ঝুলনযাত্রা বাঙালির সহজ সাধনার‌ দিকেই যাত্রা - nagariknewz.com

ঝুলনযাত্রা বাঙালির সহজ সাধনার‌ দিকেই যাত্রা


শ্রাবণের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে ঝুলনযাত্রা পালিত হয় বাংলায়। বাঙালির ঝুলনে তার সহজিয়া জীবনধারাই প্রতিফলন। লিখেছেন ঋতুপর্ণা কোলে-

রথ যেমন সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষের মহামিলনের দিন, ঝুলন তেমন এককথায় সব বর্ণের মানুষের লিঙ্গবৈষম্যের আবরণ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মেতে ওঠার দিন। শ্রাবণ শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে ঝুলনযাত্রা পালিত হয়। এটি সম্পূর্ণভাবেই কিছু লৌকিক ভাবনার সংস্কৃতরূপ যা বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় ব্যাপক ব্যপ্তি লাভ করেছে। ঝুলনযাত্রার পাঁচদিন আসলে নারী–পুরুষের অবাধ মেলামেশার দিন। বিভিন্ন প্রাচীন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এই রীতি প্রচলিত। ঝুলনের মধ্যে এই প্রাচীনতার ছাপ পরতে পরতে মিশে আছে।

তিথি হিসাবে শ্রাবণ একাদশী হলেও ঝুলনের মাস হল শ্রাবণ ও ভাদ্র। বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতির ধারায় এ হল মহামিলনের কাল। কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই মাতৃতান্ত্রিকতার ঐতিহ্যকে স্বীকার করে এগিয়ে চলে, প্রাধান্য দেয় উর্বরতাতন্ত্রকে। কথিত আছে, বহু প্রাচীনকালে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার যুগে নতুন চাষ শুরুর আগে বর্ষার শেষে পূর্ণিমার রাতে খোলা আকাশের নীচে নর–নারীরা মহামিলনের মধ্যে দিয়ে চাষের কাজ শুরু করা হত। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ভাদ্রশ্রী‘ কবিতায় সেই প্রাচীন সত্যই আভাসিত হয়-

“নক্‌লীরাতে চাষার সাথে চষা–ভূঁয়ের হচ্ছে বিয়ে
হচ্ছে শুভদৃষ্টি বুঝি মেঘের চাদর আড়াল দিয়ে
কনের মুখে মনের সুখে উঠছে ফুটে শ্যামলহাঁসি
চাষার প্রাণে মধুর তানে উঠেছে বেজে আশার বাঁশি“

এবং এই সত্যই মিশে গেছে আজকের ঝুলন উৎসবের মধ্যে। আবার ঝুলনের চরিত্র বিচার করলে মনে আসতেই পারে এই উৎসব কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতারও অনেক আগের। ঝুলনযাত্রার প্রধান চরিত্র রাধা ও কৃষ্ণ। সকলেই জানেন কৃষ্ণ গোপালক। পশুচারণ বিষয়টির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই প্রাচীনতার ইঙ্গিত। তাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ভাদ্রশ্রী’ কবিতায় ভাদ্রের বর্ণনায় অবশ্যম্ভবীভাবেই যখন এসে পড়েছে সেই প্রাচীন কৃষ্ণের অনুষঙ্গ। সেই কৃষ্ণ অবশ্যই রাখাল কৃষ্ণ,

“বাঁশের বাশী বাজায় কে আজ? কোন সে রাখাল মাঠের বাটে/ অগাধ ঘাসে দাঁড়িয়ে গাভী ঘাসের নধর অঙ্গ চাটে”

আবার ভাদ্র মাস গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই রাধা কৃষ্ণের প্রেমে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে যেমন ভাদ্রমাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে তেমনি আছে বৈষ্ণবপদাবলীতে। কৃষ্ণ মথুরা চলে গেলে বিদ্যাপতির রাধা বিশেষভাবেই ভাদ্রমাসে কৃষ্ণবিরহে কাতর হয়ে বলে–

“এ সখী হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহভাদর
শূন্য মন্দির মোর“

শাস্ত্রমতে, ঝুলনের দিন কৃষ্ণ রাধাকে দোলনায় বসিয়ে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চরম আধুনিকতার এই নিদর্শনগুলো সারা ভারত যখন লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত, যখন প্রেমিক কৃষ্ণর রূপটা আবৃত করে বীরকৃষ্ণ, দার্শনিক কৃষ্ণ এবং সর্বোপরী স্বামী কৃষ্ণ অর্থাৎ রাম-(সমাজ অনুমোদিত আইনসম্মত)- এই রূপগুলিকে তুলে ধরার জন্য উন্মুখ তখন বাঙালি আজও সকলের নাকের ডগায় স্বামী স্ত্রী নয় কেবল প্রেমিক–প্রেমিকার আরাধনায় পালন করছে ঝুলনযাত্রা পাঁচদিন ধরে তাও আবার একেবারে নিজস্ব ভঙ্গীতে।

রামপ্রসাদ তাঁর শাক্ত সঙ্গীতে বলেছিলেন “মায়ের মূর্তি গড়াতে চাই মনের ভ্রমে মাটি দিয়ে“। বাঙালির এটা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের অন্যজাতির মত দেব–দেবী ঐশ্বরিক রূপটিকে খুব বেশী গুরুত্ব না দিয়ে প্রাণের ঠাকুর কাছের ঠাকুর হিসাবে অন্তরে ঠাঁই দেয়। বাঙালি জানে তাদের দেব–দেবী ষোড়শোপাচারে নয় সামান্য জল বাতাসাতেই তুষ্ট। ঝুলনযাত্রায় ফুটে ওঠে বাঙালির এই বাঙালিয়ানা। ঝুলনের প্রধান কাজ হল রাধাকৃষ্ণের প্রেমের জন্য কুঞ্জবন প্রস্তুত করা। সেই কুঞ্জবন সাজানোর জন্য বাঙালি কখনই স্বর্গ থেকে পারিজাত ফুল আনার কথা ভাবে না বরং হাতের কাছে যা থাকে তা দিয়ে বানিয়ে দেয় রাধাকৃষ্ণের বসবাসের জন্য উপযুক্ত নগর। সেই নগরে রাস্তা, গাড়ি বাড়ি, সুইমিংপুল, অসংখ্য মানুষ যাই থাকে না সবই আসলে খেলনা দিয়ে সাজানো হয়। আবার নগরের পিছনে থাকে পাহাড় সেখান থেকে আসে নদী। অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে নগর সভ্যতাকে মিলিয়ে দেবারও চরম প্রয়াস থাকে। “দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর” এটা কখনই বাঙালির মর্ম কথা নয়, বাঙালির নগর আকাঙ্ক্ষা বহু পুরনো তার পরিচয়পত্র নিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে ইতিহাসের প্রতিটা পাতা। বাণিজ্য নগরী তাম্রলিপ্তের কথা আমরা যেন বিস্মৃত না হই। গৌড় কিংবা কর্ণ সুবর্ণের রাজপথকে যেন ভুলে না যাই। ধীরে ধীরে তিনটে গ্রাম চোখের সামনে মহানগরের রূপ নিল এখনই এক দিনের ফসল নয়। বাঙালির প্রাচীন ব্রতগুলোর অন্যতম অংশ হল আলপনা যার দ্বারা মনের কামনা বাসনাগুলো সাকার হয়ে ওঠে। ঝুলনের এমন সাজের মধ্যে দিয়ে সেই একই মনস্তত্ত্ব কাজ করে বলেই মনে হয়।

সহজিয়া বা দেহতত্ত্বের সাধনা বাঙালির আদি অকৃত্রিম। তন্ত্রসভ্যতার যুগ, বৌদ্ধসহজানীদের স্তর পেরিয়ে তা মুক্তি পেল বাউল সাধনায়। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন না কেন “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া” বাঙালি বরং তার অবচেতনে অনুভব করে বাউল সাধনার মূল ভিত্তি “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই–ই আছে দেহভান্ডে” এরই প্রতিফলন ঘটে ঝুলনের ‘Miniature’ নির্মাণের মধ্যে। সামগ্রিকতাকে এক খন্ডের মধ্যে ধরার প্রয়াস মূর্ত হয়ে ওঠে এখানে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *