তৃণমূলের সুখের সংসারে অশান্তির আগুন ! অভিষেককে কেন্দ্র করে দলে ডামাডোল। অভিষেক কি তৃণমূলের দ্বিতীয় ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছেন? ঘটনাক্রম দেখে রাজনৈতিক মহলের অনুমান ঠোকাঠুকি লেগেছে মমতা-অভিষেকেও। পরিবার কেন্দ্রিক,ব্যক্তি কেন্দ্রিক দলে নেতৃত্বের প্রশ্নে এমন পরিস্থিতি নতুন নয়। লিখলেন উত্তম দেব –
পরিবার বা ব্যক্তি কেন্দ্রিক দলগুলিতে ক্ষমতার দুটি ভরকেন্দ্র গড়ে ওঠার ঘটনা রাজনীতিতে বিরল নয়। বাংলার শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে দুটি মেরু ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে কিনা স্পষ্ট করে বলার সময় এখনও আসে নি। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে তৃণমূলের ভেতরে নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে অনেক ব্যাপারেই মমতা আর অভিষেকে তেমন বনিবনা হচ্ছে না। একুশের ২ মে বিপুল জয়ের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পরে এত তাড়াতাড়ি তৃণমূলের সুখের সংসারে অশান্তি বাঁধবে তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। অবশ্য আমাদের প্রাজ্ঞ পূর্বজরা ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ’ বলে গেছেন কবেই। দুঃখের পর সুখ, সুখের পর দুঃখ সংসারের অনিবার্য নিয়ম। দুনিয়ার সবথেকে আশ্চর্য বস্তুর নাম ক্ষমতা। ক্ষমতার অসীম ক্ষমতা। ক্ষমতা মাটির মানুষকে দাম্ভিকে পরিণত করে। বিরোধীকে শাসকে। শাসককে বিরোধীতে। বিপ্লবীকে একনায়কে। ভাইরাসের মতোই ক্ষমতা সর্বদা নিজেকে মিউটেট করে এবং ভূতের মতোই যার ঘাড়ে ভর করে তাকে দিয়ে সাধ্য-অসাধ্য অনেক কিছুই করিয়ে নিতে পারে। ক্ষমতা খুব চঞ্চল কখনও স্থির থাকতে পারে না। ক্ষমতা শুধু মানুষকে দাম্ভিকই করে না ক্ষমতা দ্রুত মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এবং এই দ্বন্দ্ব বা বিভাজনের কারণেই ক্ষমতার মেরুকরণ রাজনীতিতে একটা স্বাভাবিক ঘটনা।
যে কোনও জীবিত ও সক্রিয় রাজনৈতিক দলের ভেতরে আন্ত:পার্টি সংগ্রাম রাজনীতিরই অঙ্গ। পার্টির ভেতরে একাধিক লবি বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকা খারাপ নয়। কোনও সুনির্দিষ্ট নীতিআদর্শ বা কর্মসূচিকে সামনে রেখে গঠিত একটি রাজনৈতিক দল যখন যোগ্য ও অভিজ্ঞদের যৌথ নেতৃত্বে চলে এবং একটা শক্তিশালী গঠনতন্ত্র দলকে এক সূত্রে বেঁধে রাখে তখন দলের ভেতরে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা জনিত দ্বন্দ্বের মীমাংসা যেভাবে হয় ব্যক্তি কেন্দ্রিক বা পরিবার কেন্দ্রিক দলে ঠিক সেভাবে হয় না। নেহেরুর জামানা তক কংগ্রেস দলীয় গঠনতন্ত্র মেনে মোটের উপর যৌথ নেতৃত্বে চলত। তাসখন্দে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আকস্মিক প্রয়াণের পর ঘটনাচক্রে ইন্দিরা গান্ধীর হাতে যখন দলেরর রাশ এসে পড়ল কংগ্রেসের রাজনৈতিক চরিত্রে স্খলনের সূত্রপাত তখন থেকেই। সমকালীন কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে ইন্দিরার ক্যারিশ্মাই ছিল সর্বাধিক। কিন্তু খুব সঙ্গত কারণেই কামরাজ, মোরারজি দেশাই, নিজলিঙ্গাপ্পা, নীলমসঞ্জীব রেড্ডি এবং অতুল্য ঘোষের মতো প্রবীণ কংগ্রেস নেতাদের পক্ষে ইন্দিরার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা সহজ ছিল না। এঁরা ছিলেন ইন্দিরার পিতার প্রজন্মের। কেউ কেউ ছিলেন নেহেরুর ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। নেহেরুর নেতৃত্ব মানতে এঁদের ইগোতে লাগত না। কিন্তু নেহেরুর কন্যা যখন আকস্মিকভাবে দল ও সরকারের প্রধান হয়ে বসলেন তখন কামরাজ, দেশাই, নিজলিঙ্গাপ্পারা দলের ভেতরে আলাদা একটা ভরকেন্দ্র তৈরি করলেন- যা অচিরেই কংগ্রেসকে প্রথমবারের মতো প্রায় আড়াআড়ি বিভাজিত করে।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/02/IMG_20220207_213717_411.jpg)
প্রবীণ নেতাদের সিন্ডিকেট কংগ্রেস নবীন ইন্দিরার জনপ্রিয়তার সামনে দাঁড়াতে পারে নি। বাহাত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পর ইন্দিরার কংগ্রেসই মূল কংগ্রেসে পরিণত হয়। ৬৯ থেকে ৭৫ ইন্দিরার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস বা কংগ্রেস ( আই) য়ে ক্ষমতার একটিই ভরকেন্দ্র ছিল- ইন্দিরা। ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেস ( আই) কংগ্রেসের মূল স্রোতে পরিণত হয়েছিল বটে কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক চরিত্র নষ্ট করে কংগ্রেসকে স্রেফ একটি পারিবারিক দলে পরিণত করার কাজটি সুসম্পন্ন হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর হাত দিয়েই। নিজের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ভেবে পুত্র সঞ্জয়কে দলের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী যে দিন দ্বিতীয় স্থানটি দিলেন সেদিনই কংগ্রেসের ( আই) ও সরকারের ভেতর ক্ষমতার দ্বিতীয় ভরকেন্দ্রটি সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী- ৭৫ থেকে ৭৭ কীভাবে কংগ্রেস দল ও ভারত সরকারের ভেতরে সঞ্জয় গান্ধীকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার একটা পৃথক ভরকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল এবং স্বয়ং ইন্দিরা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় কীভাবে তার সামনে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/02/Picsart_22-02-07_21-09-00-585.jpg)
কংগ্রেসের যে নেতারা ৬৯-এর গৃহযুদ্ধে ইন্দিরার আনুগত্য বিনা দ্বিধায় স্বীকার করেছিলেন পঁচাত্তরে ইন্দিরা পুত্রের দাপট তাঁদের অনেকের কাছেই অসহনীয় বলে মনে হল। মায়ের কাছ থেকে যখন প্রতিকার পেলেন না এবং দুর্বিনীত ছেলেকে তৈল মর্দনে যাঁদের আত্মসম্মানে লাগল তাঁরা দল ছাড়লেন। জরুরী অবস্থা কালে সরকারের একাধিক বাড়াবাড়ির পেছনে সঞ্জয় গান্ধীর হাত ছিল। এবং সঞ্জয় শুধু দলের ভেতরেই দ্বিতীয় ভরকেন্দ্র নয় রাষ্ট্রের মধ্যেও হয়ে উঠেছিলেন এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অথরিটি। অন্ধ পুত্রস্নেহই হোক বা অন্য কারণে সঞ্জয়কে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিলেন দোর্দন্ডপ্রতাপ ইন্দিরা। রাজনৈতিক ক্ষমতা যখন পরিবার কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়ায় তখন ক্ষমতার বৃত্তে এই ধরণের ট্যুইস্ট লক্ষ্য করা যায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ – বিএনপির জামানায় বাংলাদেশে অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারটা ছিল খালেদা জিয়ার। কিন্তু তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে হাওয়া ভবনে ক্ষমতার পৃথক একটা ভরকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা বা সাধ্য কোনওটাই খালেদা জিয়ার ছিল না। বিএনপির সেই জামানায় যত দুষ্কর্ম ঘটেছে তার অধিকাংশের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হয়েছিল তারেকের হাওয়া ভবনে। সেসব খালেদা জানতেন না কিন্তু ছেলের কুকর্মের ফলটা ভোগ করেছেন ষোল আনাই।
তৃণমূল কংগ্রেস দলটা উঠে-বসে-হাঁটে-দৌঁড়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। কংগ্রেসকে ভেঙে অনুগতদের নিয়ে দলটা তৈরি করেছেন মমতা নিজে। কংগ্রেস ভেঙে অনেকেই পৃথক দল গড়ে ছিলেন। কিন্তু সবাই সফল হন নি। ব্যর্থদের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও। মাথা হেঁট করে কংগ্রেসে ফিরেছিলেন প্রণব। মমতা সফলের দলে এবং ভীষণভাবেই সফল। মমতা কীভাবে দল এবং সরকার চালান তা সকলের জানা। তিনিই একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি ভোটের সময় নির্দ্ধিধায় বলতে পারেন- ২৯৪টা কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী। বাস্তবটাও তাই। বিরোধীরা তাই কটাক্ষ করে বলে-মমতার দল ও সরকারে একটাই পোস্ট বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। কিন্তু দলের তো ভবিষ্যত বলে একটা কথা আছে। ব্যাটনটা কার হাতে দেবেন মমতা ? মুলায়ম সিং যাদব, বাল থ্যাকারে, করুণানিধি নিজ নিজ ছেলের হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন। তৃণমূলের অতীত এবং বর্তমান যদি মমতা হয় তবে ভবিষ্যৎ অভিষেক, দলের ভেতরে এমন একটা বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে। দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে অভিষেকের অভিষেক ইতিমধ্যেই সম্পন্ন।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/02/Picsart_22-02-07_21-02-59-561-1024x576.jpg)
কংগ্রেসে যাঁরা নেহেরুর নেতৃত্বকে মেনে নিয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশই ইন্দিরাকে মেনে নেন নি। কারণ ইগো। আবার ৬৯-এ ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্ব যাঁরা মেনে নিয়েছিলেন তাঁরা ৭৫-এ সঞ্জয়ের আধিপত্য মেনে নেন নি। যাঁরা সঞ্জয়-ইন্দিরা উভয়ের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন পরবর্তীকালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তাঁদের বনিবনা হয় নি। এঁদের অন্যতম প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং ও প্রণব মুখোপাধ্যায়। আবার রাজীবের কাছে যাঁরা শির ঝুঁকিয়ে ছিলেন তাঁদের অনেকেই সোনিয়া-রাহুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। পরিবার কেন্দ্রিক দল যেখানে বংশ পরম্পরায় নেতৃত্ব চলে আসে সেখানে এই ধরণের ঝামেলা হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে যাঁরা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ের মতো পুরোনো, যাঁদের কেউ কেউ প্রথম থেকেই মমতার সঙ্গে ৩৪ বছরের অভিষেককে সেলাম ঠুকতে তাঁদের আত্মসম্মানে বাঁধছে। ২০১৫-য় মুকুল রায়ের সঙ্গে ঠোকাঠুকির সূত্রপাতের কারণও ছিল তাই। রাজনীতির গতিপথ এবং ক্ষমতার লীলা বড় বিচিত্র। নররক্তের স্বাদ পাওয়া শার্দূল আর ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া নেতা একই রকম বেপরোয়া। তৃণমূলের ভেতরে নিজের অনুগতদের নিয়ে পৃথক একটি বলয় তৈরি করতে এবং কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতাদের বিরোধিতার মুখে স্বাভাবিক ভাবেই বলয়টিকে আরও শক্তিশালী করতে সচেষ্ট অভিষেক।এই ধরণের পরিস্থিতিতে তৃণমূলের মতো দলে নেতার পাশে মোসাহেবের অভাব হয় না। তৃণমূলের অপেক্ষাকৃত তরুণ অংশটি ইতিমধ্যেই অভিষেকের পাশে। পুরোনোদের মধ্যে যাঁরা ঘাগু তাঁরা জলটল মেপে দেখছেন ভাইপোর দিকে কতটা ঝুঁকে থাকলে শ্যাম এবং কুল দুটোই রক্ষা পায়।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/02/Picsart_22-02-07_20-58-47-956-1024x576.jpg)
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো চান তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব ভবিষ্যতে অভিষেকের হাতেই যাক। কিন্তু অভিষেক এখনই দলের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠুক তা কি চান? সাংগঠনিক অনেক ব্যাপারেই মমতা আর মনোযোগী নন। সরকার সামলে মনোযোগ দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভবও নয়। সেই সুযোগে দলে অভিষেকের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কিন্তু এখনই ভাইপোর হাতে দলের সম্পূর্ণ রাশটা চলে যাক তেমনটি মনে হয় তৃণমূল সুপ্রিমো চাইছেন না। এই কারণেই সময় সময় পিসি-ভাইপোতে ঠোকাঠুকি লেগে যাচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশের জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এনটি রামা রাও। তেলেগু ফিল্মের উত্তমকুমার ছিলেন। তেলেগু দেশম দল গড়ে রাজনীতিতেও সফল। মমতার মতোই চমকের রাজনীতি ভালবাসতেন। জামাই চন্দ্রবাবু নাইডুকে উত্তরাধিকার ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু শ্বশুর-জামাইয়ে তাল কাটে শ্বশুর দ্বিতীয় পক্ষে তরুণী ভার্যা ঘরে আনার পর। দলের নিয়ন্ত্রণ পাছে শ্বশুরের যুবতী বউয়ের হাতে চলে যায় এই ভয়ে জামাই একদিন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়ককে কব্জা করে নিয়ে শ্বশুরকে গদি থেকে এক প্রকার ঘাড় ধরেই নামিয়ে দেন। এই শোক আর সামলাতে পারেন নি রামা রাও। অচিরেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তেলেগু রাজনীতির বর্ণময় চরিত্র। রবিবার রাজ্যের জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেলে অভিষেক এমন অনেক মন্তব্য করেছেন যা তাঁর পিসির কানে শ্রুতিমধুর লাগার কথা নয়। অভিষেক বলেছেন, ষাট-পঁয়ষট্টি কিংবা সত্তর-পঁচাত্তরের পরে আর রাজনীতি করা উচিত নয়। প্রথমে ষাট-পয়ষট্টিকে এক বন্ধনীতে রেখে তারপর সত্তর-পঁচাত্তর। এই ৫ জানুয়ারি ৬৭ বছর পূর্ণ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক কি পিসিকেই ইঙ্গিত করলেন ?
Photo Credit- Official FB page of Mamata & Abhishek Banerjee / Archives.