শেষে তৃণমূলের গোয়া অভিযানে সবথেকে বেশি লাভ যদি কারও হয়ে থাকে তবে তা লুইজিনহো ফেলেইরোর। বাংলার তৃণমূল গোয়ায় কিস্যু না করতে পারলেও তৃণমূলের বাঙালি বিধায়কদের দৌলতে ফোকটেই সংসদের উচ্চকক্ষে ঢুকে পড়লেন গোয়ানিজ বৃদ্ধ,যা ছিল তাঁর স্বপ্নেরও অতীত!
মমতাকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন কেজরিওয়াল
পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল আরও একটা বিষয় স্পষ্ট করল- আঞ্চলিক গন্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় পরিসরে নিজেদের শক্তি বিস্তারে তৃণমূলের থেকে অনেক বেশি সফল আম আদমি পার্টি। বয়স দশ পূর্ণ করার আগেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ দেশের দুটো রাজ্যে ( দিল্লি যদিও আইনতঃ কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বা উপরাজ্য ) ক্ষমতায়। ক্ষিপ্রতা, ক্যারিশ্মা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা- কোনওটাতেই ধারেভারে মমতার সমকক্ষ নন কেজরিওয়াল। বয়সেও অনেক ছোট। কিন্তু তারপরেও যাকে বলে স্লোলি বাট স্টেডিলি নিজের দলকে দিল্লির গন্ডি ছাড়িয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে দিতে মমতার থেকে অনেক বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। চব্বিশে মোদীর বিকল্প মুখ কে হবেন, এ নিয়ে একটা টানাপোড়েন চলছে। মমতা এই জায়গাটা নিতে চান, বিশেষ করে বিপুল সংখ্যাধিক্যে নবান্নে প্রত্যাবর্তনের পর তৃণমূল সুপ্রিমোর এই আকাঙ্ক্ষাটা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু পঞ্চনদের দেশে আপের বিরাট সাফল্যের পর কেজরিওয়ালও নাকি মোদীর বিকল্প মুখের অন্যতম দাবিদার হয়ে উঠেছেন।
কেজরিওয়াল মোদীর বিকল্প মুখ হয়ে গেলে মমতার কী হবে? মমতা বিকল্প হলে কেজরিওয়ালের কী হবে? পাঁচ রাজ্যে শোচনীয় বিপর্যয়ের পর হয়তো রাহুল গান্ধীর নিজেরই আর মোদীর বিকল্প হওয়ার মতো আত্মবিশ্বাস নেই। শুধু তো পাঁচ রাজ্য নয় রাহুলের ব্যর্থতা উপর্যুপরি। রাহুল গান্ধী নিজের ক্যারিশ্মায় কবে দলকে বড় কিছু পাইয়ে দিয়েছেন কংগ্রেসের লোকেরাই তা মনে করতে পারে না। জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তাকে টক্কর দেওয়ার মতো কোনও বিরোধী নেতা নেই- বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের জন্য এর চেয়ে স্বস্তির খবর আর কী হতে পারে।
এখন নিজের রাজ্যেই ব্যতিব্যস্ত মমতা
অক্টোবরে অভিষেক হুঙ্কার দিয়েছিলেন- গোয়া বিজয়ের পর একে একে ত্রিপুরা, মেঘালয়, অসম এবং উত্তরপ্রদেশেও আমরা বিজয় কেতন ওড়াবো। গোয়ায় গোল্লা পাওয়ার পরেও কি তৃণমূলের এই আত্মবিশ্বাস আছে? সবথেকে বড় কথা এই বজ্র নিনাদ যাঁর কন্ঠ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল দলের ভেতরে তাঁর নিজের আত্মবিশ্বাসই টলে গেছে বলে সম্প্রতি সন্দেহ করছে রাজনৈতিক মহল। একুশের জুন-জুলাইয়ে মমতাকে বিরোধীদের মুখ বানানোর জন্য তৃণমূলের মধ্যে যে ছটফটানি লক্ষ্য করা গিয়েছিল বাইশের মার্চে কি তা লক্ষ্য করা গেছে? বরং ২১ মার্চ রাতে রামপুরহাটের বগটুইয়ে ৯জন সংখ্যালঘু নারী ও শিশুকে পুড়িয়ে মারার ঘটনার পর থেকে নিজের রাজ্য নিয়েই ব্যতিব্যস্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থান তলানিতে। শিক্ষিত বেকার ঘরে ঘরে। দুর্নীতির অভিযোগে মামলার জেরে একের পর এক সরকারি নিয়োগ বাতিল। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। ফেব্রুয়ারি-মার্চে এসে যেন তা চরম আকার ধারণ করল। তোলাবাজির বখরা নিয়ে জায়গায় জায়গায় শাসকদলের মধ্যেই মারামারি। হাওড়ার আমতায় নিজের বাড়িতে ছাত্রনেতা আনিস খানের রহস্য মৃত্যু। এক সন্ধ্যায় দুই কাউন্সিলর খুন। এরপর রামপুরহাটে নৃশংস গণহত্যা। গরু পাচার, সোনা পাচার ও কয়লা ঘোটালা নিয়ে তো সিবিআই-ইডি চলছেই তার উপর রামপুরহাট কান্ডেও আদালতের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছে। ভূমিধ্বস বিজয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসার বছর পূর্তি হওয়ার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখার মতো একাধিক বাণ কেন্দ্রের তূণে চলে এসেছে। দিল্লির দিকে তাকানোর ফুরসৎ দিদিকে আর দেবেন কি মোদী?
Feature Image is representational. Photo credit- official FB page of Mamata Banerjee, Arvind Kejriwal and Luizinho Faleiro.