বিধানসভায় পিএসি-র সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় অনন্তকাল বসে থাকবে না আদালত- কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে এমন ইঙ্গিত কিন্তু স্পষ্ট।
কলকাতা: নিয়োগ দুর্নীতিতে কত কোটি টাকা কারা কারা মেরে খেয়েছে, এই প্রশ্নে তোলপাড় চলছে রাজ্যে। এর মধ্যেই আবার নতুন ঘোটালার গন্ধ। একশ দিনের কাজ এবং প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনা সহ বিভিন্ন খাতে কেন্দ্রের পাঠানো টাকা দেদার মেরে খাওয়া হয়েছে- এই অভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো প্রায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার হিসেব রাজ্য সরকার দিতে পারছে না বলে অভিযোগ। ‘ক্যাগের’ ( CAG) রিপোর্টে গরমিল ধরা পড়েছে। ক্যাগের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় সহ আরও কয়েকজন।
মঙ্গলবার ছিল মামলার শুনানি। শুনানি চলাকালে প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে যথেষ্টই নাকাল হতে হল রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলকে। মামলা ঘিরে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য রাজ্য সরকারের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয় বলেই মনে করছে আইনজীবী মহল। শুনানিতে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করেছে রাজ্য। রাজ্যের আইনজীবীর যুক্তি- ক্যাগের রিপোর্ট রাজ্যপালের কাছে যায়। সেখান থেকে বিধানসভা। এর পর পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে বিষয়টি ওঠে। এই মুহূর্তে পিএসিতে হিসেবে গরমিলের বিষয়টি আলোচনার মধ্যে রয়েছে বলে আদালতে রাজ্যের প্রতিনিধির দাবি।
কিন্তু রাজ্যের যুক্তিতে ভোলে নি আদালত। প্রধান বিচারপতি উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, “পিএসিতে কবে কী হবে, তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতে হবে? নাকি, পিএসিকে সময় সীমা বেঁধে দিয়ে সেখান থেকে রিপোর্ট চাইবে আদালত?” মামলাকারীরা চাইছেন এই দুর্নীতিরও সিবিআই তদন্ত। আদালতে সিবিআই-এর আইনজীবীও উপস্থিত ছিলেন। সিবিআই-এর তরফে জানানো হয়েছে, আদালত নির্দেশ দিলে এই মামলারও তদন্তের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত তারা।
ক্যাগের রিপোর্টে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা রীতিমতো মারাত্মক। ২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার গরমিল! ক্যাগের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের জন্য একশো দিনের কাজ ও প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনা সহ একাধিক প্রকল্পের বরাদ্দ স্থগিত রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রত্যেক মাসেই কেন্দ্র থেকে অডিট টিম রাজ্যে আসছে। জব কার্ডে লক্ষ লক্ষ ভুয়ো নাম। আবাস যোজনার সুবিধাপ্রাপকদের তালিকাতেও জলের পরিমাণ অনেক। ঠ্যালায় পড়ে অনিয়মের কথা ঢোক গিলে স্বীকার করে নিয়েছে রাজ্য সরকারও।
২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো টাকা কোথায় কীভাবে খরচ হয়েছে তার ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট বা ব্যবহারিক শংসাপত্রই জমা দেয় নি রাজ্য সরকার। ২০১৭ থেকে ২২-এর মার্চ পর্যন্ত হিসেব একসঙ্গে প্রকাশ করে দায় সেরেছে রাজ্য। নিয়ম অনুযায়ী, কেন্দ্রের বরাদ্দ করা অর্থ কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তার শংসাপত্র প্রত্যেক অর্থবর্ষে প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ’ব্যাপারে রাজ্য সরকার স্বচ্ছতার পরিচয় দেয় নি বলে মামলাকারীদের অভিযোগ।
সরকারি অর্থ যথাযথ ভাবে খরচ করা হচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জামানায় বিধানসভার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই কমিটিটিই সবথেকে বেশি অবহেলিত বলে বিরোধীদের অভিযোগ। সংসদীয় রীতিনীতি অনুযায়ী পিএসি-র চেয়ারম্যান হওয়ার কথা বিরোধী দলের বিধায়কের। পদটি দেওয়া হয়েছে দলত্যাগী মুকুল রায়কে, যিনি বিজেপি ত্যাগের পর থেকেই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ও পরিষদীয় কাজকর্ম থেকে দূরে। এই পরিস্থিতিতে ক্যাগের রিপোর্ট নিয়ে পিএসি কবে কী সিদ্ধান্তে আসে, সেই অপেক্ষায় বসে থাকলে এই ঘোটালাও ধামাচাপা পড়ে যাবে। রাজ্য সরকারের দুরভিসন্ধি আদালতেরও নজর এড়ায় নি বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। আগামী সপ্তাহে কলকাতা হাইকোর্টে এই মামলার পরবর্তী শুনানি। এখন সবার নজর পরবর্তী শুনানির দিকে।
Feature Image is Representational.