ডেস্ক রিপোর্ট : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে ফেসবুকে খোলা চিঠি লিখলেন তসলিমা নাসরিন । মৌলবাদীদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তসলিমা । নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা মনে করেন, বাংলাদেশকে মৌলবাদীদের খপ্পর থেকে বাঁচাতে চাইলে বাঁচাতে পারবেন এক হাসিনাই । হাসিনা ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার- এমনটাই মনে করেন তসলিমা নাসরিন। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সহিংসতার শিকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা । উপর্যুপরি হামলা হয়েছে সংখ্যালঘুদের উপর । প্রাণহানি হয়েছে বেশ কয়েকজনের । খুন ও ধর্ষিত হয়েছে দশ বছরের মেয়ে। এইসব দেখে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পরিণতি নিয়ে উদ্বিগ্ন তসলিমা । বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে আছে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ । স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর সেই বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতা, নারী ও অমুসলিম বিদ্বেষ চরমে উঠেছে। সংখ্যালঘু হিন্দুরা শেখ হাসিনাকে ভরসা করেন । কিন্তু তাঁর আমলেও নিরাপত্তাহীনতা হিন্দুদের গ্রাস করছে । আওয়ামি লিগ সরকারের আমলেসংখ্যালঘু নির্যাতনের অজস্র ঘটনার যে বিচার হয় নি তা খোলা চিঠিতে শেখ হাসিনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তসলিমা।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/10/FB_IMG_1634564637526.jpg)
বাংলাদেশের পরিস্থিতি যেই দিকে গড়াচ্ছে তাতে আগামীতে হয়তো আর কোনও নারী দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন মনে করছেন না তসলিমা নাসরিন। ” লজ্জা” উপন্যাসটি লেখার পর থেকেই বাংলাদেশের ধর্মান্ধ সংখ্যাগুরুরা তসলিমার কল্লা ফেলতে চায় । ” লজ্জা ” বইটি নিষিদ্ধ করে দেয় খালেদা জিয়ার সরকার । সংখ্যালঘু হিন্দুরা নির্যাতিত হতে হতে কীভাবে দেশ ছাড়ছে এটাই লজ্জার বিষয়বস্তু । ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতার প্রতি ভালোবাসা থাকলে শেখ হাসিনা লজ্জার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন বলেও মনে করেন তসলিমা নাসরিন। হিন্দুরা যাতে নিজেদের নাগরিক অধিকার নিয়ে শান্তিতে , নিরাপদে বাংলাদেশে বাস করতে পারে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা তা নিশ্চিত করবেন বলে বিশ্বাস করেন তসলিমা নাসরিন ।
ফেসবুকে শেখ হাসিনাকে লেখা তসলিমা নাসরিনের খোলা চিঠি –
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি।
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,
আপনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস দেশের সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের আছে। যে কোনও দুর্যোগ মোকাবিলা করতে আপনিই পারেন। দেশের এই চরম দুর্দিনে আপনি হাল ধরুন শক্ত হাতে। যে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরে বাঙলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, সেই ধর্মনিরপেক্ষতা ভেঙে গুঁড়ো করতে চাইছে কিছু বদ লোক, এই ধর্মনিরপেক্ষতাকে আবার ইস্পাতের মতো সবল এবং শক্তিশালী করতে আর কেউ নয়, আপনিই পাবেন। আমরা সকলেই জানি, অনেকের চোখের আড়ালে এক নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, যাদের অসহিষ্ণুতা, অমুসলিমবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ ধীরে ধীরে বিকট হয়ে উঠেছে। এরা হিংসের, ঘৃণার, বিদ্বেষের লাঠিসোটা আর দা’ কুড়ুল, ছুরি চাপাতি হাতে নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে প্রতিবেশিকে আঘাত করতে। একাত্তরে আমরা ভিনভাষী, ভিন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে বাস করতে পারিনি বলে বাংলা ভাষা আর বাংলা সংস্কৃতিকে ভালোবেসে পৃথক হয়েছি। আর আজ যদি বাঙালিই বাঙালিকে অসম্মান করে, তাহলে জয় হবে বাঙালি বিদ্বেষী একাত্তরের শত্রুদের। এই অসহিষ্ণু নতুন প্রজন্মকে কারা গড়ে তুলেছে, তাদের অচিরে চিহ্নিত করতে হবে, এবং অন্ধত্ব, সংকীর্ণতা, বিভাজন আর বিদ্বেষের গ্রাস থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে। তা না হলে দেশের ভবিষ্যত বড় ভয়াবহ।
দেশ জুড়ে হিন্দুদের ওপর এত বড় হামলার পর কত সহস্র হিন্দু দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হবে জানিনা। আমার আশংকা হয় একটি বড় অংশই রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাবে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে, প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে। জীবন বাঁচাতে দীর্ঘকাল ধরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। মানুষ সবার আগে চায় জীবনের নিরাপত্তা। প্রতিটি নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের ওপর ভরসা রেখেই নাগরিকেরা জীবন যাপন করে —তাদের ওপর অন্যায় যেন না হয় তা রাষ্ট্র দেখবে, নিরাপত্তার অভাব হলে রাষ্ট্র নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু অন্যায় ঘটে চলেছে, অথচ অপরাধীর বিচার হচ্ছে না। এটি মানুষ কিছুকাল মানতে পারে, চিরকাল মানবে না। তাই দেখছি সাতচল্লিশ সালের শতকরা তেত্রিশ ভাগ হিন্দু দেশ ত্যাগ করতে করতে এখন শতকরা ন’ভাগে এসে পৌচেছে। কেউ তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে মাটি ত্যাগ করে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াতে চায় না, নতুন ভূমিতে শেকড় গাড়তে চায় না। কিন্তু কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে তা করতে বাধ্য হয়, তা নিশ্চয়ই সকলেই বোঝে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা অন্য যে কোনও সরকারের চেয়ে আপনার সরকারকেই সংখ্যালঘুর সহায় বলে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান বিশ্বাস করে অন্য কোনও রাজনীতিক যদি নাও দেন নিরাপত্তা, আপনিই তাদের নিরাপত্তা দেবেন। আপনি আপনার ভাষণে বার বার বলেছেন যারা হিন্দু বাড়ি ঘরে আগুন জ্বালায় তাদের বিচারের ব্যবস্থা আপনি করবেন। যদি সত্যিই অপরাধীদের বিচার হতো, তাহলে হিন্দুরা ভিটেমাটি ছাড়তো না। আফগানিস্তানে আর পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ধীরে ধীরে শূন্য হয়ে যেতে যাচ্ছে তাদের সংখ্যালঘু সংখ্যা। এরকম যদি শূন্য হয়ে যায় বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যা, তাহলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষেরা পৃথিবীর সামনে মুখ কী করে দেখাবেন !
বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন আদর্শের বিশ্বাসের মানুষ নিয়ে যে রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বসে যাওয়া মানে গণতন্ত্র ধ্বসে যাওয়া। গণতন্ত্র ধ্বসে গেলে রাষ্ট্রের কাঠামোই ধ্বসে পড়ে। এই মুহূর্তে একটি শপথই সবাইকে করতে হবে, সেটি হলো, সংখ্যালঘুর একশ ভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিরীহ নিপীড়িত নির্যাতিত হিন্দুদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া, যেন তারা ঘর বাড়ি দোকান পাট আবার গড়ে তুলতে পারে। এবং দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে, সেটি খুব জরুরি, সেটি হলো যে মোল্লারা মাদ্রাসায় মসজিদে ওয়াজ মহফিলে হিন্দুবিদ্বেষ ছড়ায়, নারীবিদ্বেষ ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। নতুন প্রজন্মের একাংশকে পথভ্রষ্ট করার জন্য এই মোল্লাগুলোই দায়ি সবচেয়ে বেশি। আপনি ব্যবস্থা নিতে চাইলেই যে নিতে পারেন, তা দেশের অধিকাংশ মানুষই জানে। আপনি চরম শক্তিশালি মানুষ । আপনার বিরোধী দল নেই বললেই চলে। কে আপনাকে বাধা দেবে? হেফাজতি ইসলামি নামের যে গোষ্ঠীটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, তাকেও আপনি দমিয়েছেন। তাহলে হাতে গোনা কিছু ক্ষতিকারক মোল্লাকে দমন করতে পারবেন না, এ কোনও কথা নয়।
এর মধ্যে দুটো তথ্য আমাকে বড় বিচলিত করেছে। প্রথম তথ্যঃ মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, গত নয় বছরে দেশে ৩৬৭৯টি হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, এবং কারও বিচার হয়নি। দ্বিতীয় তথ্যঃ ২০১৬ সালে ঘটা নাসির নগরের ভয়ানক হিন্দু নির্যাতনের প্রধান আসামি দেওয়ান আতিকুর রহমান, আবুল হাশেম এবং আখতার মিয়াকে সামনের নির্বাচনে আওয়ামি লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন করার টিকিট দেওয়া হয়েছে। এই যদি হয় বিচারের হাল, তাহলে মানুষ তো নিশ্চয়ই বিচার ব্যবস্থার ওপর থেকে বিশ্বাস হারাবে! মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন, নাসিরনগরের হিন্দু বাড়িঘরে যারা আগুন লাগিয়েছে, শত শত হিন্দুকে যারা সর্বহারা করেছে, তাদের নির্বাচন করার যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেটি বাতিল করুন এবং এই অপরাধীদের দল থেকে বিদেয় করুন। এই কাজটি আপনি নিশ্চয়ই চাইলেই করতে পারেন।
মানুষের সবসময় সুসময় থাকে না। আপনার সবচেয়ে বেশি সুসময় এখন। দেশকে উন্নয়নের পথে অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছেন, অর্থনৈতিক ভাবে দেশ এখন আগের চেয়ে বেশি উন্নত। এমন সময় জিহাদি আদর্শ ছড়িয়ে যারা বাংলার যুবসমাজকে নষ্ট করতে চাইছে, তাদের প্রতিহত করুন। যারা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে বারবার, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। আপনি তো বারবারই বলছেন ব্যবস্থা নেবেন। সত্যিকার ব্যবস্থা নিয়ে আপনি দেখিয়ে দিন আপনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। দেশের মানুষ আরেকবার প্রমাণ পাবে আপনি যা বলেন, আপনি তা করেন। আপনি বলেছিলেন, দেশকে মাদকমুক্ত করবেন, মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। কঠোর হাতে আপনি মাদক ব্যবসায়ীদের কুকীর্তি কমিয়ে এনেছেন। সমাজকে যারা ধ্বংস করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে এভাবেই ব্যবস্থা নিতে হয়। জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও আপনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। সে কারণেই আরেকটি ‘হোলি আর্টিজেন’ ঘটেনি বাংলাদেশে।
দেশে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা বাড়লেই দেশকে উন্নত দেশ বলা যায় না। উন্নত দেশ হতে হলে দেশের নারীরা এবং সংখ্যালঘুরা সমানাধিকার আর নিরাপত্তা পাচ্ছে কিনা দেখতে হবে। দরিদ্র আর ধনীর মধ্যে দূরত্ব কতটা কমেছে দেখতে হবে। এই মুহূর্তে দেশের সংখ্যালঘু বিপন্ন। এই বিপন্ন নাগরিকদের সহায় আপনি হবেন, এই আশা আমরা করছি। আমি সংখ্যালঘু হিন্দুর নিরাপত্তা নিয়ে বহুকাল আগে থেকেই ভাবছি। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে দেশের হিন্দুর ওপর মৌলবাদিদের সাম্প্রদায়িক হামলা আমি নিজ চোখে দেখেছি। তখনকার ঘটনা নিয়ে ‘লজ্জা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম, যেটি ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, প্রকাশিত হওয়ার ছ’মাস পর যে বইটি খালেদা জিয়ার সরকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। আমি প্রার্থনা করছি, অসাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে লেখা লজ্জা বইটি থেকে আপনি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেবেন। এই বইটি পড়লে, আমার বিশ্বাস, মানুষ সংখ্যালঘুর প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, তাদের মানুষ হিসেবে বিচার করবে, কাফের হিসেবে নয়, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে নয়।
দেশে আর কোনও নারী নেত্রী আর হয়তো আসবেন না। আমরা নারীরা আপনার মতো নারী নেত্রীর জন্য গর্ববোধ করি। নারীনেত্রীরা যে সৎ, নিষ্ঠ, বলিষ্ঠ, তা আরো একবার প্রমাণ করুন। একজন হিন্দুও যেন আতঙ্কে দেশ ত্যাগ না করে, যতটুকু নিরাপত্তা পেলে হিন্দুরা দেশের মাটিতে স্বস্তিতে শান্তিতে বাস করতে পারবে, যতটুকু নিরাপত্তা পেলে নিশ্চিন্তে নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারে—সেটুকু নিরাপত্তা আপনি নিশ্চয়ই তাদের দেবেন, এই বিশ্বাস আমাদের।
অশেষ শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা
তসলিমা
ছবি – সংগৃহীত ও প্রতীকি।