আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরান ও পাকিস্তান- প্রতিবেশী দুই মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ লাগার পরিস্থিতি। শিয়া প্রধান ইরানের সঙ্গে সুন্নি প্রধান পাকিস্তানের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই খারাপ। পাকিস্তানের ভূখন্ডে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সুন্নি চরমপন্থীরা তাদের দেশে গোলযোগ সৃষ্টি করছে বলে ইরানের অভিযোগ। তালিবান শাসিত আফগানিস্তানই হোক আর শিয়াপন্থী মোল্লাদের দ্বারা পরিচালিত ইরান- পাকিস্তানের সঙ্গে করোরই বনিবনা হয় না। পাক-আফগান সীমান্তে মাঝেমধ্যেই দুই তরফে গোলাগুলি চলে এখন ইরানের সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চলেছে পাকিস্তান।
ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম বালুচিস্তান প্রদেশের ‘কোহ-ই-সবজ’ এলাকার একটি গ্রামে ইরানের মিসাইল ও ড্রোন হামলার মধ্য দিয়ে। ঘটনাস্থল পাকিস্তান-ইরান সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘তাসনিম’ জানিয়েছে, নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কোহ-ই-সবজ-এর কুলাগ গ্রামে দুটি জঙ্গি ঘাঁটি ছয়টি ড্রোন ও একাধিক ব্যালাস্টিক মিশাইল নিক্ষেপ করে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ‘রেভলিউশনারি গার্ডস’। ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘাঁটি দুটি সুন্নি জঙ্গি সংগঠন জইশ-আল-আদলের বলে ইরানের দাবি। যদিও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে বিধিবহির্ভূতভাবে বিমান হামলা চালিয়েছে ইরান। ঘটনায় দুই শিশু নিহত ও চারজন আহত হয়েছে বলে পাকিস্তানের দাবি।
জইশ-আল-আদলকে ইরানের ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকি বলে মনে করে তেহেরান। ইরানের মাটিতে এই সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-আল-আদল নামে কাজ করলেও পাকিস্তানে এর নাম জইশ-আল-ধুলম। গত মাসে ইরানের সিসতান ও বালুচিস্তান প্রদেশের একটি পুলিশ চৌকিতে হামলা চালিয়ে ১১জন পুলিশ কর্মীকে হত্যা করেছিল জইশ-আল-আদলের জঙ্গিরা। এর বদলা নিতেই পাকিস্তানের ভূখন্ডে থাকা জঙ্গি সংগঠনটির ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে বলে ‘তাসনিম’ জানিয়েছে। পাকিস্তান সীমান্তে সংলগ্ন সিসতান ও বালুচিস্তান প্রদেশকে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় জইশ-আল-আদল। বুধবারও এই প্রদেশের ‘ইরানশা’ শহরের উপকণ্ঠে ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডস’-এর একটি পিকআপ ট্রাকে হামলার দায় স্বীকার করেছে জইশ-আল-আদল। ঘটনায় আইআরজি-র এক কর্নেল নিহত হয়েছেন বলে স্বীকার করেছে ইরান।
কোহ-ই-সবজে ইরানের ড্রোন ও মিসাইল হামলার জেরে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে পাকিস্তান সরকার। নিজেদের ভূখন্ডে ইরানের হামলার প্রতিবাদে তেহেরান থেকেও নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে পাকিস্তান। বদলা নিতে বুধবার রাতেই ইরানের সিসতান ও বালুচিস্তান প্রদেশের একটি গ্রামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। হামলায় চার শিশু সহ সাতজন নিহত হয়েছে বলে সিসতান–বেলুচিস্তান প্রদেশের উপপ্রাদেশিক গভর্নর আলিরেজা মারহামাতির জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদিও দাবি করেছে, নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কেবল একটি জঙ্গিঘাঁটি লক্ষ্য করেই সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। এতে কয়েকজন সন্ত্রাসবাদী হতাহত হয়েছে বলে পাকিস্তান জানিয়েছে।
নিজেদের ভূখন্ডে ইরানের হামলার জেরে পাকিস্তানে ক্ষোভে ফুঁসলেও পাত্তা দিচ্ছে না ইরান। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে যোগ দিতে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আবদোল্লাহিয়ান এখন সুইৎজ়ারল্যান্ডের দাভোসে। দাভোস থেকে হোসেন আমির-আবদোল্লাহিয়ান জানিয়েছেন, “আমরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতাকে অবশ্যই সম্মান করি। কিন্তু নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে আমরা কখনোই আপোষ করি না। জাতীয় স্বার্থের উপরে আঘাত এলে জবাব দিতে দ্বিধা করি না আমরা।”
ইরান ও পাকিস্তান- দুই দেশকেই বড় কৌশলগত অংশীদার ও বন্ধু মনে করে চিন। দুই বন্ধুর মধ্যে সংঘাত বেঁধে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন বেজিং। দুই পক্ষকেই সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে চিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রক। ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র বলেছেন, “বিষয়টা ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যেকার দ্বিপাক্ষিক হলেও সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতেই বিশ্বাস করে ভারত।” চিনের সঙ্গে গভীর সখ্যতা থাকলেও ভারতের সঙ্গে বরাবর সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলে ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক ইরান। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ায় দিল্লির প্রতি তেহেরানের নির্ভরতা আরও বাড়বে বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল।
Feature image is representational.