আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকেই ইরানিদের একটা বড় অংশ ইউরোপ-আমেরিকায় নির্বাসিত। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর সংবাদে নির্বাসিত ইরানিদের মধ্যে জশম শুরু হয়ে গেছে। এমনকি ইরানের ভেতর থেকেও উল্লাসের খবর আসছে। ইরানে বসবাস করে দেশের কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ রীতিমতো বিপজ্জনক। গ্রেফতারের পর জেল তো বটেই এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। নির্যাতনের ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ইরানিরা রাইসির মৃত্যু সংবাদে আনন্দ করছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে।
রবিবার রাতে প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাগ্রস্ত হওয়ার খবর সম্প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই ইরানের বিভিন্ন জায়গায় আতসবাজি ফাটতে থাকে। তখনও রাইসির মৃত্যু সংবাদে সরকারি সিলমোহর পড়ে নি। ‘প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন’- এই সংবাদ শোনার জন্য দেশে-বিদেশে বহু ইরানিদের যেনো তর সইছিলো না। সামাজিক মাধ্যমে বাজির আলোতে উজ্জ্বল আকাশের ছবি-ভিডিও পোস্টও করেন অনেকেই। নির্বাসিত ইরানিদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও এক্স হ্যান্ডেল ভরে যায় খুশির পোস্টে। আমেরিকা প্রবাসী ইরানি সাংবাদিক মাসিহ আলিনেজাদ এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “আমার মনে হয়, ইতিহাসে এটাই একমাত্র দুর্ঘটনা, যেখানে যদি কেউ বেঁচে যায়, এই ভেবেই সবাই উদ্বিগ্ন।” হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসির মৃত্যুর দিনটিকে ‘হ্যাপি ওয়ার্ল্ড হেলিকপ্টার ডে’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মাসিহ।
৬৩ বছরের ইব্রাহিম রাইসি ‘তেহরানের কসাই’ নামেও পরিচিত। শৈশবে শিক্ষা মক্তবে। কৈশোর থেকেই তাই গোঁড়ামি রাইসির রক্তে। শিয়া ধর্মগুরুদের একজন হওয়ার সুবাদে মতাদর্শভাবে তিনি ছিলেন কট্টর। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেইনি নিজ হাতে তাঁকে গড়েপিটে নিয়েছেন। খোমেইনির উত্তরসূরী হিসেবে রাইসির নাম ছিল সর্বাগ্রে। অর্থাৎ বেঁচে থাকলে একদিন ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদে বসতেন ইব্রাহিম রাইসি। ইরানের ইসলামিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট নন, সর্বোচ্চ নেতাই শেষ কথা। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর হয়েছিলেন রাইসি। ১৯৮৮ সালে বিক্ষুব্ধ ও রাজনৈতিক বিরোধীদের পাইকারি হারে খুন করার পেছনে রাইসির বড় ভূমিকা ছিল বলে জানা যায়। এই কারণেই ইরানের উদারপন্থীদের কাছে রাইসি ‘তেহরানের কসাই’ নামে পরিচিত।
২০২১ সালের নির্বাচনে তুলনায় মডারেট হাসান রৌহানিকে পরাজিত করে ইরানের প্রেসিডেন্ট হন ইব্রাহিম রাইসি। ২০১৭-র নির্বাচনে রৌহানির কাছেই পরাজিত হয়েছিলেন রাইসি। পৃথিবীতে সবথেকে নারীবিদ্বেষী রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি কোথাও থেকে থাকে, তবে তা অবশ্যই ইরানে। সুন্নি সৌদি আরবের থেকেও ইরানে নারীদের অবস্থা দুর্বিষহ। ইরানের সব নেতাই কমবেশি নারী বিদ্বেষী। কিন্তু রাইসি বাকিদের ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। ক্ষমতায় বসেই হিজাব সংক্রান্ত আইন আরও কঠোর করেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে ও জনসমক্ষে নারী-পুরুষ মেলামেশা নিষিদ্ধ করে রাইসি সরকার। ২০২২-এ হিজাব ঠিকমতো না পরার অভিযোগে তেহরানের রাস্তা থেকে একুশ বছরের কুর্দ তরুণী মেহশা আমিনিকে থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে নীতি পুলিশ।
মেহশা আমিনির মৃত্যুর জেরে জনগণের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তেহরান সহ ইরানের প্রধান প্রধান শহরে রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার মানুষ। গণবিক্ষোভ ঠেকাতে ফের কসাইয়ের ভূমিকা নেন রাইসি। পুলিশের গুলিতে নারী ও শিশুসহ শতশত বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়। আমিনির মৃত্যুর তিনমাস পরেও জন অসন্তোষ থামাতে পারে নি সরকার। অসংখ্য আন্দোলনকারী বিনা বিচারে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। বিচারের প্রহসনে বহু বিক্ষোভকারীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয় রাইসি সরকার। অনেক নির্যাতিত নারী অধিকার কর্মী, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র পরিচালক পালিয়ে ইউরোপে আশ্রয় নেন।
ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার আগেই রবিবার রাতে লন্ডনে ইরানের দূতাবাসের সামনে নির্বাসিত ইরানিদের আনন্দে নাচগান করতে দেখা যায়। মাসিহ আলিনেজাদের মতোই আরেক নির্বাসিত ইরানি সাংবাদিক মাহিয়ার তৌসি। রাইসির মৃত্যুর সংবাদে তৃপ্ত তৌসি এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “ইরানের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট রাইসি হাজার হাজার ইরানিকে হত্যা করেছেন। কারাগারে নারীদের ধর্ষণ করিয়েছেন। তেহরানের কসাই তাঁর জন্য উপযুক্ত নাম।” ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর খবরে যাঁদের সামাজিক মাধ্যমে আনন্দ করতে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে ২০২২-এর হিজাব বিরোধী বিক্ষোভে নিহত মিনো মাজিদির কন্যারাও আছেন। দেহে ১৬৭টি পেলেট বুলেটের আঘাত নিয়ে প্রাণত্যাগ করেছিলেন ৬২ বছরের নারী মিনো মাজিদি। রাইসির মৃত্যুর খবরে হাতে পানপাত্র নিয়ে ‘টোস্ট’ করতে দেখা যায় মিনো মাজিদির দুই মেয়েকে।
এক্স হ্যান্ডেলে করা অন্য একটি পোস্টে আমেরিকাবাসী ইরানের মহিলা সাংবাদিক মাসিহ আলিনেজাদ লিখেছেন, “কেন আমি আমার অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখব যখন অনেক ইরানি তরুণ-তরুণী, বিশেষ করে নারীরা, যারা অভ্যুত্থানের সময় আহত হয়েছেন, তার মৃত্যুর আনন্দে নাচের ভিডিও শেয়ার করছেন? আমরা ইরানিরা আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মর্যাদার জন্য লড়াই ততক্ষণ পর্যন্ত জারি রাখব, যতক্ষণ না আমরা সর্বোচ্চ নেতা খামেইনি ও তাঁর ধর্মীয় একনায়কত্ব থেকে মুক্তি পাব।”