বিশেষ প্রতিবেদন: এমন নয় যে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোর আগে নামডাক ছিল না। প্রদীপ ঘোষ যখন দাপটে কংগ্রেস করতেন তখনও কলকাতার সেরা দশটি পুজোর তালিকায় শিয়ালদহের সন্তোষ মিত্রের জায়গা ছিল। কিন্তু দাপুটে বাবাও যা পারেন নি তেইশের পুজোয় তাই করে দেখালেন ছেলে সজল ঘোষ। নগর কলকাতায় এখন বড় পুজো মানেই তৃণমূলের একচেটিয়া আধিপত্য। একমাত্র ব্যতিক্রম সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার বা লেবুতলা পার্ক। তবে এবার সুজিত বসুর শ্রীভূমিই হোক অরূপ বিশ্বাসের সুরুচি সংঘ কিম্বা ববি হাকিমের পাড়ার পুজো চেতলা অগ্রণী সংঘ- সবার গাত্রদাহের কারণ হওয়ার জন্য বিজেপির সজলের সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার একাই যথেষ্ট। দেবীপক্ষের দ্বিতীয়ার দিন থেকেই সজল ঘোষের পুজো ভিড় আর প্রচারের আলো এমনভাবে টেনে নিচ্ছে যে বাকিদের একটু হিংসে না হয়ে পারেই না।
তেইশের শারদীয়া দুর্গাপুজোয় সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের থিম অযোধ্যার ‘রামমন্দির’। ‘মাস্টার স্ট্রোক’ বলতে অভিধানে যা বোঝায়, থিম নির্বাচনে নিঃসন্দেহে তার স্বাক্ষর রেখেছেন সজল। আগামী ২৪ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন হওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত দিয়ে। সেই রামমন্দিরের আদলে দুর্গাপুজোর মন্ডপ তৈরীর সিদ্ধান্ত নিয়ে এক ঢিলে অনেক পাখি মেরেছেন ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের এবারের থিম জানাজানি হতেই জনে জনে আগ্রহ। পিতৃপক্ষেই বোঝা যাচ্ছিল তেইশের শারদোৎসবে বড় ধামাকা না মাচিয়ে ছাড়বেন না সজল। গৈরিক শিবিরের কাছে রামমন্দির নামটাই একটা চুম্বক। যার টানে শত ব্যস্ততার মধ্যেও সজল ঘোষের পুজোর উদ্বোধনে ছুটে আসতে হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। দ্বিতীয়াতে অমিত শাহকে দিয়ে মন্ডপের উদ্বোধন করিয়ে সেই যে এগিয়ে গেছেন সজল, মহাষ্টমীর শেষ রাতেও সন্তোষ মিত্রের কাছে বাকিদের অবস্থা ‘দে অলসো রান’ গোছের।

এটা তো সত্যি, কলকাতা মহানগরীর পুজোয় বিজেপির একা কুম্ভ সজল ঘোষ। কিন্তু একাই কীভাবে একশো হয়ে উঠতে হয়, সেই প্রমাণ রাজনীতির মঞ্চে আগে কয়েক বার দিয়েছেন প্রদীপপুত্র। এবারে দিলেন পুজোতে। বাঙালির সবথেকে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয়া দুর্গাপুজো ঘিরে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রদর্শন নতুন নয়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর এই জিনিস আরও বেড়েছে। আরও অনেক কিছুর মতোই পুজোতেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ছাড় দিতে রাজি নন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সজল ঘোষের নেতৃত্বে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার শুধু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েই নেই, এ’বছর সুজিত-অরূপ-ববির মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে প্রচারের আলোর বেশিটাই একা কেড়ে নিয়েছে সজলের পুজো।

পুজো উদ্বোধনের পর থেকেই সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে দর্শনার্থীদের ঢল। দিন যত গড়িয়েছে মানুষের ভিড় তত বেড়েছে। পঞ্চমীতে প্লাবন। ষষ্ঠীতে জনজোয়ার। সপ্তমীতে সুনামি। মহাষ্টমীর রাত গড়িয়ে নবমীর ভোরেও সন্তোষ মিত্রের ভিড়ে ভাঁটার টান নেই। কলকাতা ও আশপাশ ছাপিয়ে গোটা রাজ্যের মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে লেবুতলা পার্কের রামমন্দির। সপ্তমীতে ঘুরে গেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। ষষ্ঠীতে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে এসে মায়ের মুখ ও মন্ডপ দর্শন করেছেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানমেরও লেবুতলা পার্কে এসে ঠাকুর দেখা সারা। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের রামমন্দিরে ছুটে এসেছেন যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি তেজস্বী সূর্যও। সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীর কথা আলাদা। সজলের পুজোকে নিজেদের পুজো বলেই মনে করছেন সুকান্ত-শুভেন্দু। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা বিশেষ উদ্যোগ না নিলে চার রাজ্যে ভোটের কাজ ফেলে শাহ সন্তোষ মিত্রে পুজোর উদ্বোধনে আসতেন না বলেই অনেকের ধারণা।
সাফল্যেও সজল ঘোষ অবশ্য বিনয়ী। মা দুর্গার আশীর্বাদেই সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজো সকলের মন কেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু এটাও তো মানতে হবে, যাঁর উদ্যম আছে কেবল তাঁর মাথাতেই মায়ের আশীর্বাদ বর্ষিত হয়। এই উদ্যমের জোরেই চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও একুশের ডিসেম্বরে কলকাতার পুরভোটে তৃণমূলের কাছ থেকে ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন সজল ঘোষ। মিথ্যে মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েও লেবুতলার সজলকে দমাতে পারে নি শাসকদল। তিনি যে দল এখন করেন, তাতেও কাঁকড়ার অভাব নেই। তারপরেও অল্প সময়ের ভেতরেই রাজ্য বিজেপির বড় মুখ হয়ে উঠেছেন সজল। শারদোৎসবে যে উদ্যমে মেরে খেলে তিনি বড় রান তুলে তৃণমূলের বাঘা বাঘা নেতাদের স্কোরকেও ছাপিয়ে গেলেন; তাতে মা সহায় হলে আগামীতে সজল ঘোষের রাজনীতির ‘ইনডেক্স’ আরও ঊর্ধ্বগামী হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।