বিশেষ প্রতিবেদন: নীতিশ কুমারই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী থাকছেন তবে সরকারের রংটা কেবল বদলে যাচ্ছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৮ জানুয়ারিই নাকি ফের এনডিএ জোটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারেন নীতিশ। এদিকে ন্যায়যাত্রায় রাহুল পথে। বাংলায় ঢুকে পড়েছে ন্যায়যাত্রা। রাহুল বিহারে ঢোকার আগেই নীতিশ কুমার ‘ইন্ডিয়া’ জোট ছেড়ে ভাগলবা! ২০১৫-র ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শিতে নীতিশ কুমার। এই নয় বছরে জোটসঙ্গীদের সঙ্গে নীতিশের বারেবারে ছাড়াছাড়ি হলেও কুর্শি নীতিশকে কখনও ছেড়ে যায় নি। অর্থাৎ, বিহারে সরকারের রঙ যাই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর মুখ একজনই এবং তিনি নীতিশ কুমার, এটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
এই নিয়ে চারবার জোটসঙ্গী উল্টেপাল্টে নিজের মুখ্যমন্ত্রীর চাকরি দিব্যি বাঁচিয়ে রেখেছেন নীতিশ। তাঁর মতো কামিয়াব পলিটিশিয়ান দেশ খুব কম পেয়েছে, এই কথা না মেনে উপায় নেই। আজকের দিন পর্যন্ত নীতিশ যে সরকারের মুখ্যমন্ত্রী, তার নাম ‘মহাগঠবন্ধন’ সরকার। নীতিশের জেডিইউ, লালু-তেজস্বীর আরজেডি, কংগ্রেস ও বামেরা মিলে সরকারটি গঠিত হয়েছে। ২০২২-এর অগাস্টে বিজেপি বা এনডিএর হাত ছেড়ে নীতিশ যখন আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলান, তখনই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছিল, এই মিলন কতদিনের? নীতিশের বর্তমান মন্ত্রিসভায় লালুপুত্র তেজস্বী উপমুখ্যমন্ত্রী। লালু ও নীতিশ- দু’জনেই সত্তরের দশকে জয়প্রকাশ নারায়ণ পরিচালিত বিহারের ভ্রষ্টাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রোডাক্ট। জেপির দুই শিষ্যে বনিবনা নেই নব্বুইয়ের দশক থেকেই। বলতে গেলে লালু-নীতিশে সাপে-নেউলে সম্পর্ক।
পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খেটে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতাটুকুও খুইয়েছেন লালুপ্রসাদ যাদব। ছোটছেলে তেজস্বীপ্রসাদের হাতেই দলের রাশ তুলে দিয়েছেন অসুস্থ লালু। লালু দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। নীতিশ হয়েছেন পাল্টিবাজ দ্য গ্রেট। ২০২০-এর বিধানসভা নির্বাচনে প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ায় নীতিশকুমারের ক্ষমতায় ফেরার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। ২০০৫-এ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দক্ষ প্রশাসক হিসেবে যে ক্যারিশ্মা নীতিশ অর্জন করেছিলেন, ততদিনে তা নিঃশেষিত। স্রেফ নিজের ম্যাজিক দেখিয়ে এনডিএ জোটকে পাটনার গদিতে ফিরিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। আসন সংখ্যায় তিন নম্বরে থেকেও বিজেপির বদান্যতায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নীতিশ। কিন্তু চেয়ারে বসার পর থেকেই তাঁর উশখুশ উশখুশ ভাব। ২০২২-এর ৯ অগাস্ট এনডিএ জোট থেকে নিজের দল জেডি ( ইউনাইটেড)কে বের করে এনে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন নীতিশ। পরদিন আরজেডি, কংগ্রেস ও বামেদের সঙ্গে নিয়ে মহাগঠবন্ধন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ফের শপথ নেন তিনি।
জনপ্রিয়তা ও শক্তি তলানিতে ঠেকার পরেও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কীভাবে জোটসঙ্গী উল্টেপাল্টে ক্ষমতায় থাকতে হয়, সেই খেলাই সফলভাবে খেলে যাচ্ছেন নীতিশ। এমন ধুরন্ধর তো বটেই এমনকি ভাগ্যবান রাজনীতিক বিহারে কেন, ভারতেও খুব কম এসেছে। জোটসঙ্গী বদল করার মাস কয়েক আগে থেকেই আভাস দিতে শুরু করেন নীতিশ। তার আগেই তিনি পরবর্তী জোটসঙ্গীদের সঙ্গে বোঝাপড়া সেরে রাখেন। খুব সম্ভবত, তিনি সারা বছরই সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। এ’বারও দিন কয়েক হল নীতিশ বেসুরো। সকল বিরোধী দলকে এক করে জোট গঠনের ব্যাপারে প্রথম দিকে নীতিশের উৎসাহের অন্ত ছিল না। জোটের প্রথম বৈঠকটিও হয়েছিল পাটনায়। তবে বেঙ্গালুরুতে ‘ইন্ডিয়া’ নামে বিরোধীদের জোট গঠন হওয়ার পর থেকেই চালু নীতিশ বুঝে যান, সময় থাকতে মানে মানে এদের সঙ্গ ত্যাগ করাই ভাল।
২৪৩ সদস্যের বিহার বিধানসভায় নীতিশের দলের হাতে মাত্র ৪৫ বিধায়ক। আরজেডির ৭৯ এবং বিজেপির ৭৮। ম্যাজিক ফিগার ১২২। লালুপ্রসাদের তবিয়তের হাল খুব একটা ভাল নয়। থাকতে থাকতেই পুত্র তেজস্বীকে পাটনার কুর্শিতে দেখে যেতে চান লালু। উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বীর মনে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার উচাটন উঠতেই বিজেপির ভেতরে থাকা মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন নীতিশ। সময়টা মোক্ষম। লোকসভা নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে বিহারে জোট সরকারের পতন ঘটানোর এতবড় সুযোগ যে মোদী-শাহ হাতছাড়া করবেন না, নীতিশের চেয়ে ভাল তা আর জানেন কে। একটা কথা মানতেই হবে, নীতিশ যতই খেয়াল খুশি মতো পার্টনার চেঞ্জ করুন না কেন, নীতিশের বিজেপি জ্যাক অত্যন্ত শক্ত। বাজপেয়ী-আদবানি জামানা থেকেই নীতিশের সঙ্গে বিজেপির ভাল বোঝাপড়া। মাত্র ৪৫ বিধায়ক নিয়ে নীতিশ জোট পাল্টে পাল্টে আরও কতদিন মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারেন, এটাই একটা দেখার জিনিস।
Feature image is representational.