মাথাভাঙা: উত্তরবঙ্গে লোকসভা ভোটের প্রচার জমে উঠেছে। প্রথম দফায় আগামী ১৯ এপ্রিল কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি আসনে ভোটগ্রহণ। বৃহস্পতিবার একই দিনে কোচবিহারে মমতা ও মোদী। এদিন দুপুর বারোটা নাগাদ কোচবিহার জেলার মাথাভাঙার গুমানির হাটে দলের প্রার্থী জগদীশচন্দ্র বাসুনিয়ার হয়ে সভা করলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ থেকে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল তৃণমূল। একুশের বিধানসভাতেও ফল তেমন ভাল হয় নি ঘাসফুল শিবিরের। তবে উপনির্বাচন ও পঞ্চায়েতে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের ফল ভাল হলেও চব্বিশ নিয়ে চিন্তা দূর হয় নি মমতার। উত্তরবঙ্গে উনিশের ফল ধরে রাখতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে উত্তরবঙ্গে নিজের মুখ রক্ষা করতে মমতাও যে মরীয়া, তা বোঝা গেল মাথাভাঙ্গার সভামঞ্চে মমতার ভাষণে।
আবার সেই আমাকে দেখে ভোট দিন
মাথাভাঙায় মমতা বলেন, “হিরের টুকরো ছেলে আমাদের প্রার্থী। আমার মুখটা মনে করবেন আর ওঁকে ভোট দেবেন। দয়া করে দেবেন। দণ্ডবৎ জানিয়ে বললাম, ভোটটা দেবেন। মায়েদের প্রণাম জানিয়ে, সকলকে ভালবাসা জানিয়ে বললাম, ভোটটা দেবেন। ভোট দিয়ে বলবেন জয় বাংলা। দেশ বাঁচাও, বিজেপি হটাও।” রাজনৈতিক মহল বলছে, মানুষের মধ্যে দলের ইমেজ খারাপ হয়ে গেছে, বুঝতে পারলেই নিজের নাম করে ভোট চাওয়া তৃণমূল সুপ্রিমোর পুরোনো কৌশল। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ২৯৪টি কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী। আমার কথা মনে করে তৃণমূলকে ভোট দিন। এখন অবশ্য খোদ মমতার ইমেজ নিয়েই টানাটানি। এই পরিস্থিতিতে মমতার ”আমার মুখ মনে করে আমার প্রার্থীকে ভোট দিন”- এই কৌশল কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে যথেষ্টই সন্দিহান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কমিশনকে দুষলেন, শীতলকুচি তুলে দেবাশিসকেও নিশানা
মাথাভাঙার সভায় নির্বাচন কমিশনকেও ছেড়ে কথা বলেন নি মমতা। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কারচুপি করতে পারে, এই আশঙ্কায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বিজেপি ভোটবাক্সে চিপ লাগায়, তাই ইভিএমের উপরে নজর রাখবেন আপনারা।” বিজেপি নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করেও পার পেয়ে যায় বলে অভিযোগ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যার বিয়ে সে নিজেই পুরোহিত। বিজেপি আর নির্বাচন কমিশন এক হয়ে কাজ করছে। সেই কারণেই নির্বাচনী আচরণ বিধি মানে না বিজেপি। ওরা মারলেও দোষ নয়, গ্রেফতার করলেও দোষ নয়।” নির্বাচনী আচরণবিধির কারণে রাজ্য সরকার মানুষকে আবাস যোজনার বাড়ি দিতে পারছে না অভিযোগ করে মমতা বলেন, “কেন আবাসের বাড়ি এখন করতে দিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন, বিজেপি বললে তবে ছাড়বেন টাকা। এটা তো প্রশাসনের সিদ্ধান্ত। নির্বাচন বিধি লাগু আছে তাই এখন তো কিছু বলতে পারি না। এখন বিজেপির পার্টি অফিস থেকে ফোন করে বলছে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলিকে আমরাই ঠিক করে দেব। কমিশনকে অনুরোধ, বিষয়টা ঝুলিয়ে রাখবেন না।”
লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনকেও প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও একটা বহু ব্যবহৃত কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এমনিতেই বাংলায় সাত দফায় ভোট ফেলায় কমিশনের উপরে বেজায় খাপ্পা তৃণমূল। তার উপর প্রতিটি বুথ থাকবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনের উপরে যাতে শাসকদলের প্রভাব না থাকে, সেই লক্ষ্যে একের পর এক কড়া পদক্ষেপ করে চলেছে নির্বাচন কমিশন। এই সব কারণেই সভায় ভাষণ দিতে উঠলেই নির্বাচন কমিশনকে কটাক্ষ করা মমতা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে দলের লোকদের উষ্কাতে দেখা গেছে। বিধানসভা ভোটের চতুর্থ দফায় কোচবিহারের মাথাভাঙা মহকুমার শীতলকুচির জোড়পাটকি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫/১২৬ নম্বর বুথ দুষ্কৃতীরা দখল করতে গেলে সিআইএসএফ গুলি চালালে চারজনের মৃত্যু হয়েছিল। নিহতদের সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় তৃণমূলের যে লাভই হয়েছিল, পরবর্তী তিন দফার ফলই তার প্রমাণ। অনেকেই মনে করেন, নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর উষ্কানীমূলক বক্তব্যের পরিণতিতেই শীতলকুচির বুথে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল।
বৃহস্পতিবার মাথাভাঙার সভায় শীতলকুচির বুথে গুলি চলার ঘটনা উল্লেখ করতে ভোলেন নি মমতা। সেই সময় কোচবিহারের পুলিশ সুপার ছিলেন দেবাশিস ধর। শীতলকুচিকান্ডের পর থেকেই কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে ছিলেন দেবাশিস। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য সরকার। যদিও লোকসভা নির্বাচনের আগে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বীরভূমে শতাব্দী রায়ের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন এই প্রাক্তন আইপিএস। শীতলকুচির বুথে গুলি চালনা ও কোচবিহারের প্রাক্তন এসপির কথা উল্লেখ করে এ’দিন মমতা বলেন, “ভুলে গিয়েছেন! নির্বাচনের সময় শীতলকুচিতে লাইনে দাঁড়ানো পাঁচ জনকে গুলি করে মেরেছিল। এর মধ্যে চার জন সংখ্যালঘু এবং একজন রাজবংশী ভাই ছিলেন। নির্বাচন চলাকালীন ছুটে এসেছিলাম। যে লোকটির নির্দেশে এই কাজ হয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের দু’টি ডিপি চলছে, ভিজিল্যান্স ক্লিয়ার হয়নি, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে ক্লিনচিট দিয়ে দিয়েছে। আইনকানুন কিছু মানে না এরা।”
মমতা আরও বলেন, , “তিনি আবার বীরভূমে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। শীতলকুচিতে গুলি চালিয়ে, এত মানুষ মেরে এখনও হাতের রক্ত মোছেনি। এখন বলছে, ‘আমি ওখানের এসডিপিও’ ছিলাম। সো হোয়াট? কেউ ওসি, কেউ কনস্টেবল, কেউ সিভিক, কেউ এসপি, কেউ ডিএম হতে পারেন। তাই বলে আমার অধিকার নেই কোনও দলের দালালি করে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেব। দু’টো ডিপি আছে, ভিজিল্যান্স মামলা রয়েছে। রাজ্য সরকার আপত্তি জানানো সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে ক্লিনচিট দিয়েছে। আমি জানি না কেন্দ্রের সরকার কোনও আইন, সংবিধান মানে কি না। ওদের একটাই আইন, ওয়ান নেশন অ্যান্ড ওয়ান পলিটিক্যাল পার্টি। নির্বাচন এলেই ভাঁওতা দেওয়া, ছলনা করা, মিথ্যে কথা বলা।” যদিও শীতলকুচির বুথে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছিলেন বুথের নিরাপত্তায় নিযুক্ত সিআইএসএফ জওয়ানেরা। গুলি চালানোর নির্দেশ এসপির কাছ থেকে আসে নি। ইভিএম ছিনতাই হওয়ার মতো পরিস্থিতি দেখা দিলে ইভিএমের সুরক্ষায় থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা গুলি চালাতে পারবেন, এমনই নির্দেশিকা নির্বাচন কমিশনের। তারপরেও মাথাভাঙায় দাঁড়িয়ে শীতলকুচিতে গুলি চালানোর দায় দেবাশিস ধরের উপরেই চাপিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কোচবিহারের সংখ্যালঘু ভোট নিশ্চিত করতেই জেলার প্রাক্তন এসপির বিরুদ্ধে মমতার এই মিথ্যা অভিযোগ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নিশীথের কেস সব বলে দেবো?
কোচবিহারে বিজেপির প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক। কেন্দ্রীয় ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীও নিশীথ। উনিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল থেকে বেরিয়ে এসে বিজেপিতে যোগ দিয়ে পদ্ম প্রতীকে ভোটে দাঁড়িয়ে বড় ব্যবধানে ঘাসফুলকে হারিয়েছিলেন নিশীথ প্রামাণিক। এই মুহূর্তে নিশীথ উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর অন্যতম রাজনৈতিক মুখ। এদিন মাথাভাঙার সভায় নাম না তুলে নিশীথকে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, “আরও একজন বাবু আছে। আমরা দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের দলে ছিল আপদ। আর এখন বিজেপিতে গিয়ে হয়েছে সম্পদ। তোমার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আছে বলে দেব? সমস্ত কেস বলে দেব।’’ ফাইল খুলব ফাইল খুলব বলে অনেক বিরোধী নেতাকেই খোলা মঞ্চ থেকে মমতা হুঁশিয়ারি দিয়ে থাকেন। যদিও ১৩ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফাইলও খুলতে পারে নি বলে বিরোধীদের কটাক্ষ। ভোটের মাঠে নিশীথ প্রামাণিকের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী তেমনই একটা ফাঁকা আওয়াজ ছাড়লেন বলে মনে করছেন অনেকে।
Feature image- collected.