অপশন এ
, আপনি ফিচারটি পড়ে ফেলতে পারেন। অপশন বি, আপনি না পড়ে মাত্র ৫ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডে নিচের এমবেডেড ভিডিওটিতেও ক্লিক করে ফিচারটি দেখে নিতে পারেন-👇
ইনফোয়ানা ফিচার: প্রেমের ঋতু বসন্তে এক বাঙালি কন্যার দুরন্ত প্রেমের গল্প। সাতাষট্টি বছর আগের যে পরকীয়া প্রেম এখনও মানুষের মনে বিস্ময় জাগাতে বাধ্য। সে সময়ের রক্ষণশীল সমাজে একটা শোরগোল উঠেছিল বটে। কিন্তু সেই শ্যামাঙ্গিনী-সুন্দরী বাঙালি কন্যা তথা বধূ ও তার ফিল্ম ডিরেক্টর বিদেশি প্রেমিকের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, তখন হাতে হাতে ইন্টারনেট আর সোস্যাল মিডিয়া ছিল না।
তবে যে যুগে অভিভাবকদের চোখে ছেলে-মেয়ের প্রেম করাটাই ছিল অপরাধ, সেই যুগে বাঙালি ঘরের বউ, স্বামী-সন্তান ফেলে জগদ্বিখ্যাত বিদেশি ও বিবাহিত প্রেমিকের সঙ্গে যাকে বলে এক্কেবারে ‘ভাগলবা’! সত্যি বলতে কী, সোনালি ও রোসেলিনির বাস্তবের প্রেম সিনেমার কল্প কাহিনীকেও হার মানায়।
পুরো নাম রবার্তো গ্যাস্টোন জেফিরো রোসেলিনি-ইতালির প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও নিও রিয়ালিজম সিনেমার অন্যতম পথিকৃৎ। সময়টা ১৯৫৭। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর আমন্ত্রণে ভারতে এসেছিলেন রোসেলিনি। সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের উপরে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব রোসেলিনিকে দিয়েছিলেন নেহেরু।
বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক হরিসাধন দাশগুপ্ত তখন ৩৪ বছরের যুবক। তথ্যচিত্র পরিচালক হিসেবে দেশে হরিসাধনের খ্যাতি তখন যথেষ্টই। ফিল্মের কাজে রোসেলিনিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। মুম্বাইতে রোসেলিনির সঙ্গে হরিসাধনের সাক্ষাৎ। পাশে বিদূষী ও সুন্দরী স্ত্রী সোনালি।
বেনারসের বনেদি বাঙালি পরিবারের মেয়ে সোনালি সেন রায়ের শিক্ষা শান্তিনিকেতনে। সোনালির যখন বয়স বছর কুড়ি, তখনই হরিসাধন দাশগুপ্তর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির সোনালি ছিলেন একাধারে অনবদ্য সুন্দরী ও মেধাবিনী। সাহিত্য, সঙ্গীত, সিনেমা, চারুকলা এবং হস্তশিল্প- সবেতেই বেশ ভাল দখল রাখতেন তিনি। নিজের ফিল্ম শুটিংয়ের কাজে হরিসাধনের পাশাপাশি সোনালিরও সহযোগিতা পেতে থাকেন রবার্তো রোসেলিনি। কাজ করতে করতেই দু’জনের কাছে আসা, ঘনিষ্ঠতা এবং প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়া। যখন জানাজানি হল, তখন দুনিয়া তোলপাড়। কারণ প্রেমটা ছিল সমাজের চোখে অবৈধ।
রোসেলিনির তখন ৫১। ঘরে বউ-বাচ্চা সবই আছে। স্ত্রী আর কেউ নন, বিশ্ববিখ্যাত সুইডিশ অভিনেত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যান। সোনালি দাশগুপ্ত সবে সাতাশে। দুই সন্তানের জননী। বড় ছেলে রাজা ছয় বছরের বালক। ছোট ছেলে অর্জুন ১১ মাসের শিশু। তখনও দেশে টেলিভিশনেরই চল হয় নি, ইলেকট্রনিক মিডিয়া তো দূর কি বাত। ইন্টারনেট আর সামাজিক মাধ্যমের কথা স্বপ্নেও ভাবে নি মানুষ। মিডিয়া বলতে খবরের কাগজ আর সাপ্তাহিক পত্রিকা। আর ছিল হাতে গোনা কয়েকটি ফিল্মি ম্যাগাজিন।
রোসেলিনি-সোনালির প্রেমের কথা জানাজানি হতেই তখনকার সংবাদপত্রের সম্পাদকমশাইরা সেই রসালো খবর লুফে নিতে ভুললেন না। মুম্বাইয়ের ফিল্মি ম্যাগাজিনে ফলাও করে সেই লাভস্টোরি ছাপানো হল। রবার্তো রোসেলিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ডিরেক্টার। তার উপর, ওয়ার্ল্ড ফেমাস অভিনেত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যানের স্বামী। আরব সাগর ছাপিয়ে আমেরিকা-ইউরোপের কাগজে কাগজেও সেই কেচ্ছা বাদ গেল না। হরিসাধন ও সোনালির পারিবারিক ও পরিচিত মহলে ঢি-ঢি পড়ে গেল।
সেই ঝঞ্ঝা কীভাবে সামলে ছিলেন অন্তর্মুখী সোনালী, আমরা কেউই তা জানি না। বাইরে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে তোলপাড় চললেও না রোসেলিনি না সোনালি- পিছিয়ে আসেন নি কেউই। কে আগে কাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, কে জানে! তবে সমাজ ও সংসারের নিন্দা-কলঙ্ক মাথায় নিয়েই বিদেশি প্রেমিকের হাত ধরে স্বামীর ঘর ও দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই বঙ্গ ললনা।
১৯৫৭-র অগাস্টে বড় ছেলেকে ফেলে রেখেই ১১ মাসের ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে গোপনে ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি দেন সোনালি। সেই ডামাডোলে দেশ ছেড়ে বেরোনো সোনালি দাশগুপ্তর জন্য মোটেই সহজ ছিল না। শান্তিনিকেতনে পড়ালেখার সূত্রে ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। শোনা যায়, একদিকে মেয়ে ইন্দুর আব্দার রাখতে অন্যদিকে রোসেলিনির মান রাখতে রাতারাতি সোনালি ও তাঁর শিশুসন্তানের পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু স্বয়ং। তখনও ভারতে ফিল্মের কাজ শেষ হয় নি রবার্তো রোসেলিনির। বাঙালি প্রেমিকাকে প্যারিসের ফ্লাইটে তুলে দিয়ে পরে প্যারিস থেকে প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে রোমে ফেরেন এই বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক।
সেই বছরই রবার্তো গ্যাস্টোন জেফিরো রোসেলিনিকে বিয়ে করে বাঙালি সোনালি হয়ে ওঠেন সোনালি রোসেলিনি। বাঙালি বিদূষী সোনালি ও ইতালিয়ান বিখ্যাত পরিচালক রোসিলিনির দাম্পত্য স্থায়ী হয়েছিল ১৬ বছর। তাঁদের সন্তানের নাম রাফায়েলা পলা। রবার্তো রোসেলিনির জীবনে তিন নারী। একমাত্র বাঙালি সোনালির সঙ্গেই দীর্ঘ দাম্পত্য পার করেছেন তিনি।
রোসেলিনি পৃথিবী ছেড়েছেন অনেক আগেই। বুকে অভিমান নিয়ে ১৯৯৬-এর ১৯ অগাস্ট শান্তিনিকেতনেই চিরবিদায় নিয়েছেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। সেন রায় থেকে দাশগুপ্ত, দাশগুপ্ত থেকে রোসেলিনি হয়ে ওঠা সোনালী রোমে প্রয়াত হয়েছেন ২০১৪ সালের ৭ জুন। কালের নিয়মে চরিত্ররা সকলেই অদৃশ্য। কিন্তু তাঁদের ঘিরে রচিত ভাঙাগড়ার প্রণয় কাহিনী রয়ে গেছে। সোনালি ও রোসেলিনির বেপরোয়া প্রেমকে মহৎ বলার সুযোগ নেই। বিতর্কিত তো বটেই এমনকি কারও কারও চোখে ডীষণ মন্দও। তবে প্রেমে পড়লে দুনিয়ায় কে কবে পাবলিকের গালমন্দের তোয়াক্কা করে। আসলে সোনালি তাঁর দেহের উচ্চতার মতোই জীবনযাপনেও ছিলেন ব্যতিক্রমী।
Feature graphic design- SDM.
Video Credit- Infoyana YouTube channel.