কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুরে এসে আরাভ খান নামে ভারতীয় পাসপোর্ট বের করল বাংলাদেশের ফেরারি আসামি রবিউল ইসলাম?
বিশেষ প্রতিবেদন: ঢাকার বনানীতে পুলিশ আধিকারিককে খুনে অভিযুক্ত এক বাংলাদেশি দুষ্কৃতী পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে ভারতীয় পাসপোর্ট বানিয়ে দুবাইয়ে গিয়ে জুয়েলারির বিরাট শোরুম খুলে বসেছে। ভারতীয় পাসপোর্টে বাংলাদেশী ওই ফেরারি আসামির নাম আরাভ খান। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার বাসিন্দা আরাভের আসল নাম রবিউল ইসলাম। এই রবিউলকে ঘিরে এখন বাংলাদেশ জুড়ে হইচই পড়ে গেছে।
গত বুধবার (১৫ মার্চ,২০২৩) রাতে দুবাইয়ের ‘নিউ গোল্ড সুকে’ আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান সহ খেলা ও চলচ্চিত্র জগতের কয়েকজন সেলিব্রেটি। নিজের জুয়েলারি শোরুমের উদ্বোধনের আগেই অনুষ্ঠানের বিস্তারিত জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল আরাভ খান। সামাজিক মাধ্যমে আরাভের ছবি দেখে অনেকেই তার আসল পরিচয় জেনে ফেলেন। পুলিশ অফিসার খুনে অভিযুক্ত রবিউল ইসলাম কীভাবে দুবাইয়ে পাড়ি জমিয়ে বিরাট জুয়েলারির দোকান খুলে বসল, এই প্রশ্নে এখন সরগরম বাংলাদেশ।
সামাজিক মাধ্যমে সাড়া পড়তেই ঘটনার অনুসন্ধান নামে বাংলাদেশের পুলিশ ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। আরাভ খানকে ঘিরে এখন বাংলাদেশে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোনোর অবস্থা। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীর একটি বাড়িতে জন্মদিনের পার্টিতে মামুন এমরান খান নামে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার এক পুলিশ আধিকারিক খুন হন। স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে মামুনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ। পরে গাজিপুর থেকে তাঁর বস্তাবন্দি দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় দুই মহিলা সহ ১০ অভিযুক্তের একজন বছর ৩৫-এর রবিউল ইসলাম। বাকিরা গ্রেফতার হলেও রবিউল বেপাত্তা হয়ে যায়। পরে রবিউলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।
২০২০-এর ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম নামে একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে জেলে পাঠান বিচারক। নয় মাস পরে জানা যায় আদালতে আত্মসমর্পণ করা যুবক রবিউল নয়। তার আসল নাম আবু ইউসুফ। রবিউলই তাকে টাকার বিনিময়ে নাম ভাড়িয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পাঠিয়েছিল বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করে আবু।
বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দারা অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছেন, ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যায় রবিউল ইসলাম। পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুরে উদয় সংঘ ক্লাব এলাকায় বাস করতে শুরু করে সে। এখানে আরাভ খান নাম নিয়ে বিয়ে করে সংসারও পেতে বসে রবিউল। ভোটার কার্ড, আধার সহ ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের যাবতীয় নথিও জোগাড় করে ফেলে এই বাংলাদেশি দুষ্কৃতী। এরপর এই সব নথির সাহায্যে আরাভ খান পরিচয়েই ভারতীয় পাসপোর্টও বানিয়ে ফেলে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রবিউল ইসলাম। ভুয়ো নামে বানানো রবিউলের ভারতীয় পাসপোর্টের নম্বরটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ইউ ৪৯৮৫৩৮৯। ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে একাধিকবার ইউরোপে যাতায়াত করে রবিউল। পরে দুবাইয়ে পাড়ি জমায়। রবিউলের একটি বাংলাদেশী পাসপোর্ট আছে বলেও পুলিশ জানিয়েছে। সেই পাসপোর্টটিও ভুয়ো নামে। বাংলাদেশী পাসপোর্টে রবিউলের নাম হৃদি খান।
এখন প্রশ্ন হল, কীভাবে একজন বাংলাদেশি নাগরিক কলকাতার কাছে নরেন্দ্রপুরে নিরাপদে গা ঢাকা দিয়ে নাম ভাড়িয়ে পাসপোর্ট সহ ভারতীয় নাগরিকত্বের যাবতীয় নথি বের করল? কারা এই বাংলাদেশি দুষ্কৃতীকে আশ্রয় দিল? কাদের সাহায্যে সে ভোটার আইডি, আধার কার্ড এবং ভারতীয় পাসপোর্ট জোগাড় করল? রাজ্য পুলিশের ডিআইবি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পাসপোর্ট দফতর কি বাংলাদেশের নাগরিক, খুনের এক ফেরারি আসামির ভারতীয় পাসপোর্ট পাওয়ার দায় এড়িয়ে যেতে পারে?
বহুদিন থেকেই অভিযোগ, বাংলাদেশি দুষ্কৃতী ও জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রম হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ। গত ২৯ নভেম্বর রাতে কলকাতার হরিদেবপুরে মতিলাল গুপ্ত রোডের একটি ফ্ল্যাটে নূর উন লতিফ নবী বা নূর নবী ওরফে সারোয়ার ম্যাক্সন নামে আরও এক বাংলাদেশি দুষ্কৃতীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। নূরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে খুন-সন্ত্রাস, তোলাবাজি এবং বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র বহন সহ ৫০ টির বেশি মামলা ছিল। একটি মামলায় তাকে ২১ বছর কারাবাসের সাজাও দিয়েছিল আদালত। নূর উন লতিফ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে দুবাই হয়ে ভারতে ঢুকেছিল। দীর্ঘদিন সে তমাল চৌধুরী নামে কলকাতায় মাছের ব্যবসা করত। স্থানীয় এক মহিলাকে বিয়েও করেছিল। ভুয়ো নামে ভোটার আইডি ও আধার বানিয়ে ভারতীয় নাগরিক হয়ে গিয়েছিল নূর নবীও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই খুনিও দীর্ঘ ২৫ বছর কলকাতায় আত্মগোপনে ছিল। রবিউল ইসলাম, নূর উন লতিফ নবীর মতো আরও কত বাংলাদেশি অপরাধী ভারতীয় নাগরিক সেজে পশ্চিমবঙ্গে ও অন্য রাজ্যে ঘাপটি মেরে আছে, কে জানে!
বাংলাদেশ সরকার ইন্টারপোলের মাধ্যমে রবিউল ইসলামকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানা গেছে। এদিকে খুনের আসামি রবিউল ইসলামের জুয়েলারি শোরুমের উদ্বোধনে অতিথি হয়ে বিপাকে পড়েছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। রবিউলের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দুবাই গিয়েছিলেন ইউটিউবার হিরো আলমও। বাংলাদেশে ফিরলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে, এই আশঙ্কা করছেন হিরো। দুবাইয়ে বিপুল ধন-সম্পদ করেছে আরাভ খান থুরি রবিউল ইসলাম। অভিজাত বুর্জ খলিফার ৬৫ তলায় ফ্ল্যাট কিনেছে। দুবাইয়ের মতো ধনী শহরে আরও চার-পাঁচটি ফ্ল্যাটের মালিক সে। দুবাইয়ে বাগান ও সুইমিং পুল যুক্ত বড় একটি বাংলোও কিনে ফেলেছে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রবিউল। ৬০ কেজি সোনা দিয়ে বাজপাখির আদলে আরাভ জুয়েলার্সের লোগোটি তৈরি করতেই খরচ হয়েছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৪৫ কোটি টাকা। নিজের ফেসবুকেই বড়াই করে এ’সব কথা জানিয়েছে রবিউল। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ৩৫ বছরের একজন ফেরারি আসামি এত বিত্ত-বৈভব করল কীভাবে, এই প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশের জনগণ।
রবিউল ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এক শীর্ষকর্তারও নাম জড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পুলিশের প্রাক্তন আইজিপি বেনজির আহমেদ রবিউলকে আরাভ খান হয়ে উঠতে মদত জুগিয়েছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। বেনজির ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ও র্যাবের প্রধানও ছিলেন। বাইশের সেপ্টেম্বরে চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বেনজির আহমেদ।
Feature image is representational and collected.