বাংলা লোকধর্মের দেশ। লোকাচারের দেশ। এই আচারে ভেদাভেদ, ছোটবড়র বিচার নেই। চৈত্রে গাজনকে কেন্দ্র করে যে পরব, তা একান্তই তন্ত্রাশ্রয়ী বাঙালির নিজের উৎসব। নীলাবতীর বিয়েও সেই উৎসবের অঙ্গ। লিখলেন ঋতুপর্ণা কোলে –
আজ নীলের বার। সকলেই জানি দিনটিকে বলা হয় নীলাবতীর বিয়ে। মানে শিবেরও বিয়ে। কি আশ্চর্য না? এই তো কদিন আগে শিবরাত্রি হল সেদিনও নাকি বিয়ের দিন ছিল। তাহলে দুটো বিয়ের দিন কেন? সেই উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেশ কিছু তথ্য পরিষ্কার হল। বাঙালি নানা ধারার ধর্মীয় আচরণকে সমানভাবে পালন করে বলেই বাঙালির বারোমাসে কেবল তের পার্বণ নয় বরং বলা যায় অজস্র পার্বণ। খেয়াল করলে দেখা যায় একই বাড়িতে কালীপুজো এবং কীর্তন হাত ধরাধরি করে চলছে। শালগ্রাম শিলা ও নানা দেবদেবীর মূর্তি পাশাপাশি। এখানেও অর্থাৎ দুই বিয়ের দিন পালনেও বিষয়টা তেমনি একদিকে পুরাণ আশ্রিত শিবের বিবাহের দিন, অন্যদিকে লোকধর্ম আশ্রিত শিবের বিবাহ।
শিবরাত্রির পূজাপদ্ধতি, পূজা সংক্রান্ত গল্প এবং ফল লাভ সব কিছুর মধ্যে একটা পুরুষ তান্ত্রিকতার প্রকাশ বিদ্যমান। পুরাণ মতে শিবরাত্রি হল শিব ও শক্তির মিলনের রাত। পূজাপদ্ধতি অনুসারে আগের দিন নিরামিষ আহার করতে হয়। দুধ, দই, ঘি, মধু ইত্যাদি সহযোগে শিবের পূজা করা হয় সুতরাং আড়ম্বরতার প্রকাশ বর্তমান। এবং এই পূজা পদ্ধতি সমগ্র হিন্দুধর্মের মানুষ মেনে চলেন। প্রতিটি ব্রতর মধ্যে থাকে আকাঙ্খা। শিবরাত্রির ব্রত পালনের আকাঙ্খা স্বামীর মঙ্গল কামনা। এখানেই আসে বিরোধ এই আকাঙ্খার কারণেই অনেক নারীবাদীরা বলেন, “শিবরাত্রি থাকলে দুর্গারাত্রি কেন নেই?”
উত্তর একটাই, পুরাণ আশ্রিত যাবতীয় আচারে পুরুষের মঙ্গলের জন্য নারীর ত্যাগের কাহিনিই বর্ণিত সেখানে স্ত্রীর মঙ্গল কামনার জন্য পুরুষের উপবাসে কথা যে থাকবে না তা স্বাভাবিক। বাঙালি আসলে হিন্দু হয়েও আলাদা এখানেই। একই ছাতার তলায় আশ্রয় নিলেও বাঙালির শিকড় আসলে অন্য। যদিও সেই শিকড়ে শিব তথা আদিদেব আছেন তাঁর মত করে। সে’কারণেই আর একটি শিবের বিয়ের দিন রয়েছে। এবং দিনটি কেবল নীলের বার নয়, নীলাবতীর বিয়ের দিন রূপেও চিহ্নিত। শিবরাত্রির দিনে শিব ছাড়া অন্য কারো ভূমিকা আছে বলেও জানা যায় না বিশেষ। কিন্তু নীলাবতীর বিয়ের দিনটির আচার আচরণের দিকে তাকালে বিশেষভাবেই তন্ত্র আশ্রিত বাঙালির শিকড়ের ফিরে যাওয়া যায় সহজেই। শুরুটা হয় চৈত্র মাসের প্রথম দিন থেকে। বিশেষ আয়োজন চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীলের বার তার আগের দিন অধিবাস এই দিন রাত্রে হয় ‘হাজরা পূজা’ অর্থাৎ বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা। হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়”। খেয়াল করে দেখুন যেখানে শিবরাত্রির আগের দিন নিরামিষ ভোজন করা হয় সেখানে নীলের বারে আগের দিন মাছের ভোগ প্রস্তুত করা হয়। একদিকে মাছ সিন্ধু- সরস্বতী সভ্যতার ঐতিহ্যকে স্মরণ করায় অন্য দিকে পোড়া মাছ সেই আগুন আবিষ্কারের দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বেহালা স্টেট আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়ামে এবঙ্গের নানা স্থান থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন প্রস্তর যুগ এবং নব্যপ্রস্তর যুগের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। এই পোড়া মাছ নিবেদন সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত একটা ধারাবাহিকতার দিকেই নির্দেশ করে।
নীলাবতীর বিয়ের দিনটি দেখার মত। গ্রামের সকলে মিলে নানা রকম সাজে। যাকে বলা হয় সঙ সাজা। শিব এবং পার্বতী তো সাজেনই এছাড়াও শিবের চ্যালাদের মত ভূত প্রেত সেজে বর কনের সঙ্গে বরযাত্রীরা হুল্লোড় করে। এরকম সাজের মধ্যে একটা ‘ট্রাইব’ ব্যাপার আছে যদিও আজকের যুগে ‘ট্রাইব’ শব্দ অন্য মাত্রায় ব্যবহৃত হয় এখানে অত্যন্ত প্রাচীন ঐতিহ্যের অনুসরণ বলে মনে করা যেতে পারে। এমনকি কেবল সাজ নয় আরও অন্যান্য আচরণেও সেই প্রভাব স্পষ্ট।
একটা বিবাহের সমস্ত অনুষ্ঠান তিন দিন ধরে চলে এক্ষেত্রেও অনুষ্ঠানটি আসলে তিনদিনের। এই তিন দিনের অনুষ্ঠানকে বলে গাজন। অনেকের মতে, গ্রাম শব্দ থেকে ‘গা’ শব্দটি এসেছে এবং জনসাধারণ থেকে ‘জন’ সুতরাং এটি গ্রাম জনগণের উৎসব তাই একে বলা হয় গাজন। আবার অনেকের মতে, গর্জন থেকে গাজন শব্দটি এসেছে। লোক নৃত্য, লোক গানে এই তিনদিন সারা গ্রাম গমগম করে তাই এরূপ নাম। অধিবাসের পরেরদিন অর্থাৎ বিয়ের দিন এবং তারপরের দিন চড়ক। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যাঁরা যুক্ত থাকেন তাঁরা একমাসের কৃচ্ছ্বতাসাধনের মধ্যে দিয়ে নিজেকে অনুষ্ঠানের উপযুক্ত করে তোলেন। এঁদের বলা হয় সন্ন্যাসী। চড়কের দিন অর্থাৎ সবশেষে থাকে ক্ষমা প্রার্থনা। যদি কেউ কিছু পালনে ভুল করে থাকেন নিজের অজান্তেও তাই নিজেকে শাস্তি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে নেন। কাঁটার উপর ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেন। “পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে”।
ফিরে আসা যাক নীলাবতীর বিয়ের দিনটিতে। কেবল সং সাজা নয় এভাবে সেজে হয় গ্রাম পরিক্রমা। বৈষ্ণবদের মধ্যে যে নগর কীর্তন দেখা যায় তারই প্রাচীন রূপটি পাওয়া যায় এই অনুষ্ঠানে। দলটি হরগৌরীর বিবাহ সংক্রান্ত নানা পদ এখানে গানের আকারে গাইতে গাইতে সারা গ্রাম ঘোরেন এবং প্রতি গ্রামবাসীর বাড়ি থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করেন। বলা যেতে পারে বিবাহে গ্রামবাসীর দেওয়া উপহার। এখানে কোনো উঁচু, নীচ, জাত-পাতের ব্যাপার নেই। সকলের দানেই ভরে ওঠে এই হর-গৌরীর ঝুলি। এ যেন নব দম্পতি নতুন সংসার পাততে চলেছে তাদের সংসারের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর দায় গ্রামের বাকি মানুষের।
গানগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে গিরিরাজের কন্যা গৌরীর সঙ্গে শিবের বিবাহ বিশেষ রূপ পেয়েছে সেখানে। গৌরী চিরকালই বাঙালির নিজের ঘরের মেয়ে। এইগানগুলি যেন শাক্তসংগীতের আগমনী-বিজয়ার গানগুলির জন্য ভূমি প্রস্তুত করেছে। যেমন-
“শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।”
“(ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।
আর একদিনেতে শূলপাণি, নারদকে বলেন বাণী
শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,
আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে, মধ্যিখানে থাকি শুয়ে
উশিপুসি করে কাটাই রাত।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে
শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি
উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।
কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি
দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা
জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।”
বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান-
“ভাইগনা যদি উপকারী হও।
তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।”
এছাড়াও নীলের গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণার দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি।
প্রতি ব্রতের পিছনে থাকে কামনার কথা। শিবরাত্রির ব্রতের কামনা হল অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে শিবের মত বর পাওয়া এবং বিবাহিতের ক্ষেত্রে স্বামীর জন্য শুভ কামনা। নীলের ব্রতের ক্ষেত্রে থাকে সন্তানের মঙ্গলের কথা। সন্তান বলতে কেবল পুত্র নয়, কন্যাও। এখানেই এই ব্রতের বিশেষত্ব। প্রথমত এই তিনদিনের অনুষ্ঠানে নারীপুষের সমান অংশ থাকে। দ্বিতীয়ত, ব্রতের চাহিদায় কেবল পুরুষের স্বার্থ রক্ষিত হয় না। বিবাহের প্রধান উদ্দেশ্য সন্তান উৎপাদন, বংশ বিস্তার এবং জাতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনের মধ্যে দিয়ে সন্তানকে রক্ষা করাই এখানে মুখ্য।
Feature Image- Collected.