গাফিলতির কথা মানলেন ইজরায়েলের সেনাপ্রধান, যুদ্ধ শেষে তদন্তের আশ্বাস লে. জেনারেল হালেভির - nagariknewz.com

গাফিলতির কথা মানলেন ইজরায়েলের সেনাপ্রধান, যুদ্ধ শেষে তদন্তের আশ্বাস লে. জেনারেল হালেভির


আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শনিবার (৭ অক্টোবর) দক্ষিণ ইজরায়েলে হামাসের ভয়াবহ হামলায় এখনও পর্যন্ত ১৩০০ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। মৃতের সংখ্যা তার চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে বলে অনুমান ইজরায়েলি মিডিয়ার। কমপক্ষে ২০০ জনকে হামাসের যোদ্ধারা ধরে নিয়ে গিয়ে গাজা স্ট্রিপে বন্দি করে রেখেছে বলে সরকারিভাবে জানিয়েছে ইজরায়েল। ১৯৭৩-এর ইয়ম কিপুর যুদ্ধের পর গত পঞ্চাশ বছরে এতবড় হামলার মুখে আর পড়তে হয় নি ইজরায়েলকে। যে লৌহদৃঢ় নিরাপত্তা বেষ্টনী ও চৌকস গোয়েন্দা নজরদারির জন্য ইজরায়েল পৃথিবীতে বিখ্যাত, তার কী হল? সাধারণ ইজরায়েলি নাগরিকদের প্রশ্নের মুখে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার।

দোষ খুঁজব পরে এখন সময়টা যুদ্ধের

ইজিপ্টের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাছ থেকে ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ হামাসের সম্ভাব্য হামালার ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা পেয়েছিল বলে দাবি করেছেন আমেরিকান কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস’-এর পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ও রিপাবলিকান প্রতিনিধি মাইকেল ম্যাকল। সঙ্গত কারণেই ইজরায়েলের জনগণ কাঠগড়ায় তুলেছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রশাসনকে। সাধারণ ইজরায়েলিদের প্রশ্ন দেশের নিচ্ছিদ্র প্রতিরক্ষা ব্যূহ ও গোয়েন্দাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি গেল ক‌ই? এই পরিস্থিতিতে শনিবারের ঘটনার পর প্রথমবারের মতো সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ খুলেছেন ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেভি। বৃহস্পতিবার দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে বার্তা দিতে গিয়ে হামাসের হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন হালেভি। ইজরায়েলের সেনা প্রধান বলেন, “দেশ ও দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স-আইডিএফ’ দায়বদ্ধ। কিন্তু শনিবার সকালে গাজা স্ট্রিপ সংলগ্ন এলাকায় আমরা দায়িত্ব ঠিকভাবে সামলাতে পারি নি।” তবে লে. জেনারেল হালেভি মনে করেন, এখন কার‌ও দোষ খোঁজার সময় নয়। তিনি বলেন, “শনিবারের বিপর্যয় ও ব্যর্থতা থেকে আমরা অবশ্যই শিক্ষা নেবো। ঘটনার তদন্ত করব। কিন্তু এখন সময়টা কেবল যুদ্ধ করার।”

বৃহস্পতিবার দক্ষিণ ইজরায়েলে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন আইডিএফ প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারজি হালেভি। ফটো ক্রেডিট- ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স

যুদ্ধ বা যুদ্ধের মতোন পরিস্থিতি ইজরায়েলিদের কাছে নতুন কোন‌ও অভিজ্ঞতা নয়। তবে নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ইজরায়েল বরাবরই স্পর্শকাতর। দেশের জনগণের উপরে যে কোনও ধরণের আক্রমণ নেমে আসার আগেই তা প্রতিরোধে বিশ্বাস করে ইজরায়েলের নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি। উত্তরে লেবাননের হিজবুল্লাহ মিলিশিয়া ও দক্ষিণে গাজা স্ট্রিপের হামাসের আক্রমণের মুখে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী সর্বদা সতর্ক অবস্থায় থাকে। শনিবার ইজরায়েলের সবথেকে বড় ব্যর্থতা, তাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক আঁচ‌ই করতে পারে নি যে অবরুদ্ধ গাজা স্ট্রিপে বসে এতবড় অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে হামাস। অথচ ২০০৭-এ পিএল‌ও-কে হটিয়ে গাজার নিয়ন্ত্রণভার নেওয়ার পর থেকেই ইরান সমর্থিত হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলি বাহিনীর সংঘাত একটা নিয়মিত ঘটনা। গাজা ভুখন্ড থেকে হামাসের ছোঁড়া রকেটগুলিকে মাঝ আকাশেই অকার্যকর করতে ‘আয়রন ডোম’ নামের এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে ইজরায়েল। শনিবার ভোরে ইজরায়েলের ভূখন্ডে ঢোকার আগে ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট ছুঁড়েছে হামাস। সীমান্ত চৌকিগুলিতে যখন ইজরায়েলি সৈন্যরা ঘুমে, তখন স্থলপথে, জলপথে এমনকি প্যারাগ্লাইডিং করে ইজরায়েলের ভূখন্ডে ঢুকে পড়ে হামাসের এক হাজারের বেশি যোদ্ধা। হামাসের অতর্কিত আক্রমণের মুখে আইডিএফ-এর সৈনিকেরা যে হতচকিত হয়ে পড়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। হামাস ইজরায়েলে ঢুকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে অবাধে। সে’দিন ইজরায়েলি সেনা হামলা প্রতিরোধে সফল হলে এই বিপর্যয় এড়ানো যেত।

কিছু আভাস পেলেও গুরুত্ব দেন নি জেনারেলরা

হামাসের রকেট বৃষ্টি প্রতিরোধে আয়রন ডোম প্রযুক্তির ব্যর্থতার চাইতে ইজরায়েলিদের বেশি ক্ষুব্ধ করেছে হামলার আগাম খবর জানতে গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা অথবা জেনেও গুরুত্ব না দেওয়া ও হামলার মুখে তাদের সৈনিকদের অসহায় অবস্থা। বৃহস্পতিবার ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ‘চিফ অব স্টাফ’ মেনে নিয়েছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশের জনগণের যে চুক্তি রয়েছে তা বর্তমান সময়ে নাটকীয়ভাবে সবথেকে খারাপ অবস্থায়। তিনি বলেন, “ইজরায়েলের নাগরিকদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটি চুক্তি রয়েছে। বহু বছর ধরেই অনেক উত্থান-পতনের মধ্যেও নাগরিকদের সঙ্গে আমাদের চুক্তিকে আমরা রক্ষা করে চলেছি। কিন্তু বর্তমানে এই বিষয়ে আমরা নাটকীয়ভাবেই খুব খারাপ জায়গায় আছি।” সেনাপ্রধান অঙ্গীকার করেছেন, “এই চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করে নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তার সব‌ই আমরা করব।”

হামাসের রকেট হামলায় দক্ষিণ ইজরায়েলের আশকেলন শহরে জ্বলছে গাড়ি। ফটো- সংগৃহীত

গাজা স্ট্রিপের হামাস শিবিরে একটা কিছুর যে প্রস্তুতি চলছে, সেই আভাস শনিবারের ঘটনার কয়েক ঘন্টা আগে আইডিএফ-এর কর্তাদের কাছে পৌঁছেছিল বলে দাবি করেছে ‘চ্যানেল-১২’র একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, হামাসের আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা আগে কিছু ইঙ্গিত পেয়ে সেনাপ্রধান হাভেলি তাঁর কয়েকজন জেনারেলের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলেছিলেন। হাভেলি যাঁদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আইডিএফ-এর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান ইয়ারন ফিঙ্কেলম্যান ও সামরিক গোয়েন্দা দফতরের প্রধান আহারন হালিভা। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর জেনারেলরা হামাসকে যে কোন‌ও ধরণের জবাব দিতে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে ‘চ্যানেল-১২’র দাবি। শনিবার ভোরে ঘড়ির কাঁটা যখন ছ’টায়, তখন হামাস হামলা শুরু করে দেয়।

বৃহস্পতিবার ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারিও স্বীকার করে নিয়েছেন যে কিছু একটা “লক্ষণ” ছিল। তবে হামলার বিষয়ে বড় কোনও সতর্কতা থাকার কথা অস্বীকার করেছেন হাগারি। তিনি বলেছেন, “কোনও বড় সতর্কবার্তা আগে থেকে ছিল না। তবে হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কিছু ইঙ্গিত অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল।” শনিবারের ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে নজরে আসা ইঙ্গিতগুলি যে ভয়ঙ্কর কোন‌ও হামলার কারণ হতে পারে, ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর দুঁদে জেনারেলরাও তা ঠাহর করতে পারেন নি। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র মেনে নিয়েছেন, এটা ছিল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একটা ‘সারপ্রাইজ অ্যাটাক’, যার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না।

রাজনৈতিক অস্থিরতাই কি বিপর্যয়ের জন্য দায়ী?

হামাসের নৃশংসতার চিহ্নগুলি যত‌ই ইজরায়েলের নাগরিকদের সামনে আসছে, তত‌ই বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উপরে চাপ বাড়ছে। কয়েক বছর ধরেই ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে টানাপোড়েন চলছে। সরকার ঘন ঘন বদল হচ্ছে। সংসদে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অবস্থান‌ও খুব শক্তপোক্ত নয়। ফিলিস্তিন প্রশ্নে নেতানিয়াহুর দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট কঠোর হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নজরদারির অভাবে দেশের নিরাপত্তা কাঠামো ঢিলেঢালা হয়ে পড়ল কিনা, এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে ইজরায়েলের রাজনৈতিক মহল। এই পরিস্থিতিতে ইজিপ্ট থেকে হামলার সতর্কবার্তা পাওয়ার কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন নেতানিয়াহু। ইজরায়েলের সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ- এক, হামাসের শক্তিকে এমনভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া, যাতে ইরান সমর্থিত এই সশস্ত্র গোষ্ঠী আর কোনও দিন মাজা সোজা করে দাঁড়াতে না পারে। দুই, হামাসের হাতে বন্দি সামরিক-অসামরিক ইসরায়েলি ও বিদেশিদের অ‍ক্ষত ফিরিয়ে আনা ।সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হারজি হালেভি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, “বন্দিদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে সবকিছুই করা হবে।” গাজায় বিদ্যুৎ, পানীয় জল ও জ্বালানি- অত্যাবশ্যক সবকিছুর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল। বন্দিদের জীবিত অবস্থায় ফেরত না দিলে গাজাবাসীদের শুকিয়ে মারা হবে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার।

শিশুদেরও ছাড় দেয় নি হামাসের সন্ত্রাসবাদীরা। নিজের এক্স হ্যান্ডেলে মৃত শিশুর রক্তাক্ত বিছানার ছবি পোস্ট করেছেন নেতানিয়াহু। ছবি- সংগৃহীত

হামাসের হামলার পর যুদ্ধ সাতদিনে গড়িয়েছে। এর মধ্যেই গাজা ধ্বংসস্তূপ। আইডিএফ প্রধান জানিয়ে দিয়েছেন, “গাজা স্ট্রিপকে আর আগের মতো দেখাবে না।” তবে তিনি যোগ করেছেন, “এর জন্য সময় লাগবে এবং আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।” সেনাপ্রধানের ইঙ্গিতে স্পষ্ট, গাজাকে ধূলিসাৎ করে হলেও হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ইজরায়েল। অনেকে মনে করছেন, হামাসের সামরিক সক্ষমতা ও সংগঠনকে পুরোপুরি নষ্ট করতে ২০০ বন্দির জীবন উৎসর্গ করতে পর্যন্ত মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেছে ইজরায়েল রাষ্ট্র।

Feature graphic is representational.

  • প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ‘দ্য টাইমস অব ইজরায়েল’ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *