জাপান সফরে গিয়ে ভারতীয় সংসদীয় প্রতিনিধি দল বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সমাধিস্থলের পাশাপাশি শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাস্টিস রাধাবিনোদ পালের স্মৃতিস্তম্ভেও। জাপানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত কে এই বাঙালি? জানুন প্রতিবেদনটি পড়ে-
জাপানের সঙ্গে তিন বাঙালির নাম জড়িয়ে আছে। একজন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। অপরজন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তৃতীয় জন জাস্টিস রাধাবিনোদ পাল। অনেক বাঙালি রাধাবিনোদ পালের নাম পর্যন্ত শোনে নি। অথচ জাপানিরা তাঁকে পুজো করে। জাপানের প্রাক্তন সম্রাট হিরোহিতো, যিনি ১৯২৮ সালে সিংহাসনে বসেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সম্রাট ছিলেন। তিনি যা বলেছিলেন, তা শুনলে রাধাবিনোদের জন্য গর্ববোধ করবেন যে কোনও বাঙালি।
সম্রাট হিরোহিতো বলেছিলেন, “যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু।” জাস্টিস রাধাবিনোদ পালের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে এই কথা বলেছিলেন জাপানি সম্রাট। কেন বলেছিলেন, সেই গল্পে যাওয়ার আগে এই বাঙালি বিচারপতির জীবন সম্পর্কে ছোট্ট করে জেনে নিই।

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ছাতিয়ান গ্রামে রাধাবিনোদ পালের জন্ম। রাধাবিনোদের শৈশবকালেই সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছেড়েছিলেন তার বাবা। মামার বাড়িতে অত্যন্ত কষ্ট করে মানুষ। মামার দোকানে কাজের ফাঁকে চলত পড়ালেখা। ছোট থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন রাধাবিনোদ। কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে ‘এন্ট্রান্স’ পাশ করেন তিনি। মেধা তালিকায় নাম উঠেছিল তাঁর। রাজশাহী কলেজ থেকে ‘এফএ’ পরীক্ষায়ও স্ট্যান্ড করেছিলেন রাধাবিনোদ পাল।
১৯০৭ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। অঙ্কের মেধাবী ছাত্র। আবার আইনশাস্ত্রেও ‘টপার’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই LLM-এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। এরপর ‘ল’-তে একই ইউনিভার্সিটি থেকে ‘পিএইচডি’ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। বর্ণময় কর্মজীবন বিদগ্ধ রাধাবিনোদ পালের। এলাহাবাদে ‘একাউন্টেন্ট জেনারেলের’ দফতরে কেরানির চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু। সেখান থেকে সোজা শিক্ষকতায়। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে গণিতের লেকচারার। শিক্ষকতার পাশাপাশি ময়মনসিংহ আদালতে ওকালতিও প্র্যাকটিস করতেন তিনি।
১৯২৭ সালে ভারত সরকারের আইন উপদেষ্টার দায়িত্ব পান রাধাবিনোদ পাল। ১৯২৩ থেকে ৩৬- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪১ থেকে ৪৪- কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির দায়িত্বে। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে ‘আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের’ একজন বিচারপতি হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ পান রাধাবিনোদ পাল। এবং এই ভূমিকাতেই জাপানের বিরাট উপকার করেছিলেন তিনি। এখন সেই গল্পেই আসছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানির মতোই জাপানকেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে কাঠগড়ায় তোলে মিত্রশক্তি। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জাপানিদের বিচারের জন্য গঠন করা হয় “ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্যা ফার ইস্ট।” ইতিহাসে যা ‘টোকিও ট্রাইব্যুনাল’ নামেও পরিচিত। অভিযুক্ত ২৮ জন জাপানি রাজনীতিবিদ, মিলিটারি জেনারেল ও সরকারি আধিকারিককে বিচারের ভার পড়ে ১১ জন বিচারকের উপর। তাঁদের একজন ছিলেন বাঙালি রাধাবিনোদ পাল।

জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জৈব ও রাসায়নিক মারণাস্ত্রের ব্যবহার, নির্বিচারে গণহত্যা ও গণধর্ষণের ভুঁড়ি ভুঁড়ি অভিযোগ আনে পশ্চিমা শক্তি। ট্রাইব্যুনালের বাকি ১০ জন বিচারক যখন একযোগে জাপানকে কঠিনতম শাস্তি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন তখন একমাত্র ব্যতিক্রমী ভূমিকা রেখেছিলেন আমাদের রাধাবিনোদ পাল। বিচারকের আসনে বসে রাধাবিনোদ পাল বলেন, “জাপানকে এককভাবে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করা হবে এই আদালতের জন্য একটি চরমতম ভুল। একা জাপান যুদ্ধাপরাধ করে নি। যুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রত্যেকটি দেশ একই অপরাধে অপরাধী। যুদ্ধাপরাধের জন্য যদি জাপানের বিচার করতে হয়, তবে বাকিদেরও কেন বিচার হবে না!”
জাস্টিস রাধাবিনোদ পাল আরও বলেন, “হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে মেরেছে আমেরিকা। যা ইতিহাসের সবথেকে নৃশংসতম গণহত্যা। যদি গণহত্যার দায়ে জাপানের চরম শাস্তি প্রাপ্য হয় তবে আমেরিকা ছাড় পাবে কেন?” রাধাবিনোদ পালের যুক্তি প্রভাবিত করে ট্রাইব্যুনালের আরও কয়েকজন বিচারককে। পক্ষাপাতদুষ্ট বিচার থেকে খানিকটা সরে আসেন তাঁরা।

১৯৪৮ সালে এই বিচারপর্ব শেষ হয়। মোট ১ হাজার ২৩৫ পাতার রায় দিয়েছিল টোকিও ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালে জাস্টিস রাধাবিনোদ পালের ভূমিকা সাড়া ফেলে দিয়েছিল বিশ্বে। বিচারে প্রধানমন্ত্রী হিডেকি তোজো সহ জাপানের শীর্ষ সাত জেনারেল ও রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। ১৬ জনের যাবজ্জীবন, দু’জনের ২০ ও ৭ বছরের কারাবাস। তবে জাস্টিস রাধাবিনোদ পালের কারণে বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের হাত থেকে রেহাই মেলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান রাষ্ট্রের। জাপানের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বসেছিল বিচারে। ১১ বিচারকের ট্রাইব্যুনালে বাঙালি রাধাবিনোদ পালই একমাত্র বিচারক; যাঁর ঐতিহাসিক রায় ঢাল হয়ে জাপানকে সেদিন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
রক্ষাকর্তা বাঙালি রাধাবিনোদ পালের কাছে জাপানি জাতি তাই চিরকৃতজ্ঞ। সম্রাট হিরোহিতো তাঁকে ভূষিত করেছেন জাপানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান “কোক্কা কুনশোও’ পদকে। রাজধানী টোকিওর একটি রাজপথের নামকরণ করা হয়েছে রাধাবিনোদ পালের নামে। বাঙালি রাধাবিনোদের নামে জাপানে গড়া হয়েছে মিউজিয়ামও।
জাপানের নিহন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক LLD উপাধি। টোকিও এবং কিয়োটো শহরের ‘মেট্রোপলিস গভর্নরগণ’ রাধাবিনোদ পালকে দিয়েছেন “ফ্রিডম অব দ্যা সিটি” সম্মান। টোকিওর চিয়োদা অঞ্চলের ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে যুদ্ধে নিহত বীর জাপানি সৈনিকদের স্মরণে। সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম একজন বাঙালির স্মৃতিস্তম্ভ। তিনি আর কেউ নন, জাস্টিস রাধাবিনোদ পাল।

২০০৭ সালে তিনদিনের ভারত সফরে এসেছিলেন জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে। সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় কৃতজ্ঞ চিত্তে রাধাবিনোদকে স্মরণ করেছিলেন অ্যাবে। ব্যস্ত রাষ্ট্রীয় সফরের মধ্যেই কলকাতায় গিয়ে বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের পুত্র প্রশান্ত পালের সাথে সাক্ষাৎ করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৬৭ সালের ১০ জানুয়ারি কলকাতায় জাপানের হৃদয়জয়ী এই কৃতী ভারতসন্তানের জীবনাবসান হয়।