বিশেষ প্রতিবেদন: গ্রামের মানুষের ভোটে তৃণমূল উতরে গেলেও শহরের মানুষের বড় অংশ যে শাসকদলের উপর বিরক্ত, লোকসভা নির্বাচনের ফলেই তার প্রমাণ। রাজ্যের ১২১টি পুরসভার মধ্যে ৭৪টিতেই এগিয়ে বিজেপি। তিনটিতে কংগ্রেস, তৃণমূল মাত্র ৪১টিতে। তিনটি পুরসভার ওয়ার্ড ভিত্তিক ফল ‘টাই’ হয়েছে। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি সহ বহু পুরসভায় তৃণমূল একটি-দুটির বেশি ওয়ার্ডে লিড পায় নি। শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৬টিতেই এগিয়ে বিজেপি। দুর্গাপুর কর্পোরেশনের ৪৩টি ওয়ার্ডের ৩৩টিতেই লিড বিজেপির। আসানসোল কর্পোরেশনে ১০৬টি ওয়ার্ড; ৭৬টিতে এগিয়ে বিজেপি, তৃণমূল মাত্র ২৯টিতে।
এমনকি কলকাতা কর্পোরেশনেও বিজেপির ফল নজরকাড়া। কলকাতা মহানগরীর ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৫টিতে এগিয়ে বিজেপি, ৯৮টিতে এগিয়ে তৃণমূল। ২০২১-এর ডিসেম্বরে কলকাতার পুরভোটে বিজেপি জিতেছিল মাত্র তিনটি ওয়ার্ড। সল্টলেকে শাসকদলের মুখ পুড়েছে। বিধাননগর পুরসভার ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৫টিতেই এগিয়ে বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে মাথা ঠাণ্ডা রাখা সত্যিই মুশকিল। লোকসভার ২৮টি আসনে জয় তাঁর কাছে এখন অতীত। বরং ২৬-এর ছক কষতে শুরু করে দিয়েছেন মমতা। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ২৮টি আসন জিতলেও দলের ভোট কমেছে ২.২৬ শতাংশ। ভোট শতাংশে হ্রাস যে কোনও দলের জন্যই অশনিসংকেত। মমতা তাই ক্ষেপে গিয়ে দলের লোকদের তাল দেওয়া শুরু করেছেন।
লক্ষ্মীর ভান্ডারের জেরে গ্রামের মহিলাদের ভোট ঝেঁপে তৃণমূলের বাক্সে পড়েছে। আর সংখ্যালঘু এলাকাগুলিতে জোরজবরদস্তি ভোট করানো হয়েছে। কিন্তু বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকায় শহরাঞ্চলে অবাধে ছাপ্পা করা সম্ভব হয় নি, যেমনটা পুরভোটে হয়েছিল। জোর না খাটালে যে শহরে জেতা সম্ভব নয়, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ তা স্বীকার করেছেন। উত্তরবঙ্গের একমাত্র লোকসভা আসন কোচবিহার, যেখানে তৃণমূল জিতেছে। কিন্তু কোচবিহার পুরসভায় তৃণমূলের ফল শোচনীয় এমনকি উদয়নের শহর দিনহাটাতেও হেরেছে তৃণমূল। শহরের মানুষের মন তৃণমূলের থেকে উঠে গেছে। এর একটা বড় কারণ, রাজ্যে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ। কর্মসংস্থান তলানিতে। নিয়োগ দুর্নীতি দেখার পর শিক্ষিত যুবকেরা তৃণমূল বিমুখ।
শহরে তৃণমূলের ভোট হারানোর আরেকটা বড় কারণ, তোলাবাজি ও জমি জবরদখল। শাসকদলের নেতাদের তোলা না দিয়ে এখন রাজ্যে কারও পক্ষে জমি কেনাবেচা করা সম্ভব নয়। জলাজমি ভরাট করে আবাসন নির্মাণ থেকে সরকারি জমি জবরদখল করে ভাড়া দেওয়া- কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার ঘটনা গুনে শেষ করা যাবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গেলে শাসকদলের নেতাদের তুষ্ট করা বাধ্যতামূলক। ছোটখাট দোকানদারদেরও তোলা না দিয়ে রেহাই নেই। রাজ্য থেকে বড় শিল্প তো কবেই উঠেই গেছে। ছোটখাট যে’কটি কলকারখানা এখনও আছে; মালিকেরাই জানেন, কী পরিমাণ উৎপাত তাঁদের সহ্য করতে হয়।
এমন নয় যে দলের নেতাদের দৌরাত্ম্যের কথা এতদিন মমতার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি। সব তাঁর নখদর্পণে। তৃণমূলের কে কোথায় কত টাকা তোলা আদায় করছে। কার জমি দখল করে কে ফ্ল্যাট তুলছে। কে জলাজমি ভরাট করে বেচে দিচ্ছে। এইসবের রেকর্ড যে তিনি রাখেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বহুবার তা কবুল করেছেন। তৃণমূলের দোলা সেনকে দলের একটি বৈঠকে বলতে শোনা গিয়েছিল, যা কামাচ্ছেন, তার ২৫ ভাগ নিজেদের জন্য রেখে বাকিটা সদর দফতরে পাঠিয়ে দেবেন। অথচ যখনই দলের ভাবমূর্তি খারাপ হয়, তখনই দলের থেকে নিজেকে পৃথক করে ফেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা মানুষকে বোঝাতে চান, তাঁর দলের অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও তিনি সৎ। তিনি দল ও প্রশাসনে শুদ্ধিকরণ চান, কিছু কঠোর পদক্ষেপ করে জনগণকে এই বার্তাই এবার দিতে চাইছেন মমতা। ঘটনাক্রম থেকে পরিষ্কার, মানুষের সমর্থন ফিরে পেতে প্রয়োজনে দলের লোকদের জেলে দিতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পিছপা হবেন না।
সোমবার (২৪ জুন,২০২৪) নবান্নে ডেকে দলের নেতা-মন্ত্রী-মেয়র ও পুরপ্রধানদের তুলোধুনো করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাজ্য জুড়ে জবরদখল উচ্ছেদ শুরু। বুধবার শিলিগুড়িতে তৃণমূলের দাপুটে নেতা দেবাশিস প্রামাণিক জমি দখলের অভিযোগে গ্রেফতার। দেবাশিস ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি তৃণমূলের ব্লক সভাপতি। ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভা জলপাইগুড়ি লোকসভার অন্তর্গত। ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভায় ৭৬ হাজার ভোটে হেরেছে তৃণমূল। জলপাইগুড়িতে বিজেপির জয়ের পেছনে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বড় ভূমিকা রেখেছে।
ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে পড়লেও তা কার্যত শিলিগুড়ি শহরের বর্ধিত অংশে পরিণত হয়েছে। এখানে জমির দাম দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। জমি জবরদখল করে কোন দলের কোন কোন নেতা ফুলেফেঁপে ঢোল, এই তল্লাটের মানুষের তা ভালকরেই জানা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানতেন না, তেমন নয়। দলকে বড় মার্জিনে লিড দেওয়াতে পারলে দেবাশিস প্রামাণিক হয়তো পার পেয়ে যেতেন, হয়তো ‘রিওয়ার্ড’ও পেতেন। কিন্তু দল বড় ব্যবধানে হারায় তাঁর কপাল পুড়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাঁর দলে মাও জে দংয়ের মতোই অবিসংবাদিত। দলে ও প্রশাসনে তাঁকে কেউ চ্যালেঞ্জ করার মতো নেই। সোমবারের পর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হচ্ছে, ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটকে নজরে রেখে নিজের দলের ভেতরেই ছোটখাটো একটা ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ ঘটাতে চাইছেন তিনি।
Feature image is representational.