– শ্র দ্ধা ঞ্জ লি –
ব্রিটিশের গোয়েন্দারা যদি ছিলেন বুনো ওল তবে তিনি ছিলেন বাঘা তেঁতুল । খোদ বড়লাটের গালে চাটি মেরে আবার পুলিশকে ঘাটে ঘাটে ঘোল খাইয়ে শেষে সাগর পাড়ি দিয়ে বরাবরের মতো পগারপার – জীবনে আর কোনও দিন যাঁর টিকির নাগাল পায় নি ইংরেজ সেই বাঙালি বিপ্লবীর আজ জন্মদিন । তিনি রাসবিহারী বসু । ১৯১৫ সালের ১২ মে দুপুর দুটোয় খিদিরপুর বন্দরের ৬ নম্বর ডকে অপেক্ষমান জাপানি জাহাজ ‘ সানুকি মারু ‘তে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মাতৃভূমির মাটির সঙ্গে রাসুর ( স্বজন- সহযোদ্ধাদের কাছে এই নামেই পরিচিত ছিলেন রাসবিহারী বসু ) সম্পর্ক চিরজীবনের জন্য শেষ । কিন্তু আমৃত্যু মাতৃভূমির মুক্তির জন্য নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন রাসবিহারী । কলকাতা থেকে ৫০০৪ কিলোমিটার দূরে দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপানের সঙ্গে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের যে যোগসূত্র ইতিহাস গেঁথে দিয়েছে তার ঋত্বিক পুরুষ রাসবিহারী বসু ।
দেশত্যাগের সময় রাসবিহারী বসুর বয়স ছিল ঊনত্রিশ । ১৮৮৬র ২৫ মে বর্ধমানের সুবলদহে রাসবিহারীর জন্ম । যৌবনে প্রবেশের আগেই রাসুর মনে দেশাত্মবোধের উন্মেষ । আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার যখন বিচার চলছে তখনই বাংলা ছেড়ে দেরাদুনে আশ্রয় নেন রাসবিহারী । মেধাবী ছাত্র । তীক্ষ্ণ দৃষ্টি । সব দিকে নজর । পকেটে ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে আনা মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি । মনে বাসনা বিপ্লবী হওয়ার । পুলিশের চোখে ধুলো দিতে দেরাদুনে ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে বড়বাবুর চাকরি নেন রাসবিহারী । দেরাদুনে থাকতে থাকতেই বিপ্লবী বাঘাযতীনের দল যুগান্তরের সঙ্গে জুটে যান তিনি । বাঙালি যেখানে বিপ্লব সেখানে । বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ইউনাইটেড প্রভিন্স ( বর্তমান উত্তরপ্রদেশ ) ও পাঞ্জাব জুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী যে সশস্ত্র আন্দোলন দানা বেঁধেছিল তার পেছনে ছিল একাধিক বাঙালির ইন্ধন ও অংশগ্রহণ ।
বাঙালির আন্দোলনের ঠ্যালায় বঙ্গভঙ্গ রদ করলেও বিদ্রোহী জাতটাকে শিক্ষা দিতে ১৯১২ তে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিল ইংরেজ সরকার । রাজধানী স্থানান্তর উপলক্ষে জশম না করলে কি চলে । ১৯১২ র ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে জমকালো সমারোহ । হাতির পিঠে চেপে বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা করে দরবার অভিমুখে চলেছেন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ , পাশে বড়লাটের বউ । জুলুস লালকেল্লার কাছাকাছি আসতেই বোমা পড়ল ভাইসরয়ের হাতি লক্ষ্য করে । বাঙালি বসন্তকুমার বিশ্বাসের ছোঁড়া বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট না হলে সেদিনই পঞ্চভূতে মিলিয়ে যেত হার্ডিঞ্জের প্রাণবায়ু । হাতির পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়েও জানে বাঁচলেন সস্ত্রীক বড়লাট । মরল কেবল বড়লাটের ছত্রধর এক ভারতীয় ভৃত্য । খোদ ভাইসরয়ের ঘাড়ের ওপর বোমা ! ইংরেজ সিংহের তো প্রেস্টিজ পাংচার । একজন নারীর বেশে বড়লাটের দিকে বোমা ছুঁড়েছিলেন বসন্ত বিশ্বাস । গোটা পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন দেরাদুন ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বাঙালি বড়বাবু । নাম রাসবিহারী বসু । ২৩ ডিসেম্বর সকালে দিল্লিতে বড়লাটের ওপর বোমা পড়ল । ২৪ তারিখ বিকেলে ঘটনার প্রতিবাদে দেরাদুনে রাজভক্ত প্রজাদের সভা। সভায় অ্যানার্কিস্টদের প্রাণ খুলে গালমন্দ করে বক্তৃতা দিলেন কে ? না ফরেস্ট অফিসের হেডক্লার্ক রাসবিহারীবাবু ।
তৈলচিত্রে লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা হামলার ঘটনা । |
বড়লাটকে বোমা মেরে দেরাদুনে বড়লাটের নাকের ডগাতেই দিব্যি ঘোরাফেরা করেছেন রাসবিহারী । দেড় বছর পর বড়লাটের গোয়েন্দাদের যখন বুদ্ধি খুলল তখন পাখি হাওয়া । ১৯১২ র ২৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯১৫র ১২ মে – পাখিকে আর খাঁচায় পুড়তে পারে নি পুলিশ । যাকে বলে ঘোল খাইয়ে ছাড়া আক্ষরিক অর্থেই ইংরেজদের তাবৎ ইন্টেলিজেন্স উইংসকে ঘোল খাইয়ে জাপানে পালিয়ে যান রাসবিহারী বসু । ফেরারি অবস্থাতেই, পুলিশ যখন কুকুরের মতো সর্বত্র তাঁর গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছে, বিপ্লবের জাল বুনে চলছিলেন রাসবিহারী । ঐতিহাসিক হিন্দু-জার্মান মিউটিনি বা ‘ গদর ‘ বিদ্রোহ সংগঠিত করার পেছনে যাঁদের মস্তিষ্ক কাজ করেছিল তাঁদের অন্যতম রাসবিহারী বসু । ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে হিন্দু-জার্মান মিউটিনি একটা বিরাট বিয়োগান্তক অধ্যায় । এতে জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের ভেতরের বিপ্লবীদের পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার প্রবাসী ভারতীয়দের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক স্তরে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দেশ থেকে উৎখাতের বিরাট চেষ্টা করা হয়েছিল। হিন্দু-জার্মান মিউটিনি অঙ্কুরেই বিনষ্ট না হলে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস অন্য রকম ভাবে লেখা হত ।
সস্ত্রীক বিপ্লবী রাসবিহারী বসু । |
এক ফ্রেমে দুই নায়ক : নেতাজি ও রাসবিহারী । |