উদ্ধব-একনাথের বিবাদে বিলোপের পথে বালাসাহেবের শিবসেনা! নাম ও প্রতীক হারালো দুই পক্ষই - nagariknewz.com

উদ্ধব-একনাথের বিবাদে বিলোপের পথে বালাসাহেবের শিবসেনা! নাম ও প্রতীক হারালো দুই পক্ষই


কাগজে-কলমে লুপ্ত বালাসাহেবের ‘শিবসেনা’। অযোগ্যে নেতৃত্বের হাতে‌ পড়ে এইভাবেই ধংস হয়ে যায় একটি শক্তিশালী দল। লিখলেন নির্বাণ রায়-

গোষ্ঠী কোন্দল এবং অযোগ্য নেতৃত্ব একটা দলকে কীভাবে বাঘ থেকে বিড়ালে পরিণত করে, চোখের সামনে তার সবথেকে বড় উদাহরণ শিবসেনা। লোকান্তর থেকে নিজের দলের দুর্দশা চাক্ষুষ করার সুযোগ পেলে নিঃসন্দেহে‌ দুঃখে অশ্রুপাত করবেন বালাসাহেব ঠাকরে। ঠাকরে চোখ বুজেছেন ২০১২-র ১৭ নভেম্বর। বালাসাহেবের মৃত্যুর দশ বছরের মধ্যে তাঁর সন্তানসম দল ছন্নছাড়া। সোমবার নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে প্রতীক পর্যন্ত খুইয়েছে শিবসেনা। জন্মলগ্ন থেকেই শিবসেনার প্রতীক তিরধনুক। এই প্রতীক নিয়েই মহারাষ্ট্রে নির্বাচনে লড়েছে বালা ঠাকরের দল। নির্বাচন কমিশনের খাতায় শিবসেনা নামটিই তো আর অক্ষত নেই। একনাথ শিন্ডে উদ্ধব ঠাকরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার পর থেকেই শিবসেনা আড়াআড়ি বিভাজিত হয়ে গেছে। যে কোনও দল এই রকম পরিস্থিতির শিকার হলে তার প্রতীক নিয়ে দুই তরফে টানাটানি পড়ে। শিবসেনার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি।

নাম ও প্রতীক- দুটোর উপরেই অধিকার হারালো দুই গোষ্ঠী।

উদ্ধবের সঙ্গ ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে একনাথ শিন্ডে এখন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী। শিবসেনার সিংহভাগ বিধায়ক শিন্ডে শিবিরে। দলের নাম ও প্রতীক নিয়ে মামলা গড়িয়েছে নির্বাচন কমিশনে। উদ্ধব এবং শিন্ডে- দুই পক্ষই প্রকৃত  শিবসেনার মালিকানা ও তির-ধনুক প্রতীকের দাবিদার। কোনও দলে এই ধরণের জটিলতা দেখা দিলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত‌ই চূড়ান্ত। প্রথমে গত ৪ অক্টোবর ‘শিবসেনা’ নাম ও দলটির তির-ধনুক প্রতীকের ব্যবহার
সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় কমিশন। এরপর উদ্ধব ও সিন্ধে- দুই গোষ্ঠীকেই তিনটি করে নাম ও প্রতীক জমা দিতে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। দলের নাম ও প্রতীক খুইয়ে উদ্ধব গোষ্ঠী নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে বটে তবে আদালতে উদ্ধব ঠাকরে কতটা সুরাহা পাবেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

সোমবার নির্বাচন কমিশনের জারি করা নির্দেশিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, শিবসেনা বলে কোন‌ও দলের অস্তিত্ব‌ই আর র‌ইল না। এখন থেকে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর নাম হল শিবসেনা ( উদ্ধব- বালাসাহেব ঠাকরে)। আর শিন্ডে গোষ্ঠীর নাম হল শিবসেনা (বালাসাহেবচি)। উদ্ধব গোষ্ঠীর জন্য নির্বাচন কমিশন বরাদ্দ করেছে ‘মশাল’ প্রতীক। শিন্ডে গোষ্ঠীর জমা দেওয়া তিনটি প্রতীকের একটির সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্ক রয়েছে, এই বিবেচনায় সেটি বাতিল করেছে কমিশন। দুই গোষ্ঠীই দুটি প্রতীকের ( উদীয়মান সূর্য ও ত্রিশূল) দাবিদার হ‌ওয়ায় দুটিই বাতিল করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। শিন্ডে গোষ্ঠীকে ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য তিনটি প্রতীক নতুন করে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত জুন মাসে একনাথ শিন্ডে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করার পর থেকেই শিবসেনার দখল নিয়ে দুই শিবিরে টানাটানি। উদ্ধব আগেই বুঝেছিলেন, বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের দরবারে গেলে আম-ছালা দুইই যাবে। প্রকৃত শিবসেনার দখল কায়েম রাখতে উদ্ধব শিবির সুপ্রিম কোর্টে গেলেও লাভের লাভ কিছু করতে পারে নি। দলের নাম ও প্রতীক নিয়ে কমিশন যাতে কোন‌ও সিদ্ধান্ত নিতে না পারে- এই আর্জি নিয়েই শীর্ষ আদালতে গিয়েছিল উদ্ধব শিবির। কিন্তু উদ্ধব গোষ্ঠীর আর্জি খারিজ করে দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপরেই ছেড়ে দেয় পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ।‌

গুরু-শিষ্য: বালাসাহেব ঠাকরে ও একনাথ শিন্ডে।

সোমবারের ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিস্কার- মারাঠা অস্মিতাকে আধার করে ৫৬ বছর আগে মুম্বাইয়ে যেই দলের গোড়াপত্তন করেছিলেন বালাসাহেব ঠাকরে, ২০২২-এর ১০ অক্টোবর থেকে কাগজে-কলমে তার আর কোন‌ও অস্তিত্ব র‌ইল না। বালাসাহেবের জীবদ্দশাতেই ভাইপো রাজ থাকরে শিবসেনা ত্যাগ করে পৃথক দল গড়লেও তাতে শিবসেনার কোনও ক্ষতি হয় নি। বালাসাহেবের মৃত্যুর পর শিবসেনার ভবিষ্যত নিয়ে একটা শঙ্কা ছিল‌ই রাজনৈতিক মহলের। উদ্ধবের নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা নিয়ে দলের মধ্যে প্রশ্ন প্রথম থেকেই। বাবার বলিষ্ঠতা বা ক্যারিশ্মা- কোনটাই পান নি উদ্ধব। বালাসাহেবকে সমীহ করে চলত বিজেপি। বালাসাহেব‌ও কখনও বিজেপির হাত ছাড়ার কথা ভাবেন নি। যতদিন বাল থাকরে ছিলেন, ততদিন মহারাষ্ট্রে শিবসেনাকেই বড় শরিকের সম্মান দিয়ে এসেছে বিজেপি। বাঁচা থাকতেই ছেলে উদ্ধবের হাতে দলের দায়িত্বভার ছেড়ে দেন বালাসাহেব। কিন্তু উদ্ধবের যে পিতার ন্যায় নেতৃত্ব গুণ নেই, তা বালাসাহেব থাকতেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা কিম্বা জনপ্রিয়তা- দুটোরই অভাব উদ্ধব ঠাকরের মধ্যে। দূরদর্শিতা থাকলে উদ্ধব উনিশের বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির সঙ্গে জোট ভাঙার আগে দশবার ভাবতেন। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শি পাওয়ার লোভে কংগ্রেস ও এনপিপির সঙ্গে জোট গড়ে উদ্ধব শিবসেনার রাজনৈতিক চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছেন বলে অসংখ্য শিবসৈনিকের অভিযোগ।

বাবার বলিষ্ঠতা কিম্বা ক্যারিশ্মা- দুটোর কোন‌ওটাই নেই উদ্ধবের।

উদ্ধব ঠাকরে বরাবরই শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাঁর হৃদযন্ত্রের অবস্থা ভাল নয়। মাতশ্রীর বাইরে তাঁকে কদাচিৎ দেখা যায়। দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা তাঁর নাগাল পান না। এই নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ শিবসেনার অন্দরে। এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই দলে বড়সড় ফাটল ধরাতে সক্ষম হন একনাথ শিন্ডে। শুধু শিবসেনার অধিকাংশ বিধায়ক‌ই নয় দলের সাধারণ নেতাকর্মী- সমর্থকেদের‌ সিংহভাগকেও নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছেন শিন্ডে।

Feature image is representational. Photo credit- Verified FB page of Uddhav Thackeray and Eknath Shinde.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *