মমতা আনন্দকে বশ করলেন নাকি আনন্দের গন্ডি আগেই বেঁধে দিয়েছে দিল্লি? - nagariknewz.com

মমতা আনন্দকে বশ করলেন নাকি আনন্দের গন্ডি আগেই বেঁধে দিয়েছে দিল্লি?


রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসকে নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিপরীতে রাজ্যপালের ভূমিকায় উষ্মা রাজ্য বিজেপির নেতাদের। আর এই কারণেই উঠেছে অনেক প্রশ্ন‌। লিখলেন নির্বাণ রায়-

রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসকে নিয়ে মহা ফাঁপরে বঙ্গ বিজেপি। মাল‌ওয়ালি আনন্দ বোস প্রাক্তন আমলা, উচ্চশিক্ষিত এবং লেখক। কিন্তু তিনি যে জগদীপ ধনখড় নন, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। ধনখড়কে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যতটা বিব্রত ছিল, আনন্দ বোসকে নিয়ে বর্তমানে রাজ্য বিজেপি তার চেয়ে কম বিব্রত বলে মনে হচ্ছে না। অস্থায়ী রাজ্যপাল লা গণেশনের বিদায়ের পর প্রাক্তন আমলা সি ভি আনন্দ বোসকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার। গত ২৩ নভেম্বর রাজ্যপাল হিসেবে শপথ নেন আনন্দ। আনন্দ রাজভবনে যত‌ই পুরোনো হচ্ছেন, তত‌ই যেন তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতাদের।

ষাটের দশক থেকেই রাজ্যপাল পদটি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। রাজ্যপাল পদটিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিপন্থী বলেও মনে করেন অনেকে। রাজ্যপালকে নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। যদিও রাজ্যপালদের আসল নিয়োগকর্তা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেই খালাস। রাজ্যপাল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান, যেমন দেশের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতি। সংসদীয় ব্যবস্থায় সাংবিধানিক প্রধানের করণীয় তেমন কিছুই থাকে না। কিন্তু কোনও রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার থাকলে, কেন্দ্র যে রাজ্যপালের মাধ্যমে রাজ্য সরকারকে বিস্তর অসুবিধায় ফেলতে পারে তার অজস্র নজির ভারতের রাজনীতিতে আছে। রাজ্যপাল নামে সাংবিধানিক প্রধান হলেও তিনি যে আদতে রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের আচরণ ও অবস্থান নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহলে।

জগদীপ ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি হয়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজ্য বিজেপির প্রত্যাশা ও দাবি ছিল ধনখড়ের মতোই সদা সক্রিয় কাউকে যেন রাজ্যপাল করে বাংলায় পাঠানো হয়। মাঝে মণিপুরের রাজ্যপাল লা গণেশনকে বাংলার অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে রাজভবনে পাঠানো হয়। কিন্তু গণেশনের সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সুসম্পর্ক এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে রাগ করে রাজভবনে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন সুকান্ত-শুভেন্দুরা। অস্থায়ী রাজ্যপাল আজ না হয় কাল দূর হবেন‌ই- এই কারণে গণেশনের চালচলন নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যথাও ছিল না রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের। কিন্তু পূর্ণ সময়ের রাজ্যপাল হিসেবে অমিত শাহ যাকে কলকাতায় পাঠাবেন, তিনি বেশ কড়া ধাতের হবেন বলে আশা ছিল সুকান্ত মজুমদার-শুভেন্দু অধিকারীর। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। সবে দুই মাস‌ হয়েছে আনন্দ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়ে এসেছেন। এর মধ্যেই আনন্দের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটেছে বঙ্গ বিজেপির নেতাদের। মাত্র দুই মাসেই আনন্দের প্রতি বিজেপির উষ্মা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে রাজ্যপালকে নবান্নের জেরক্স মেশিন বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়েন নি দলের সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত।

অথচ সি ভি আনন্দ বোস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক প্রকল্পের পেছনে নাকি ছিল আনন্দের পরামর্শ। মোদী নাকি তাঁকে ডাকেন ‘ম্যান অব আইডিয়াস’ নামে। তাহলে এই আনন্দ বোস কেন এত দ্রুত মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে উঠে রাজ্য বিজেপি নেতাদের বিরাগভাজনে পরিণত হলেন? নতুন স্থায়ী রাজ্যপাল পশ্চিমবঙ্গে পাঠানোর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের আলাপ হয়েছে বলে খবর। শাহের কাছে মমতা কেমন রাজ্যপাল আশা ও দাবি করতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। নরেন্দ্র মোদী- অমিত শাহ যে রাজ্য সরকারের সঙ্গে মানিয়ে চলবেন, এমন রাজ্যপাল পাঠানোর আশ্বাস মমতাকে দেন নি, তা কে বলতে পারে? সেই আশ্বাস রাখতেই সব জেনে বুঝেই কি সি ভি আনন্দ বোসকে রাজ্যপাল করে বাংলায় পাঠিয়েছেন মোদী-শাহ‌?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। মোদীর কাছের মানুষ আজ বঙ্গ বিজেপির অপ্রিয়।

সি ভি আনন্দ বোস রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজ্য জুড়ে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে যে চাইলে তিনি খানিকটা সক্রিয় হতেই পারতেন। কিন্তু তিনি নিয়মের বাইরে যান নি। কেন যান নি? প্রশ্ন ঘুরছে রাজনৈতিক মহলে। এই মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যপালের সম্পর্ক অতি মধুর। বিদ্বান রাজ্যপাল বাংলা শিখতে আগ্রহী। সরস্বতী পুজোর দিন রাজভবনে ঘটা করে রাজ্যপালের বাংলা শিক্ষার হাতেখড়িও হয়ে গেল। অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী সহ রাজ্য সরকারের এবং রাজ্যের শাসকদলের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আমন্ত্রণ পেয়েও যান নি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ও রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার।

প্রশ্ন হল, মমতা আনন্দকে বশ করে ফেলেছেন নাকি আনন্দের গন্ডি দিল্লি থেকেই বেঁধে দেওয়া হয়েছে? মনে হয় রাজ্য বিজেপির নেতারাও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আতান্তরে।

Feature Image is representational. Image Credit- The Economic Times.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *