২০১৩ থেকে ২০২১- আট বছরে বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৬৭৯টি।বিশেষ প্রতিবেদন-
বাংলাদেশে আবারও আক্রান্ত সংখ্যালঘুরা। গত বছর শারদীয় দুর্গাপুজোর সময় একযোগে বাংলাদেশের ২৫টি জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সহিংসতার শিকার হয়েছিল। বছর ঘোরার আগেই ফের বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হামলার মুখে পড়ল। এবার ঘটনাস্থল নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা। এমনিতে বিচ্ছিন্নভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন বাংলাদেশে প্রায় রোজকার ঘটনা। চলতি বছরেই বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে একাধিক হিন্দু শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযোগ এক- ধর্মানুভূতিতে আঘাত। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ায় হামলার ঘটনার পেছনেও একই অজুহাত- ধর্মানুভূতিতে আঘাত।
উত্তেজনার আঁচ পাওয়ার পরেও পুলিশ অসতর্ক
সাহাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এক কলেজ ছাত্রের ফেসবুক পোস্টে পয়গম্বরের অবমাননা হয়েছে- এই অভিযোগে শুক্রবার সকাল থেকেই এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়। অভিযোগ পাওয়া মাত্রই লোহাগড়া থানার পুলিশ অভিযুক্ত ছাত্রের বাসায় হানা দেয়। ছাত্রটিকে না পেয়ে তার বাবাকেই গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। ভাসা ভাসা অভিযোগের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজনকে গ্রেফতার করতে পুলিশ কালবিলম্ব না করলেও জনরোষের হাত থেকে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে লোহাগড়া থানা কোনও আগাম পদক্ষেপ করে নি বলে অভিযোগ। অথচ হিন্দুপাড়া আক্রান্ত হতে পারে, এরকম আঁচ সকালেই পাওয়া গিয়েছিল। দুপুরে জুম্মার নামাজের পরপরই সাহাপাড়ায় আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে যায়। তারপরেও পুলিশ কেন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রাম ঘিরে সতর্ক অবস্থান নিল না- এই প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলি।
আড়াই ঘণ্টা ধরে হিন্দু গ্রামে তান্ডব, পুলিশ ভ্যানিশ!
শুক্রবার সন্ধ্যা নামতেই কয়েক হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা, চাপাতি, বল্লম, তলোয়ার, হাঁসুয়া নিয়ে সাহাপাড়া এলাকায় হামলা চালায়। ১২০টি বাড়িতে আক্রমণ চালানো হয়। বাড়িঘর তছনছ করতে থাকে উন্মত্ত জনতা। শতশত অস্ত্রধারীদের দেখে প্রাণভয়ে গ্রামবাসীরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১০টি বাড়ি পুড়ে ছাই। দীঘলিয়া বাজারে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের সবথেকে বড় মন্দিরটিতেও হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। এছাড়াও এলাকার আরও নটি মন্দিরে চড়াও হয়ে ভাঙচুর ও প্রতিমা বিনষ্ট করে হামলাকারীরা। দীঘলিয়া বাজারে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩৭টি দোকান ভাঙচুর ও লুট করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/07/IMG_20220718_194039_480.jpg)
সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত টানা আড়াই ঘন্টা দীঘলিয়া বাজার এবং সাহাপাড়ায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, উপাসনাস্থল এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উপর তান্ডব চলে। ঘটনার সময় ধারেকাছে পুলিশের দেখা মিলে নি বলে আক্রান্ত গ্রামবাসীদের অভিযোগ। স্থানীয় পুলিশের যদিও দাবি, গন্ডগোলের খবর পাওয়া মাত্রই ঘটনাস্থলে এসে শূন্যে গুলি চালিয়ে ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় তারা। লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়া বাজার ও সাহাপাড়ার পরিস্থিতি যদিও সাক্ষ্য দিচ্ছে পুলিশ আসার আগেই দীর্ঘ সময় ধরে অবাধে তান্ডব চালিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম শ্মশান করে দিয়েছে হামলাকারীরা।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/07/IMG_20220718_193934_951.jpg)
বাংলাদেশে নিরাপত্তা চাওয়াটাই কি সংখ্যালঘুদের অপরাধ?
ঘটনার পর আক্রান্ত গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হলেও সংখ্যালঘুরা ভয়ে-আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই নড়াইল জেলারই মির্জাপুরে মাত্র একমাস আগে ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক স্বপনকুমার সাহা এবং কলেজের এক হিন্দু ছাত্রকে গলায় জুতোর মালা পড়িয়ে পুলিশের সামনেই ঘোরায় মুসলমান ছাত্ররা। ছাত্রটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- সে তার ফেসবুকে নূপুর শর্মার সমর্থনে পোস্ট দিয়েছে। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপনকুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তিনি স্বজাতি ছাত্রটিকে মদত দিয়েছেন। একমাস পর একই অভিযোগে নড়াইলের লোহাগড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের গ্রামশুদ্ধ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে- বাংলাদেশে কি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বলে নূন্যতম কিছু নেই?
ফেসবুক না সংখ্যালঘুর মরণফাঁদ?
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কাছে এখন ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যম হয়ে উঠেছে বিপদের আরেক নাম। এর আগে একাধিক ঘটানায় প্রমাণিত হয়েছে- হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনও যুবকের নামে ভুয়ো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য পোস্ট করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়া গ্রামের ঘটনার পেছনেও তেমন কোনও ষড়যন্ত্র আছে বলে এলাকার আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের অভিযোগ। ভুয়ো ফেসবুকের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতার অভাব আছে বলে মনে করেন দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা। একই অভিযোগ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মতো সংখ্যালঘুদের সংগঠনেরও।
আওয়ামি জামানায় সংখ্যালঘুরা আদৌ ভাল আছে?
বাংলাদেশের ভেতরে তো বটেই বাংলাদেশের বাইরেও এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, আওয়ামি লিগের আমলেই সংখ্যালঘুরা সবথেকে বেশি নিরাপদ। অথচ পরিসংখ্যান অন্য কথা বলছে। ২০১৩ থেকে ২০২১- এই আট বছরে বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৬৭৯টি। এর মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। সংখ্যালঘুদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ৪৪২টি। প্রতিমা, পুজোমন্ডপ এবং মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন লাগানোর ঘটনা ১ হাজার ৬৭৮টি।
নড়াইলে হিন্দু গ্রাম বিধ্বস্ত, কলকাতার মিডিয়া চুপ
গতবছর দুর্গাপুজোর সময় বাংলাদেশ জুড়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হলেও গত শুক্রবার নড়াইলের লোহাগড়ায় হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নিয়ে কলকাতার মিডিয়া কার্যত নিশ্চুপ।
ভিডিও- নড়াইলে জ্বলছে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি
Photo and Video sources- collected.