বিধানসভায় মমতার ঘরে শুভেন্দু! নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ না তার চেয়েও বেশি কিছু? - nagariknewz.com

বিধানসভায় মমতার ঘরে শুভেন্দু! নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ না তার চেয়েও বেশি কিছু?


ঠিক কোন উদ্দেশ্যে হঠাৎ শুভেন্দুর প্রতি সদয় মমতা, তা নিয়ে বড়‌ই ধন্ধে‌ সবা‌ই। রাজনীতিতে নিছক সৌজন্য বলে কিছু নেই। সৌজন্যের ভেতরেও রাজনীতি থাকে। সেই রাজনীতিটাই খুঁজছে রাজনৈতিক মহল। লিখলেন নির্বাণ রায়-

শুক্রবার বিধানসভায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশন চলছে। অধিবেশন কক্ষে দু’জনের ক্ষণিকের সৌজন্য বিনিময় নয়। একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে‌ই ডাক পেলেন শুভেন্দু। ২০২০-র ১৭ ডিসেম্বর তৃণমূল ত্যাগের পর এই প্রথম মমতার মুখোমুখি হলেন শুভেন্দু। যদিও মমতার সঙ্গে শুভেন্দুর এই সাক্ষাৎ ঠিক একান্ত ছিল না। দলের তিন বিধায়ক মনোজ টিগ্গা, অগ্নিমিত্রা পল ও অশোক লাহিড়িকে  সঙ্গে নিয়ে‌ই মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন বিরোধী দলনেতা।

সংসদীয় গণতন্ত্রে এই ধরণের সাক্ষাৎ বেনজির কিম্বা অনভিপ্রেত, কোনটাই নয়। বরং সরকার প্রধান ও বিরোধী নেতার মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সৌহার্দ্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ বলেই বিবেচিত। যদিও এটাও সমান সত্যি যে, রাজনীতিকদের জীবনযাপনে কোনও কিছুই অরাজনৈতিক নয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই মমতা-শুভেন্দুর সাক্ষাৎ ঘিরে রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনার জন্ম হ‌ওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এই মুহূর্তে বাংলার রাজনীতিতে মমতা-অভিষেকের সঙ্গে শুধু একা শুভেন্দু নয় গোটা অধিকারী পরিবারের সম্পর্কের তিক্ততা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা সবার জানা। তৃণমূল ত্যাগের অনেক আগে থেকেই অভিষেকের সঙ্গে শুভেন্দুর দূরত্ব বাড়ছিল। এই দুরত্ব মমতা ঘোচাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই শুভেন্দু তৃণমূল ছাড়তে বাধ্য হন বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। একুশে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিততে পারেন নি। শুভেন্দুর কাছে সামান্য ভোটে পরাজয়ের বেদনা যে তিনি মেনে নিতে পারেন নি, তা বহুবার ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। নন্দীগ্রামে ভোটের ফলকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা পর্যন্ত ঠুকেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পর থেকে মাঝেমধ্যেই কম্পার্টমেন্টাল পাশ মুখ্যমন্ত্রী বলে মমতাকে কটাক্ষ করেন নন্দীগ্রামের বিজেপি বিধায়ক।

বিজেপি বাংলা দখল করতে না পারলেও নন্দীগ্রামে মমতাকে হারিয়ে বিধানসভায় ঢোকার সুবাদে শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলনেতা হতে পেরেছেন শুভেন্দু অধিকারী। অনেকেই মনে করে থাকেন, বিজেপির লোকসান করার চাইতে মমতা-অভিষেকের অনেক বেশি ‌নজর শুভেন্দুর পলিটিক্যাল কেরিয়ার ধ্বংস করার দিকে। তৃণমূল থেকে যারা বিজেপিতে গিয়েছিলেন, মুকুল রায় সহ সকলেই সুর সুর করে মমতার ঘরে ফিরে এসেছেন। ব্যতিক্রম একমাত্র শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু নিজেও ভাল জানেন, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তৃণমূলে ফেরার একমাত্র বিকল্প- বিরোধী শিবিরে থেকে মমতার সরকারকে নাস্তানাবুদ করে তোলা। রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সরকার বিরোধী যে কোনও ইস্যুতে সবথেকে বেশি সোচ্চার হতে দেখা যায় শুভেন্দু অধিকারীকেই।

রাজনৈতিক মহল যখন ধরেই নিয়েছে, এই মুহূর্তে বাংলার রাজনীতিতে সবথেকে বড় যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের নাম মমতা আর শুভেন্দু তখন আচমকা তাঁদের সৌজন্য সাক্ষাতের সংবাদ সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয় কি? তৃণমূলকে পিসি-ভাইপো লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে  লাগাতার আক্রমণ শানিয়ে যাওয়া শুভেন্দুর প্রতি হঠাৎ এত সৌজন্য প্রকাশের তাগিদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে দেখা দিল কেন? শুভেন্দুকে মমতা একাই বিধানসভা ভবনে নিজের ঘরে চা খেতে ডেকেছিলেন বলে শোনা যাচ্ছে। একা মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে চা পান করতে ঢুকলে রাজনৈতিক মহলের কাছে কী বার্তা যাবে, তা ভালোই বোঝেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। তাই অগ্নিমিত্রা পল, মনোজ টিগ্গা ও অশোক লাহিড়িকে সঙ্গে নিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করে বিষয়টির রাজনৈতিক গুরুত্ব লঘু করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন শুভেন্দু। এমনটাই ধারণা অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যারা ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, তারা জানেন, চক্ষুশূল এমন কার‌ও সঙ্গে সৌজন্যের ধার তিনি বড় ধারেন না। গত পরশু পর্যন্ত যাঁকে এড়িয়ে চলতেন হঠাৎ কী কারণে তাঁর প্রতি এত সদয় তৃণমূল সুপ্রিমো? তৃণমূল তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসার মাত্র দেড় বছর হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই দল এবং সরকারের নাকানিচোবানি অবস্থা। তাঁর সাড়ে এগার বছরের রাজত্বে মমতা ঘরে-বাইরে এমন বিপাকে আর কখনও পড়েন নি বলেই মনে করে রাজনৈতিক মহল। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। অথচ একশ দিনের কাজ সহ গ্রামোন্নয়ন খাতে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বকেয়া মেলা। কেন্দ্র সেই টাকা কবে ছাড়বে, এখনও স্পষ্ট নয়। ভোটের আগে রাজ্য সরকারের হাতে টাকা না এলে ভোটবাক্সে তার প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। অন্যদিকে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে জেলায় জেলায় তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে তৃণমূল বনাম তৃণমূলের লড়াইয়ে কটা লাশ পড়ে এই ভয়ে শঙ্কিত সবাই। এক নিয়োগ দুর্নীতিই রাজ্য সরকারকে দিশেহারা করে দিয়েছে। বাকি ঘোটালার ঝাঁপি ঠিকমতো খোলা হলে পরিস্থিতি কোথায় যাবে, কে জানে! মমতার বিড়ম্বনা শুধু বাইরে নয় ঘরেও তিনি শান্তিতে নেই বলে খবর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও তৃণমূলের সুপ্রিমো কিন্তু তৃণমূল আর আগের মতো এক মেরু কেন্দ্রিক দল নয়। তৃণমূলে এখন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থাকলে ক্যামাক স্ট্রিট‌ও আছে। কালীঘাট না ক্যামাক- তৃণমূলে কার পাল্লা ভারি, এই নিয়েও জল্পনার শেষ নেই বাজারে।

মুকুলের সঙ্গে ঝামেলা আগেই মিটিয়ে নিয়েছেন মমতা। শোভনের উপরে জমে থাকা রাগ‌ও জল হয়ে বেরিয়ে গেছে। ক্যামাক স্ট্রিটকে দুর্বল করতেই দূরে সরে যাওয়া পুরোনোদের আবার তৃণমূল সুপ্রিমো কাছে টেনে নিচ্ছেন বলে রাজনৈতিক মহলের অনুমান। ডিসেম্বরে রাজ্য রাজনীতিতে একটা বড় কিছু ঘটতে চলেছে- পুজোর আগে থেকেই এই আওয়াজ তুলেছে বিজেপি। বিজেপির ভেতরে আওয়াজটা আবার বেশি শোনা যাচ্ছে শুভেন্দুর গলায়। ছয়মাস পরে নতুন তৃণমূল আত্মপ্রকাশ করবে- অভিষেক ব্যানার্জির ছবি দিয়ে এমন হোর্ডিং পড়েছিল কলকাতায় অগাস্টে। ছয়মাস পূর্ণ হতে আর বেশি দেরি নেই। ডিসেম্বর পড়ার আগেই নভেম্বরের ২৫ তারিখ শুভেন্দুকে ‘ভাই’ বলে নিজের ঘরে ডেকে নিলেন মমতা। কেন?

ঠিক কোন উদ্দেশ্যে হঠাৎ শুভেন্দুর প্রতি সদয় মমতা, তা নিয়ে বড়‌ই ধন্ধে‌ সবা‌ই। রাজনীতিতে নিছক সৌজন্য বলে কিছু নেই। সৌজন্যের ভেতরেও রাজনীতি থাকে। সেই রাজনীতিটা আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পরিস্কার হবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

Feature Image is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *