বিশেষ প্রতিবেদন: ২০১১-তে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের বিদায়ের পর থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। মন ভেঙে গিয়েছিল। এরপর বিগড়োতে থাকে শরীর। মুখ্যমন্ত্রী থাকতেই ‘সিওপিডি’ ধরেছিল। চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়েছিল তখনই। বেশ কয়েক বছর ধরেই রোগের বাড়াবাড়ি। দৃষ্টিশক্তি চলে গিয়েছিল পুরোপুরি। অবস্থা আশঙ্কাজনক হলেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হত। এবার আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিলেন না বুদ্ধবাবু। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে বুধবার রাতে শ্বাসকষ্ট বেড়ে গিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। বাড়িতে চিকিৎসক এনে অবস্থা সামাল দেওয়া হয়েছিল। সকালে অবস্থার উন্নতি হয়। প্রাতরাশও সারেন। কিন্তু এরপরেই ফের অবস্থার অবনতি। উডল্যান্ডসে ভর্তি করানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই মৃত্যু বরণ করেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। হাসপাতালে ভর্তি থাকার ব্যাপারে ভীষণ অনীহা ছিল বুদ্ধবাবুর। যতবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, একটু সুস্থ হলেই পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যকে পীড়াপীড়ি শুরু করতেন। অন্যেরা তাঁর জন্য বিড়ম্বনায় পড়ুক বা উৎকণ্ঠিত হোক চাইতেন না। শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরেই শরীর ছাড়লেন। মৃত্যু কালে বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
জ্যোতি বসু অবসর নেওয়ার পর ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০১১ সালের ১৩ মে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে রাজ্যের দায়িত্ব তুলে দিয়ে বিদায়। প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ার মোকাবিলা করে ২০০১-এর নির্বাচনে বামফ্রন্টের ক্ষমতায় ফেরাটা ছিল যথেষ্টই চ্যালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুভ্রকেশ, শুভ্র ধুতি ও শুভ্র ভাবমূর্তির বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেকেই যোগ্য সেনাপতি বলে মনে করেছিল আলিমুদ্দিন। অবশ্য জ্যোতি বসুর উত্তরসূরী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম তার অনেক আগেই পাকা হয়ে গিয়েছিল।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি যে ২০০১-এর নির্বাচনে বামফ্রন্টের জয়লাভের একটা অন্যতম কারণ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বামফ্রন্টের বিকল্প আরও ভাল বামফ্রন্ট- এই আওয়াজ তুলে দল ও সরকারের ভেতরে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। সাবধানী জ্যোতি বসু কখনও স্থিতাবস্থাকে অস্থির করেন নি। রাজ্যে শিল্প আসুক। বিনিয়োগ বাড়ুক। ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থান হোক। আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বুদ্ধবাবুর আশ্বাসে মানুষের বিশ্বাস হয়েছিল বলেই ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে ২৩৫ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছিল বামফ্রন্ট।
এই বিশাল জয়ের পর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। হতে চেয়েছিলেন দেং জিয়াও পিং। কিন্তু নিয়তি তাঁকে বানিয়ে ছাড়ল মিখাইল গর্বাচেভ। টাটার ন্যানো গাড়ির প্রকল্পের জন্য সিঙ্গুরে কৃষি জমি অধিগ্রহণ। সেই অধিগ্রহণ ঘিরে বিক্ষোভ। মমতাকে সিঙ্গুর থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে কালীঘাটের বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল পুলিশ। জমিহারা চাষীদের বিক্ষোভ মোকাবিলায় সংবেদনশীলতার পরিচয় না দিয়ে বিরোধীদের ব্যঙ্গ করে বুদ্ধবাবুর দম্ভোক্তি- ওরা ৩০, আমরা ২৩৫! সিঙ্গুরে টাটার প্রকল্প ঘিরে জমি আন্দোলনের মধ্যেই নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাবের জন্য জমি অধিগ্রহণের নোটিশ। নোটিশ ঘিরে অগ্নিগর্ভ নন্দীগ্রাম। ২০০৭-এর ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যু।
২০০৬ সালের জুনে ভোটে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার ২০০৭-এর ১৫ মার্চ থেকেই কার্যত স্থবির ও অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। নন্দীগ্রামে ১৪ মার্চের গণহত্যার ধাক্কায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ধাক্কায় বামেদের জনভিত্তিতে যে দ্রুত ক্ষয় শুরু হয়েছিল সেই ক্ষয় আর রোধ করতে পারে নি সিপিএম। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ক্লিন ইমেজও সিপিএমেকে রক্ষা করতে পারে নি। বরং রাজ্যের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে তিনি ‘আইডল’ হয়ে উঠেছিলেন, তারাও তাঁর নাম শুনলেই ক্ষেপে উঠতে শুরু করে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত সততা প্রশ্নাতীত। বুদ্ধবাবুর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শিবিরের সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন, তিনি সততার প্রতীক নন, সৎ। অর্থাৎ তাঁর সততায় কোনও ছলনা ছিল না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সৎ সাজতে হয় নি। তিনি মানুষটা চরিত্রগতভাবেই সৎ। পাম অ্যাভিনিউয়ের দুই কামরার আবাসন থেকে তাঁকে নড়ানো যায় নি। কিন্তু রাজনীতিতে ব্যক্তিগত সততাই সব নয়। রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্দেশ্যেও ভুল ছিল না। তিনি আন্তরিকভাবেই রাজ্যে নতুন নতুন বিনিয়োগ, নতুন নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থান চেয়েছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে দলের সরকারটা চালাচ্ছিলেন, সেই দল বহুমাত্রিক কারণেই ধীরে ধীরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আন্তরিকতায় খাদ না থাকলেও রাজনৈতিক হিংসা মোকাবিলায় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিক হিংসা বন্ধে প্রশাসক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়। হয়তো চেয়েছিলেন কিন্তু নিজের পার্টিকে শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন নি। সুশান্ত ঘোষ, লক্ষ্মণ শেঠদের মতো ঠ্যাঙারে নেতাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জঙ্গলমহলে মাওবাদী হিংসা মোকাবিলায়ও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলায় শেষ পর্যন্ত শিল্প আসে নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্নার ঠ্যালায় সিঙ্গুর থেকে টাটারা পাততাড়ি গুটিয়ে ছিল বুদ্ধবাবুর চোখের সামনেই। আটকাতে পারেন নি। কারণ, ততদিনে তিনি কনফিউজড। শিল্প আনবেন না দলকে বাঁচাবেন জনরোষ থেকে। ২০০৯ থেকেই বাংলার রাজনীতিতে বাম বিদায়ের সুর ধরা পড়ে। এগারোতে ভরাডুবি। বামেরা সেই যে ডুবল, আর উঠল না। বাংলায় শিল্পও এল না। বামও ফিরল না। সিপিএমের অনেকে মনে করেন, শিল্প নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়াবাড়ি, মাতামাতির কারণেই তাদের সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসতে হয়েছে। তবে এতদিনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের একটা বড় অংশের এই উপলব্ধি হয়েছে, সিঙ্গুর থেকে টাটাকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের পায়েই কুড়ুল মেরেছে বাঙালি। নন্দীগ্রামের উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন নিয়েও মানুষের মনে এখন অনেক প্রশ্ন। সব হারিয়েও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জিত বোধহয় এখানেই।
Feature image is representational.