অরুণকুমার: শরৎ মানেই সুন্দর। ভক্তের বিশ্বাস, জগজ্জননীকে ধরায় বরণ করার জন্যই এমন অনবদ্য অনুপম হয়ে ওঠে প্রকৃতি। চিরসুন্দরী দার্জিলিং পাহাড়েও শরৎ আসে আলোর ঝর্ণাধারা হয়ে। দার্জিলিং বাংলার শৈলরাণী। শরতে পাহাড়ের অপরূপ রূপ দু’চোখ ভরে দেখতে দার্জিলিঙে এখন পর্যটকদের ঢল। পর্যটকদের একটা বড় অংশই বাঙালি। দার্জিলিং পাহাড় হচ্ছে বাঙালির প্রিয় সেই টুরিস্ট স্পট, যেখানে পুজোয় বেড়াতে গেলেও ঢাকের আওয়াজ, মাদুর্গার মুখ মিস হয় না। পাহাড়ে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন তো হয়ই পথে বেরিয়ে মন্ডপে গিয়ে মাকে দেখা, অঞ্জলি দেওয়া এমনকি মহাষ্টমীর ভোগ খাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে যায় বাঙালিদের।
যেভাবে সমতল বাংলা শরতে আনন্দময়ীর প্রত্যাশায় দিন গোনে ঠিক সেভাবেই দিন গোনে পাহাড়ও। গিরিরাজের কন্যা উমা কৈলাসবাসী শিবের ঘরণী। ঘরের মেয়ে ঘরে আসায় পাহাড় জুড়ে আনন্দের হিল্লোল বইবে না তো বইবে কোথায়। দার্জিলিং জুড়ে এখন দুর্গাপুজোর আমেজ। নেপালি-বাঙালি মিলেমিশে মেতে উঠেছেন দেবীদুর্গার আরাধনায়। দার্জিলিং পাহাড়ের সবথেকে প্রাচীন দুর্গাপুজোটি এ’বার ১০৯ বছরে পা দিল। দার্জিলিং থানার পাশেই মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ হল। ১৯১৪ সালে এখানে প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেন স্থানীয় বাঙালিরা। আগে হলটির নাম ছিল ‘বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন হল’। পরে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের নামে হলটির নাম পাল্টে হয় ‘নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হল’। হলের জমিটি মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে দান হিসেবে পেয়েছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। হলটি প্রথমে কাঠের ছিল বলে জানা যায়। আগুনে সেটি ভস্মীভূত হলে বর্ধমানের মহারাজা হরেকৃষ্ণ মহতাব ও অন্যান্য ধনাঢ্য বাঙালিদের অর্থানূকুল্যে বর্তমান ভবনটি নির্মিত হয়েছে।
নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের দুর্গাপুজো বরাবরই আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপিত হয়ে আসছে। দার্জিলিং শহরের বাঙালিহিন্দু সম্প্রদায় পুজোর আয়োজক হলেও এতে হাত মেলান নেপালিভাষীরাও। এক সময় পুজোয় পাহাড়ে বেড়াতে আসা বিশিষ্ট বাঙালিরাও কটা দিন নৃপেন্দ্রনারায়ণ হলের দুর্গাপুজোয় মেতে উঠতেন। বর্ধমানের মহারাজারাও এই পুজোয় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হল দুর্গাপুজো কমিটির বর্তমান সম্পাদকের নাম ডা: প্রতাপাদিত্য গুহ। পেশায় চিকিৎসক প্রতাপাদিত্যবাবুর তিন পুরুষের নিবাস দার্জিলিঙে। দার্জিলিং বেঙ্গলি সোসাইটির সম্পাদকের দায়িত্বেও তিনি। প্রতাপাদিত্যবাবুর কাছ থেকে জানা গেল, ব্রিটিশ আমলে সমতলবাসী অজস্র বাঙালি জীবিকার কারণে শৈলরাণী দার্জিলিঙে এসে আর ফিরে যান নি। এদের উদ্যোগেই তৈরি হয় ‘বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন’। বাঙালি এবং দুর্গা পুজো সমার্থক। বাঙালি যে মুলূকেই যাক, কালীমন্দির বানায় আর দুর্গাপুজোর প্রচলন করে। ১৯১৪ সাল থেকে দার্জিলিং পাহাড়ে দুর্গাপুজার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন। এর আগে দার্জিলিং পাহাড়ে সামাজিকভাবে শারদীয়া দুর্গাপুজোর আর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
সেই আমলে দার্জিলিং বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিমা আসত শিলিগুড়ি থেকে টয়ট্রেনে চেপে। ঢাকিরা আসতেন নদীয়া জেলা থেকে। পুজোর সামগ্রীর কেনাকাটা করতে বারেবারে নামতে হত সমতলে। মহাষ্টমীর পুজো শেষে নৃপেন্দ্রনারায়ণ হলের অন্নভোগ ছিল রীতিমতো বিখ্যাত। ভোগের খিচুড়ি পেতে পুজোস্থলে ভেঙে পড়ত গোটা শৈলশহরের মানুষ। প্রসাদ বিতরণে হাত লাগাতেন বর্ধমানের মহারাজা হরেকৃষ্ণ মহতাব ও তাঁর সহধর্মিণীও। নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের দুর্গা পুজোর বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানও ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। হল থেকে প্রতিমা কাঁধে নিয়ে শোভাযাত্রা করে শহর পরিক্রমা শেষে সবাই যেতেন কাকঝোড়াতে। ঝোড়ার জলে প্রতিমা নিরঞ্জন পর্ব সাঙ্গ করে হলে ফিরতেন সকলে মিলে। সেখানে বিজয়া সম্মিলনীতে কোলাকুলি, শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে চলত মিষ্টিমুখের পালা।
নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের পুজো আগের জৌলুস হারালেও ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না উদ্যোক্তারা। দেবী প্রতিমা বরাবরের মতো এ’বারও শিলিগুড়ি শহরের কুমোরটুলি থেকে এসেছে। নিয়ম-নিষ্ঠায় কোনও আপোষ নেই বেঙ্গলি হিন্দু হলের দুর্গাপুজোয়। এখনও এই পুজোর ভোগের খিচুড়ির একটা আলাদা আকর্ষণ আছে দার্জিলিং শহরের মানুষের কাছে। আগে বসিয়েই ভোগ খাওয়ানো হত। এখন হাতে হাতে বক্স তুলে দেওয়া হয়। মহাষ্টমী তো বটেই সপ্তমী-নবমীর দুপুরেও প্রসাদ না নিয়ে কেউ ফেরেন না দার্জিলিং নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের পুজো থেকে। পুজোর চারদিনই সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকছে বলে জানিয়েছেন ডা: প্রতাপাদিত্য গুহ। এ’বারও মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জন শেষে পরম্পরা মেনে হলে আয়োজিত হবে বিজয়া সম্মেলনী।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম পার্ষদ ও সন্ন্যাসীশিষ্য স্বামী অভেদানন্দ ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে দার্জিলিঙে রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। চার বছর বাদেই মঠে শারদীয়া দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। প্রতিমা এসেছিল শিলিগুড়ি থেকে। এই পুজোয় স্বামী অভেদানন্দের নির্দেশে সন্ন্যাসী এবং জাতিবর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ এক পঙক্তিতে বসে প্রসাদ গ্রহণ করতেন বলে জানা যায়। এবারও দার্জিলিঙের স্বামী অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠিত মঠে নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে দেবী দুর্গার আরাধনা চলছে। দুর্গাপুজো হচ্ছে দার্জিলিঙের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমেও। ম্যাল, ঘুম , জোরবাংলো এবং সোনাদা সহ দার্জিলিং মহকুমা জুড়ে এই বছর মোট তিরিশটির বেশি পুজো হচ্ছে বলে স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
শৈলশহর দার্জিলিঙের সবথেকে বড় সর্বজনীন দুর্গাপুজোটি হয় শহরের কেন্দ্রস্থল ম্যালে। ১৯৯৯ সাল থেকে ম্যালের স্থায়ী মঞ্চে এই পুজোর শুরু। পাহাড়ে তখন সুবাস ঘিসিংয়ের জামানা। প্রথমদিকে দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল ( DGHC) ও দার্জিলিং পুরসভার হাতে ছিল পুজোর দায়িত্ব। একসময় প্রতিমা পুজো বন্ধ করে পাথর পুজো করার নির্দেশ দেন ঘিসিং। সুবাস ঘিসিংয়ের এই তুঘলকি কান্ডকারখানাকে মন থেকে মেনে নেন নি নেপালি-বাঙালি নির্বিশেষে পাহাড়ের কোনও সম্প্রদায়ের মানুষই। বিমল গুরুং জামানায় রাজনৈতিক অশান্তির জেরে ম্যালের পুজো কয়েক বছর বন্ধ ছিল। ২০১৭ থেকে ম্যালে ফের সাড়ম্বরে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছে। শরতের এই পর্যটন মরশুমে দার্জিলিঙের ম্যাল এমনিতেই জমজমাট। পুজো ঘিরে ‘ম্যাল’ চত্বর জুড়ে আনন্দের হাট বসে গেছে।
ফিচার ফটো- নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের দেবীপ্রতিমা। ফটো- প্রতিবেদক .