আজ চড়কপূজা: বর্ষ অবসানে বঙ্গের ব্রাত্যজনের গণ‌উৎসব - nagariknewz.com

আজ চড়কপূজা: বর্ষ অবসানে বঙ্গের ব্রাত্যজনের গণ‌উৎসব


চড়কপূজোয় ইষ্টের প্রতি ভক্তের সমর্পণ অতুলনীয়। চড়ক উৎসবে বাঙালির প্রাণশক্তির অনবদ্য প্রকাশ। চড়ক নিয়ে চর্চায় রক্তিম মুখার্জি-

চড়ক হল চৈত্র সংক্রান্তিতে উৎযাপিত বাঙালির বছরের শেষ উৎসব এবং শেষ লোকায়ত উৎসব। গাজন ও নীলষষ্ঠীর ব্রতের পর ভক্তগণের শিবার্চনার শেষ ও চরমতম প্রকাশ চড়কপূজা। এই উৎসবের রীতিগুলির যথোপযুক্ত বিচার বিশ্লেষণ করলেই এর উৎস, তাত্ত্বিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।

নীহাররঞ্জন রায় মহাশয় এই প্রসঙ্গে চড়কের অঙ্গরূপ অনুষ্ঠিত আচারগুলি সম্বন্ধে বলেছেন: পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পূজা করা। শেষোক্ত অনুষ্ঠানের সাথে পোড়া শোল মাছ এবং তার পুনর্জন্মের কাহিনী জড়িয়ে আছে। এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।

চড়কের কেন্দ্রীয় বিষয় হল একটি জলভর্তি পাত্রে বুড়োশিব অভিধায় অভিহিত শিবলিঙ্গকে চড়কগাছে স্থাপন করে চড়কগাছের গায়ে বেঁধে রাখা বঁড়শিত পিঠে বিঁধিয়ে চক্রাকারে প্রদক্ষিণ। লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যাতনাময় অনুষ্ঠান বা কৃচ্ছ্রসাধন ভক্তদের হৃদয়ে অপার আনন্দের বার্তা বহন করে। শিবের নামে উদ্দাম জয়ধ্বনি দিয়ে এই চক্রাকারে আবর্তনকে যদি তন্ত্রের দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে জলভরা পাত্রের শিবলিঙ্গ আসলে সাঙ্খ্যের পুরুষতত্ত্ব। তাঁকে ঘিরে থাকা জলরাশি প্রকৃতিরূপিণীর গর্ভোদকের সমতুল্য। আর এই চক্রাকারে আবর্তন সংসারচক্রে জীবের জন্মজন্মান্তর ধরে পরিভ্রমণের প্রতীক। অর্থাত্ আদি প্রকৃতি তাঁর গর্ভে পুরুষতত্ত্বকে ধারণ করে স্বীয় লীলায় এই জগতকে সঞ্চালন করেন এই জ্ঞানই এই ঘূর্ণনের সাথে জড়িত। স্পষ্টতই এই তত্ত্ব সাঙ্খ্যের মূল ভাবের অতি প্রাচীন লোকায়ত রূপ।

আবার এই নিরন্তর ঘূর্ণনের মধ্যে ভক্তের আনন্দ যেন আদিতন্ত্রের ভাবানুসারী। যেখানে ত্রিতাপজর্জরিত সংসারচক্রের স্বরূপ জেনেও সাধক মোক্ষ বা উচ্ছৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে সেই আবর্তনের মধ্যেই প্রকৃতির নিত্যলীলার মহাসুখসাগরের অনুসন্ধান করে। এই আদিম বস্তুবাদী লোকায়ত তত্ত্বই বিদগ্ধ মননে চৈতন্যদেবের পঞ্চম পুরুষার্থ বা সহজযানের সহজানন্দ বা রামপ্রসাদের নির্বাণের ঊর্দ্ধে ভক্তির মহিমাকীর্তনের মাধ্যমে পরিশীলিত রূপে আবির্ভূত হয়েছে। অন্যদিকে পোড়া শোল মাছের পুনর্জন্মের বিষয়টি খুব সম্ভবত বাঙালির পূর্বমানুষের এক শিকড় থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন শিকড়ের সন্ধানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অতুল সুর মহাশয়ের নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী বাঙালির আদি পূর্বসূরী আলপাইন আর্যগণ সরস্বতীর মোহনায় থাকতেন। সরস্বতীর ধারা শুকিয়ে গেলে সেই মরুগ্রস্ত সভ্যতার অধিবাসীরা গাঙ্গেয় বদ্বীপে নতুন করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। বেদের সারস্বত ঋষির উপাখ্যান আমাদের মনে করিয়ে দেয় সরস্বতী নদীর মৎস্যবাহুল্যের কথা। পোড়া শোল মাছ সম্ভবত নদীর এবং নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার শুষ্কতার সাথে যুক্ত এবং তার পুনর্জন্ম সম্ভবত গঙ্গার বদ্বীপে সেই সভ্যতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকেই ইঙ্গিত করে।

চড়ক পূজার সাথে তন্ত্রমতে ইন্দ্রের পূজার সংযোগও আছে সম্ভবত। কারণ অনেক জায়গায় চড়কের দিন ছাগবলি দিয়ে ইন্দ্রের পূজা হত। লক্ষণীয় বিষয় হল হোম হত না। অর্থাৎ বঙ্গে নারীগণের ভাঁজো পূজার মতোই এই ইন্দ্রপূজাও তন্ত্রপ্রণোদিত। নরওয়ের পুরাণাদিতে বছরের শেষ দিনে দেবরাজ ওডিনের সম্মানে তাঁর আয়ুধের প্রতীক সুদীর্ঘ বর্শার অগ্রভাগে শত্রুদের মৃতদেহ গেঁথে ঘোরানোর রীতি ছিল। চড়কের বস্ত্রাবৃত সুদীর্ঘ দণ্ডটিও শত্রুধ্বজের সমতুল্য। সেনযুগে জীমূতবাহনের একটি খেদোক্তি থেকে জানা যায় যে শত্রুধ্বজে এই ইন্দ্রপূজা সুদূর অতীতে বঙ্গের সমুদ্রবাণিজ্যরত বণিককুলের পরিচালনায় সম্পন্ন হত। তবে এই ইন্দ্রপূজা সম্ভবত তন্ত্রপ্রণোদিত। কোনো বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের সাথে এর কোনো সংযোগ নেই। এবং তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষেরাই এটি সম্পন্ন করেন। বাঙালির মাতৃসাধনার প্রাবল্যে বৈদিক সূর্য যেমন মহাকালীর আবরণদেবতা প্রকাশশক্তি মার্তণ্ড ভৈরবে পরিণত হয়েছেন; তাঁর পুত্রস্থানীয় বেরণ্ড যেমন বাঙালির দুর্গরক্ষক উপদেবতা হয়েছেন; তেমনি ইন্দ্রও সম্ভবত শৈবতন্ত্রের অন্তর্গত হয়ে চড়কের সাথে একীভূত হয়ে গেছেন।

এই চড়কের সাথে গ্রহবিপ্র ব্রাহ্মণগণের গভীর সম্পর্ক আছে। এই প্রসঙ্গে একটি সুপ্রাচীন জনশ্রুতি আছে। গৌড়াধীপ রাজা শশাঙ্কের বৃদ্ধ বয়সে কুষ্ঠরোগ হলে শাকদ্বীপ থেকে আগত গ্রহবিপ্রগণ তাঁর রোগমুক্তি ঘটান। খুব সম্ভবত এই গ্রহবিপ্রগণই শশাঙ্কের শৈবধর্মের অভ্যুত্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং তাই আজও চড়কে তাঁদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। আবার মধ্যযুগে এই চড়কের সাথে সুন্দরানন্দ ঠাকুরের নাম জড়িয়ে আছে। তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ যেমন মধ্যযুগের নৈরাজ্যের মধ্যে বাঙালির দুর্গাপূজার পুনরুদ্ধার করেন তেমনি সুন্দরানন্দ পূর্ববঙ্গে চড়কের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেন। যদিও কোনো কোনো গবেষক এই সুপ্রাচীন অনুষ্ঠানটিকে অত্যাচারী জমিদারবর্গের খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাপীড়নের নিদর্শন বলেছেন কিন্তু সহজ বুদ্ধিতে এই তত্ত্বের অন্তঃসারশূন্যতা অনুধাবন করা মোটেও কষ্টসাধ্য নয়। প্রথমতঃ এই চড়ক অতি প্রাচীন লোকায়ত উৎসব। নীহাররঞ্জন একে ধর্মপূজা ও হোলির মতো আদিম কৌমসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসের উৎসবের সাথে একই পর্যায়ভুক্ত করেছেন। দ্বিতীয়তঃ এই অনুষ্ঠান হয় শ্মশান বা পরিত্যক্ত স্থানে যা একান্তভাবেই শৈবতন্ত্রের সাযুজ্য বহন করে। তৃতীয়তঃ এই অনুষ্ঠান মোটেও পীড়ন বা শোকের উৎসব নয়। দৈহিক কষ্টকে উপেক্ষা করে আনন্দময়তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এই অনুষ্ঠানে দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া কোনো ভাবেই সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণের কোনো ভূমিকা নেই।

দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছিলেন: শৈবধর্ম বঙ্গে বৌদ্ধধর্ম অপেক্ষা অধিক জনপ্রিয় হয়েছিল। কারণ বৌদ্ধধর্ম যেখানে সংসারকে দুঃখময় বলে ঘোষণা করে কেবল আত্মশক্তির জাগরণের নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত ছিল; সেখানে শৈবধর্ম এই দুঃখময় সংসারের আদি সঞ্চালিকা শক্তির আনন্দময় রূপটি সহজভোলা উদাসীন অথচ তত্ত্বদর্শী এক দেবতার আকারে উপস্থাপিত করেছিল। চড়কের মাধ্যমে সেই আনন্দময়ের জয়গানই এই জাতির প্রাণশক্তির দ্যোতক হয়ে উঠেছে।
তাই চড়কে আপামর গৌড়বঙ্গবাসী গান ধরেন:

ভবময়ীর রূপ দেখিয়া তাল ধরেছেন মহাকাল
ববব্যোম্ ব্যোম্ ববম্ ববম্ বাজায় ভুজাই গাল।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *