'Kanishka Bombing'-1985: মাঝ আকাশে ঝলসে মরেছিল ৩২৯টি প্রাণ, শাস্তি হয়েছিল মাত্র একজনের! - nagariknewz.com

‘Kanishka Bombing’-1985: মাঝ আকাশে ঝলসে মরেছিল ৩২৯টি প্রাণ, শাস্তি হয়েছিল মাত্র একজনের!


বিশেষ প্রতিবেদন: ৯/১১-র আগে বিশ্বে বিমান সন্ত্রাসের সবথেকে ভয়াবহ ঘটনাটি যেন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে আছে। যে দেশের মাটিতে এর পরিকল্পনা তাদের গোয়েন্দা বিভাগ সময়ে সচেতন হলে মাঝ আকাশে ৩২৯টি প্রাণের মর্মান্তিক মৃত্যুই হত না। যে দেশের বিমানটি সন্ত্রাসবাদীদের বোমায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেই দেশের সরকার‌ও কি অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে যথেষ্ট কূটনৈতিক তৎপরতা দেখিয়েছিল? আমরা ক‌’জন ভারতবাসী এয়ার ইন্ডিয়ার ‘কণিষ্ক’ নামের ‘বোয়িং-৭৪৭-২৩৭বি’ বিমানের ‘ফ্লাইট-১৮২’র ট্র্যাজিক পরিণতির কথা মনে রেখেছি? কানাডার টরন্টো থেকে ছেড়ে মন্ট্রিল হয়ে লন্ডন, লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে ছেড়ে ভায়া দিল্লি হয়ে মুম্বাইয়ে পৌঁছানোর কথা ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার ‘ফ্লাইট-১৮২’র। ১৯৮৫ সালের ২৩ জুন বিস্ফোরণের জেরে আটলান্টিক মহাসাগরে ভেঙে পড়ে কণিষ্ক। ‘ফ্লাইট-১৮২’ তখন ৩১ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল।

আয়ারল্যান্ডের উপকূল থেকে প্রায় ১৯০ কিলোমিটার দূরে কণিষ্কের ধ্বংসাবশেষ পড়েছিল। ২২ জন ক্রু সহ ৩২৯ জন যাত্রীর সকলের মৃত্যু হয়েছিল। দেহাবশেষ উদ্ধার হয়েছিল মাত্র ১৩১ জনের। মৃতদের মধ্যে ২৭৮ জন ছিলেন কানাডার নাগরিক, যদিও তাদের অধিকাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ২৭ জন ব্রিটিশ নাগরিক ও ২৪ জন ভারতীয়। ঘটনার এক ঘন্টার মধ্যেই নিউইয়র্ক টাইমসের দফতরে ফোন করে বিস্ফোরণের দায়িত্ব স্বীকার করেছিল তিনটি খালিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠী। যদিও পরে সিবিআইয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয়, এয়ার ইন্ডিয়ার ‘বোয়িং-৭৪৭’এ বোমা রাখার ষড়যন্ত্রটা ছিল ‘বাব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনাল’-এর। পাঞ্জাব তখন অগ্নিগর্ভ। খালিস্তানপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সন্ত্রাসে রোজ রক্ত ঝড়ছে। সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানে তাদের ঘাঁটি। ব্রিটেন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আমেরিকা ও কানাডাতে বসেও অবাধে ভারত বিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন খালিস্তানি নেতারা। কানাডার শিখ ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের একটা বড় অংশ বরাবরই খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের একটি অংশ কট্টর এবং খালিস্তানপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে জড়িত। ১৯৮৫-তে এরাই কানাডার মাটিতে বসে অপারেশন ব্লুস্টারের বদলা নিতে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে বিস্ফোরণের ছক কষেছিল।

সতর্ক করেছিল ভারত, গুরুত্ব দেয় নি কানাডা

এমন নয় যে এই ভয়াবহ নাশকতার কোনও পূর্বাভাস ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কগুলির কাছে ছিল না। ১৯৮৪-র জুনে অপারেশন ব্লুস্টারের পর থেকেই কানাডায় আশ্রিত শিখ উগ্রপন্থীরা বড় কিছু করার পরিকল্পনা করছিল। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট-১৮২ বোমায় বিধ্বস্ত হয়েছিল ৮৫-র ২৩ জুন। ঘটনার দেড়-দু’মাস আগে থেকেই কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের ভেতরে ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল, ‘এয়ার ইন্ডিয়া কি ফ্লাইট মাত লো’- এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট নিয়ো না। ‘র’-এর গোয়েন্দাদের কানেও গুঞ্জনটি পৌঁছেছিল। ঘটনার ২৩ দিন আগে ভারতের গোয়েন্দাদের তরফে সম্ভাব্য বিমান হামলার বিষয়ে সতর্ক করে কানাডার ইন্টেলিজেন্স নেট‌ওয়ার্ক ও মুম্বাইয়ের এয়ার ইন্ডিয়ার সদর দফতর- দুই জায়গাতেই ‘টেলেক্স মেসেজ’ যায়। ভারতের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি থেকে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়ার পরেও খালিস্তানি জঙ্গিদের নাশকতার ছক বানচাল করতে তৎপরতা দেখায় নি ‘রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ’ (আরসিএমপি) ও ‘কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস’ (সি‌এস‌আইএস)। ‘সিবিসি নিউজ’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত থেকে গোপন তথ্য হাতে পাওয়ার পরেও কানাডার এই দুই নিরাপত্তা সংস্থার কাজের মধ্যে কোন‌ও সমন্বয় ছিল না। বরং দুই সংস্থার মধ্যে রেষারেষি ও অবিশ্বাস তদন্তের কাজকে ব্যাহত করেছিল।

জাস্টিস জন মেজর : কণিষ্ক বিমানে সম্ভাব্য অন্তর্ঘাত ঠেকাতে কানাডার নিরাপত্তা সংস্থাগুলির ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য বলে রিপোর্টে জানায় জাস্টিস জন মেজর কমিশন। ছবি: সংগৃহীত

কণিষ্ক বিমানের বিয়োগান্তক পরিণতির অনেক বছর পরে ২০০৬ সালে ঘটনার তদন্তে কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন কানাডার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার। ২০১০ সালে জাস্টিস জন মেজর কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। জন মেজর কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিল ‘কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’-এর সংবাদ বিভাগ। আরসিএমপি ও সিএস‌আইএস- কেউ কারও সঙ্গে তদন্তের তথ্য আদান-প্রদান করে নি বলে জন মেজর কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ ছিল। ভারতীয় গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যের প্রতি তাচ্ছিল্যের কারণেই কি সম্ভাব্য নাশকতার মোকাবিলায় গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধানে নামে নি কানাডার দুই এজেন্সি? জাস্টিস জন মেজর কমিশনের রিপোর্টে তেমনই ইঙ্গিত ছিল। কানাডার মাটিতে বসে সন্ত্রাসবাদীরা যখন এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে বোমা বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্র করছিল, তখন সেই ষড়যন্ত্র নিষ্ফল করতে কানাডার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল বলে তাঁর রিপোর্টে স্পষ্ট অভিযোগ করেছেন জাস্টিস মেজর। রিপোর্টে তিনি লিখেছেন, সেই সময় নিরাপত্তার গলদগুলি ছিল ক্ষমার অযোগ্য এবং সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংসতা প্রতিরোধে দেশের নিরাপত্তা বন্দোবস্তে ছিল আপাদমস্তক ঘাটতি।

সর্ষের মধ্যেই কি ভূত ছিল?

কণিষ্ক বিমানে অন্তর্ঘাতের মূলচক্রী ছিল ‘বাব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনাল’-এর প্রতিষ্ঠাতা তালবিন্দর সিং পারমার। কণিষ্কে বিস্ফোরণ ঘটানোর দিন কয়েক আগে কানাডার ডানকান বিসি এলাকার একটি জঙ্গলে পরীক্ষামূলকভাবে বোমা ফাটিয়ে দেখেছিল পারমার। তার আগেই ভারতীয় গোয়েন্দাদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পারমারের উপরে হালকা-পাতলা নজরদারি চালাচ্ছিলেন ‘কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস’-এর গোয়েন্দারা। বোমা বিস্ফোরণের শব্দকে বন্দুকের গুলির শব্দ ভেবে ভুল করে পরের দিনই পারমারের উপর থেকে নজরদারি তুলে নেন তাঁরা।

এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি থাকার পরেও দেশের বিমানবন্দরগুলির নিরাপত্তা বলয় মজবুত করার কোনও তাগিদ কানাডা সরকারের ছিল না। উল্টে নিরাপত্তা প্রদানকারীদের ভেতরেই জঙ্গিদের এজেন্ট ঘাপটি মেরে ছিল কিনা, এই প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ আছে। টরন্টো থেকে যেদিন অভিশপ্ত কণিষ্ক শেষবারের মতো উড়ে গিয়েছিল সে’দিন টরন্টোর পিয়ারসন এয়ারপোর্টের এক্স-রে স্ক্রিনগুলি ভেঙে রেখেছিল কারা? সে’দিন‌ই কেন বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ‘স্নিফার’ কুকুরগুলিকে প্রশিক্ষণের জন্য ভ্যাঙ্কুভারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল? মনজিত সিং নামে ওয়েটিং লিস্টে থাকা এক যাত্রীর ‘স্যামসোনাইট’ লাগেজের ভেতরে বোমাটি ছিল। টিকিট ‘কনফার্মড’ না হ‌ওয়ার পরেও একজন যাত্রীর লাগেজ কীভাবে বিমানে চাপানো হয়েছিল? মনজিত সিং নামে ওই যাত্রী পরিকল্পনা মাফিক বিস্ফোরক ভর্তি লাগেজ ‘ফ্লাইট-১৮২’তে ভরে দিয়ে টরন্টো বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরে যান। লাগেজ পরীক্ষায় নিয়োজিত কানাডার নিরাপত্তা কর্মীরা কী করছিলেন? তাঁদের হাতে ধরে রাখা ‘স্নিফার মেশিনটি’ কি বিস্ফোরক ভর্তি ব্যাগটি চেক করার সময় বিপ বিপ আওয়াজ করে ওঠে নি? শোনা যায়, ‘হ্যান্ড ডিটেক্টার মেশিন’ সংকেত দেওয়ার পরেও তা অগ্রাহ্য করেছিলেন পিয়ারসন এয়ারপোর্টের নিরাপত্তাকর্মীরা। ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত না দায়িত্ব পালনে অবহেলা- এই প্রশ্নের কোনও নিষ্পত্তি হয় নি।

কণিষ্ক বিমান ট্র্যাজেডি : এক হতভাগ্য যাত্রীর দেহাবশেষ উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন আইরিশ নৌবাহিনীর সদস্যরা। ফটো ক্রেডিট- রয়টার্স/ স্ট্রিংগার

১৯৮৫-র ২২ জুন টরন্টো থেকে ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট বিলম্বে উড়ে স্থানীয় সময় রাত নটা নাগাদ মন্ট্রিলের মিরাবেল বিমানবন্দরে অবতরণ করে এয়ার ইন্ডিয়ার ‘বোয়িং-৭৪৭’ বিমানটি। মন্ট্রিল থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর ২৩ জুন স্থানীয় সময় সকাল ৮টা বেজে ৯ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডে আয়ারল্যান্ডের শ্যানন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের র‌্যাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় বিমানটি। সেই সময় আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল থেকে ১৯০ কিলোমিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে ৩১ হাজার ফুট উচ্চতা দিয়ে ৩২৯ জন যাত্রী ও ক্রু-কে নিয়ে গন্তব্যের দিকে উড়ে যাচ্ছিল কণিষ্ক। বিস্ফোরণে মাঝ আকাশেই টুকরো টুকরো হয়ে যায় ‘বোয়িং-৭৪৭’-এর বিশাল দেহ।

দুই জাপানির প্রাণের মূল্যে রক্ষা পেয়েছিল ফ্লাইট-৩০১

শুধু টরন্টো থেকে উড়ে যাওয়া ‘বোয়িং-৭৪৭’কেই নয়, এয়ার ইন্ডিয়ার আরও একটি বিমানকে এক‌ই সময়ে লক্ষ্যবস্তু করেছিল কানাডার খালিস্তানি জঙ্গিরা। এয়ার ইন্ডিয়ার ‘ফ্লাইট-৩০১’কে উড়িয়ে দিতে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বিমানবন্দর থেকে টোকিওর উদ্দেশে র‌ওনা দেওয়া ‘সিপি এয়ার ফ্লাইট’-এ বিস্ফোরক বোঝাই আরও একটি লাগেজ তুলে দিয়েছিল শিখ সন্ত্রাসবাদীরা। সে’দিন ভ্যাঙ্কুভার বিমানবন্দরের এক্সরে মেশিনগুলিও অকেজো ছিল। এক‌ই দিনে কানাডার দুটি বিমানবন্দরের এক্সরে মেশিন বিগড়ে যাওয়ার ঘটনা কি নেহাতই সমাপতন না গভীর ষড়যন্ত্র? জাপানের টোকিওর নারিতা এয়ারপোর্ট থেকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককের উদ্দেশে নিয়মিত যাতায়াত করত এয়ার ইন্ডিয়ার ‘ফ্লাইট-৩০১’টি। ২৩ জুন নারিতা বিমানবন্দরে ‘সিপি এয়ার ফ্লাইট’ থেকে লাগেজ খালাস করার সময় দুই জাপানি ‘ব্যাগেজ হ্যান্ডলার’ ‘ফ্লাইট-৩০১’এর ট্যাগ লাগানো একটি লাগেজ ধরে টান দিতেই তাতে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলেই হিদেহারু কোডা ও হিদেও আসানো নামে ওই দুই ব্যাগেজ হ্যান্ডলারের মৃত্যু হয়েছিল।

বিচারের নামে প্রহসন হয়েছিল কানাডায়

আগাম সতর্কতার পরেও কণিষ্ক বিমানে নাশকতা রুখতে কানাডা প্রশাসন যেমন ব্যর্থ হয়েছিল তেমনি ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পরেও কানাডা সরকারের আচরণে কোন‌ও অনুশোচনার ছাপ ছিল না। কানাডা সহ পশ্চিমের চারটি দেশে ঘাঁটি গেড়ে থাকা খালিস্তানি জঙ্গিরা একযোগে এয়ার ইন্ডিয়ার দুটি বিমান বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। একটিতে তারা সফল হয়েছিল। তারপরেও আমেরিকা-কানাডা সহ পশ্চিমী দুনিয়ার চোখে তা কোনও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হামলা ছিল না, ছিল ভারতের ঘরোয়া সংঘাতের একটা নির্মম পরিণাম মাত্র। বিস্ফোরণে কণিষ্ক বিমান ধ্বংসে মৃত ৩২৯ জনের মধ্যে ২৭৮ জন‌ই ছিলেন কানাডার নাগরিক। যদিও তাদের অধিকাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত হ‌ওয়ায় নিহতদের পরিবারবর্গকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতেও কানাডা সরকারের কোনও গরজ ছিল না। ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর সকালে আমেরিকায় আল-কায়দা জঙ্গি সংগঠনের বিমান হামলার আগে পর্যন্ত কণিষ্ক বিস্ফোরণ‌ই ছিল ইতিহাসের ভয়াবহতম বিমান সন্ত্রাস। অথচ কানাডার ইতিহাসের সবথেকে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল বিচার প্রক্রিয়া শেষে শাস্তি হয়েছিল মাত্র একজনের!

১৯৮৫ সালে ‘কণিষ্ক বোম্বিং’-এর বিচার শুরু হয়ে চলেছিল ২০১০ পর্যন্ত। কিন্তু ৩০ মিলিয়ন ডলারের এই দীর্ঘ বিচার পর্ব শেষ পর্যন্ত প্রহসন ছাড়া ৩২৯ জন নিহতের স্বজনদের আর কী দিয়েছিল? ঘটনার পর ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড তালবিন্দর সিং পার্মার সহ অনেককেই গ্রেফতার করেছিল কানাডার পুলিশ। কিন্তু পার্মার সহ সকলকেই একে একে মুক্তি দিয়ে সমাজে সসম্মানে পুনর্বাসিত করার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল কানাডা সরকার। এই ঘটনা প্রমাণ করে অপরাধে জড়িতদের শাস্তি দেওয়ার কোনও সদিচ্ছা তো কানাডা প্রশাসনের ছিলই না উপরন্তু খালিস্তানি জঙ্গিরা যাতে অভিযোগ থেকে দ্রুত অব্যাহতি লাভ করে, কোনও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার কারণে সেই চেষ্টাতেই নিয়োজিত ছিল দেশটির সরকার।

বাব্বর খালসা প্রধান তালবিন্দর সিং পারমার : ‘কণিষ্ক বোম্বিং’-এর মূলচক্রী পারমারকেই ছেড়ে দিয়েছিল কানাডা সরকার। ছবি- সংগৃহীত

কুখ্যাত খালিস্তানি জঙ্গি তালবিন্দর সিং পারমার ১৯৮১ সালে পাঞ্জাব পুলিশের দুই আধিকারিককে খুন করে পাকিস্তানে সটকে পড়ে। পরে পশ্চিম জার্মানি হয়ে কানাডায় পালিয়ে যায়। ভারত সরকারের শত অনুরোধেও পারমারকে প্রত্যর্পণে রাজি হয় নি দুই দেশ। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট-১৮২ বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংসের তিন বছর পেরোনোর আগেই ভয়ঙ্কর সেই নাশকতার মূল পরিকল্পনাকারী তালবিন্দর সিং পারমারকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছিল কানাডা সরকার। ১৯৮৮ সালে কানাডা থেকে পাকিস্তানে ফিরে সীমান্তের ওপারে বসে পাঞ্জাবে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে পারমার। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকেও পাঞ্জাবের ভেতরে বাব্বর খালসার জঙ্গিদের নেতৃত্ব দিতে শুরু করে এই মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি। ১৯৯২-এর ১৫ অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পারমার নিহত হয়। যদিও অন্য একটি সূত্র দাবি করে, পুলিশ হেফাজতে পারমার মারা যায়।

কণিষ্ক বিস্ফোরণকান্ডে আরও দুই প্রধান অভিযুক্তের একজন রিপুদমন সিং মালিক, অপরজন আজাইব সিং বাগরি। ২০০৫ সালে দু’জনকেই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় কানাডার আদালত। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট-১৮২ বিস্ফোরণ মামলার একমাত্র দোষী সাব্যস্ত ও সাজাপ্রাপ্ত আসামীর নাম ইন্দারজিৎ সিং রেয়াত। ২০১০ সালে রেয়াতকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। যদিও সাজার চেয়েও বেশি কারাভোগ করায় ২০১৬ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে এই প্রাক্তন খালিস্তানি জঙ্গি। ২০২২-এর ১৪ জুলাই সকালে কানাডার সারে এলাকায় রিপুদমন সিং মালিককে গুলি করে মারা হয়েছে।

‘কণিষ্ক বোম্বিং’ : বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে শিশুর দেহ, সমুদ্র থেকে মিলেছে শুধু তার পুতুলটি। ফটো ক্রেডিট- রয়টার্স/রব ট্যাগার্ট

ঘটনার ৩৮ বছর পর একটা বিষয় জলের মতো পরিষ্কার- না ছিল কণিষ্ক বিমানে অন্তর্ঘাত ঠেকাতে কানাডা সরকারের কোনও গরজ, না ছিল অন্তর্ঘাতের পরে সুষ্ঠু তদন্তে ট্রুডোর দেশের কোনও আগ্রহ। কানাডা সরকার দায়িত্বের সঙ্গে যে কাজটি সেরেছিল, তা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদীদের বিচারের হাত থেকে আড়াল করা। যারা খুন করে তারা তো অপরাধীই, যারা খুনিদের আড়াল করে আইনের চোখে তারাও কম অপরাধী নয়। যে সরকার ৩২৯ জন নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুর হত্যাকারীদের প্রকারান্তরে রক্ষা করেছে, তাদের কানের কাছে গিয়ে বলার সময় এসেছে, তোমরা জঙ্গিদের দরদী, তোমরা সন্ত্রাসবাদীদের সখা। তোমাদের মুখে মানবাধিকারের বুলি মানায় না। জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় বলে ‘পারিহা’ পাকিস্তানকে শুধু ভারত নয় সারা দুনিয়ার খোঁটা শুনতে হয়। উন্নত-উদার, সভ্য-ভব্য, মানবাধিকার মুখরিত কানাডা কীসের ভাল?

Feature image- Collected .


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *