এ'বার উমা এলে কী চাইতে হবে, বাঙালি তা ঠিক করে ফেলেছে

এ’বার উমা এলে কী চাইতে হবে, বাঙালি তা ঠিক করে ফেলেছে


পুজো শেষ হ‌ওয়ার পরদিন থেকে আগামী পুজোর দিন গুণতে শুরু করা বাঙালি ভাল করেই জানে, কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে মায়ের আরাধনা করতে হয়। লিখলেন‌ উত্তম দেব-

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের বলেছেন, “এক মাস তো হয়ে গেল। এ’বার পুজোয় ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন।” আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মহিলা ইন্টার্নিকে খুন-ধর্ষণের এক মাস হয়ে গেল। ঠিক এক মাস পরেই দুর্গাপুজো। বাঙালির সর্ববৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসব। সারা বছর এই পুজোর প্রতীক্ষায় থাকে বাংলার মানুষ। আরজি কর কান্ডের পর থেকেই রাজ্যের সমস্ত মেডিকেল কলেজে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি চলছে। ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুধু চিকিৎসক গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ঘটনার পর থেকেই গোটা বাংলা রাজপথে। ঘটনায় জড়িত প্রত্যেক দুষ্কৃতীর গ্রেফতার ও শাস্তি চাইছেন মানুষ। মমতা খুব ভাল করেই জানেন, শুধু জুনিয়র ডাক্তারেরাই নয়, ‘অভয়া’র পরিবারকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আপামর জনসাধারণ আজ উৎসব বিমুখ। ব্যতিক্রম শাসকদলের কিছু নেতা-কর্মী-সমর্থক। যারা ট্রেন-বাস থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যম- সর্বত্র ‘চটিচাটা’ বিশেষণে জর্জরিত।

“এক মাস হয়ে গেল। দোহাই, এবার পুজোয় ফিরুন, উৎসবে ফিরুন”- মুখ্যমন্ত্রীর এই মিনতি আসলে রাজ্যবাসীর উদ্দেশে। মমতা জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরতে বলেছেন আর জনগণকে বলেছেন, শোক-ক্ষোভ ভুলে পুজোর আনন্দে মেতে উঠতে। মমতার কন্ঠ নিঃসৃত এই উবাচের পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ছিঃ ছিক্কার পড়ে গেছে। বাঙালির কাছে দুর্গাপূজা মহাপূজা, মহোৎসব। মা দুর্গার আরেক নাম আনন্দময়ী। আনন্দময়ীর আগমনে মারি-মন্বন্তর ভুলেও বাঙালি আনন্দে মেতে উঠে। সেই বাংলায় আজ পুজোর কোন‌ও রেশ চোখে পড়ছে না! মানুষের মন দখল করে আছে কেবল আরজি কর কান্ড। এমনকি প্রতিবাদে রাজ্য সরকারের দেওয়া আর্থিক অনুদান গ্রহণে পর্যন্ত অপারগতা জানিয়েছে অনেক সর্বজনীন পুজো কমিটি।

বাঙালি কি সাধে পুজোর প্রস্তুতি দূরে সরিয়ে রেখে আরজি কর ইস্যুতে লাগাতার রাজপথে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “এক মাস তো হয়ে গেল…!” মানুষ বলছে তো? মহিলা চিকিৎসককে খুন-ধর্ষণের কিনারা হয়েছে? ঘটনায় জড়িত সবাই ধরা পড়েছে? পশ্চিমবঙ্গের একজন মানুষ‌ও কি বিশ্বাস করে, ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় ছাড়া আর কেউ এই নারকীয় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়? এমনকি তথাকথিত চটিচাটারাও, মুখে যাই বলুক, মন থেকে বিশ্বাস করে সেই রাতে একজন সিভিক ভলান্টিয়ার নিঃশব্দে আরজি করের চারতলায় উঠে ‘অভয়া’কে ধর্ষণ ও খুন করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে? মামলা সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার আগেই সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া হয়েছে, এটা উপলব্ধি করার জন্য ‘রকেট সায়েন্স’ জানা লাগে না, কান্ডজ্ঞান‌ই যথেষ্ট। আরজি করের ঘটনার তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করার পেছনে কার নির্দেশ থাকতে পারে, মানুষের কি এটা বুঝতেও‌ খুব কষ্ট হচ্ছে?

ভিডিও-আরজি কর কান্ডের প্রতিবাদে পাঁচ দফা দাবিতে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ভবন ঘিরে ফেললেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। এক্স হ্যান্ডেল থেকে সংগৃহীত ফুটেজ

সোমবারের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই যে, চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি করায় সাধারণ মানুষের চরম অসুবিধা হচ্ছে। রোগীরা চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ নিজেরা কষ্ট স্বীকার করে হলেও‌ জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে চিকিৎসকেরা নন ট্রোলড হচ্ছেন ‘শঙ্খচূড়’। হাত চাপা দিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করে রাখা যাবে না। বিচারপতিদের হুকুমেও জনগণ বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে না। পুজোর আর এক মাস বাকি, বাঙালিকে তা মনে করিয়ে দিতে হবে না কার‌ও। পুজো শেষ হ‌ওয়ার পরদিন থেকে আগামী পুজোর দিন গুণতে শুরু করা বাঙালি ভাল করেই জানে, কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে মায়ের আরাধনা করতে হয়।

একজন নারী চিকিৎসক ৩৬ ঘন্টা ডিউটি শেষে নিজের কর্মস্থল থেকে নিজের ঘরে ফিরতে পারলেন না। কর্মস্থলকে বলা হয় দ্বিতীয় বাড়ি। সেই বাড়িতেই চিকিৎসকদের কোন‌ও নিরাপত্তা নেই। চিকিৎসক নারী হলে তাঁর সম্ভ্রম ও প্রাণ- দুটোই যাওয়ার আশঙ্কা। সিবিআই তদন্তের এখনও পর্যন্ত কী অগ্রগতি হয়েছে, আমরা সাধারণ মানুষ তা জানি না। জানার কথাও না। কিন্তু দৃশ্যত যে তেমন কোনও অগ্রগতি হয় নি, তা সাধারণের স্থূল চোখেও ধরা পড়ছে। হ্যাঁ,‌ আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ অবশেষে গ্রেফতার হয়েছেন। সন্দীপের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ‌ও উঠেছে। হাইকোর্টের নির্দেশ সেই মামলার তদন্তভার‌ও সিবিআইয়ের হাতে। এই দুর্নীতির সঙ্গে ‘অভয়া’কে গণধর্ষণ ও খুনের কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে বলে গুঞ্জন। হাসপাতালে এই রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা ভারতে তো বটেই দুনিয়ার কোথাও আর ঘটেছে কিনা সন্দেহ। সারা পৃথিবীর কাছে পশ্চিমবঙ্গের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। আর রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বলছেন, সব ভুলে এবার‌ উৎসবে মাতো!

মাতৃভক্ত বাঙালি মায়ের পুজো যথা নিয়মেই করবে। বাঙালি দুর্গাকে জগজ্জননী মানে। সন্তানের কাছে মনের কথা খুলে বলার, মনের মতো কিছু চাওয়ার সবথেকে বড় জায়গা মা। মা দুর্গার কাছে এ’বার কী বলতে হবে, কী চাইতে হবে বাঙালি তা ঠিক করে ফেলেছে। ‘অভয়া’র দুঃখী বাপ-মায়ের জন্য ন্যায় বিচার আর দুঃশাসনের অবসান ছাড়া এ’বছর মায়ের কাছে আর কী বড় চাইবার থাকতে পারে আমাদের?

Feature Image- Collected.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *