২০১৪ থেকে ২১- মাত্র সাত বছরে কার্যত বিনা মেহনতে মসনদ জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ায় বঙ্গ বিজেপির নেতারা মানুষের আস্থার মূল্য দিতে শেখেন নি।
বিশেষ প্রতিবেদন : একুশের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট- ২ কোটি ২৮ লক্ষ ৫০ হাজার ৭১০টি। প্রাপ্ত ভোটের হার ৩৮.১৩ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে জন্মলাভের পর ২০১১ পর্যন্ত তৃণমূল কখনও তিরিশ শতাংশের বেশি ভোট পায় নি। এমনকি ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন দলগতভাবে সিপিএমেরও কখনও সৌভাগ্য হয় নি এত ভোট পাওয়ার। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় চল্লিশ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল বিজেপি। দুই বছর পর বিধানসভা ভোটে বিজেপি দুই শতাংশ ভোট হারায়। বিধানসভা নির্বাচনের বছর ঘুরতে চলল। রাজ্য বিজেপিকে দেখে মনে হচ্ছে জনগণের দেওয়া গুরু দায়িত্ব পালন করার যোগ্যই নয় দলটি।
বঙ্গ বিজেপি কি আদৌ সাবালক?
প্রত্যাশা জাগিয়েও ক্ষমতায় আসতে না পারলেই একটা দলের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায় না। যদি কোনও রাজনৈতিক দলের তেমনটাই হয় তবে বলা দরকার সেটা কোনও পরিণত মনস্ক দলই না। সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপির পেশাদারিত্ব, পরিকল্পনা এবং শক্তিশালী সংগঠন প্রতিপক্ষদের ঈর্ষার কারণ। মাত্র একচল্লিশ বছরেই দেশের সবথেকে শক্তিশালী জাতীয় দল হয়ে ওঠা বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখা কি আদৌ রাজনৈতিক ভাবে সাবালক? সদ্য কয়েক দিন আগেই পাঞ্জাবে আপ ক্ষমতা দখল করল তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। পাঁচ বছর আগে প্রবল প্রত্যাশা জাগানোর পরেও পাঞ্জাবে ক্ষমতা দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিল কেজরিওয়ালের দল। আপকে বিরোধী বেঞ্চে বসতে হয়েছিল। রানার্সআপ হয়ে আপ পাঞ্জাব থেকে হারিয়ে যায় নি। পাঁচ বছর পরে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি ছিনিয়ে নিয়েছে। বাংলায় বিজেপি যদি মাত্র তিন আসন থেকে বিধানসভার ভেতরে শাসকদলের একমাত্র প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার পরেও স্বখাত সলিলে ডুবতে বসে তবে দলটির নেতৃত্ব জনগণের কাছে মুখ দেখাবেন কোন লজ্জায়?
ভোটে হারার কারণে নয় বিজেপি ডুববে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে
বিধানসভা ভোটের পর থেকে রাজ্যে বিজেপি একটি উপনির্বাচনেও জিততে পারে নি। পুরভোটেও ফল হতাশাজনক। কিন্তু এটা আদৌ তেমন বড় বিষয় নয়। হ্যাঁ! এটা তেমন বড় বিষয়ই নয়। ১৯৯৯ থেকে ২০১১- কটা উপনির্বাচনে জিতেছিল তৃণমূল? বাম আমলে কটা উপনির্বাচনে জিতত অবিভক্ত প্রদেশ কংগ্রেস? ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র তিরিশটা আসন পাওয়া তৃণমূল পাঁচ বছর পরেই মহাকরণ দখল করবে-কেউ ভেবেছিল সেদিন? উপর্যুপরি ভোটে হারের জন্য নয় রাজ্য বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় জাগছে দলটির নেতৃত্বের অন্তঃসারশূন্যতার জন্য। গোটা দলটা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ। শীর্ষ নেতৃত্বে হাতে গোনা কয়েকজন বাদ দিলে মাটির সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। দলের ভেতরে টাকা পয়সার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা হামেশাই হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। অনেকের চরিত্র দোষ সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল। তথাগত রায় বনাম দিলীপ ঘোষের কাদা ছোড়াছুড়ি কোথায় গিয়ে শেষ হবে কেউ জানে না। দলের ভেতরে থেকে প্রতিপক্ষ শিবিরের হয়ে কাজ করার লোকের অভাব নেই রাজ্য বিজেপিতে। ভোটের সময় এক গোষ্ঠী প্রচারে ব্যস্ত থাকলে আরেক গোষ্ঠী অন্তর্ঘাতে। রাজ্য বিজেপিতে এমন নেতা ভুড়ি ভুড়ি কালীঘাট টোপ দেওয়া মাত্রই যাঁরা টপাস করে গিলে নেবেন। উপর থেকে নিচ- গোষ্ঠীকোন্দলে তৃণমূলও জর্জরিত কিন্তু তৃণমূলে একজন মমতা ব্যানার্জি আছেন। রাজ্য বিজেপির ভেতরে মমতার সমতুল্য কোনও নেতা নেই যাঁর কথায় সদা উজ্জীবিত থাকবেন কর্মী-সমর্থকেরা।
নেতারা অধঃপাতে গেলে কর্মীরা কেন বুথ আগলাবে?
বিরোধী থাকতেই যেই দলে এত খোয়াখুয়ি, ক্ষমতা হাতে পেলে না জানি সেই দলের কতটা অধঃপতন হত। শীর্ষ নেতৃত্বের পদস্খলনের জের পৌঁছাচ্ছে পদ্ম শিবিরের বুথ স্তরে। নেতারা অধঃপাতে গেলে কর্মীরা কেন ঝান্ডা ধরে বসে থাকবে? বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে বিরোধী দল করলে পদে পদে লাঞ্ছিত হওয়ার ভয় আছে। বুথস্তরে সংগঠন কী জিনিস রাজ্য বিজেপি কোনও দিনই জানত না। জানার দরকারও পড়ে নাই। নির্বাচনে চার-পাঁচ শতাংশ করে ভোট জুটত। চার-পাঁচ শতাংশ ভোট পাওয়ার জন্য বুথে বুথে এজেন্ট দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। রাজ্য বিজেপির কোন নেতা কবে ভেবেছিলেন তাদের ঝুলিতে ৩৮-৪০ শতাংশ ভোট পড়বে। ৩৮ শতাংশ ভোট পাওয়ার জন্য কত বছর ধরে কতটা মেহনত করতে লাগে বাংলার বিজেপি নেতাদের তা জানা নেই। কারণ ২০০১৪-র পর থেকে হঠাৎ করেই পশ্চিমবঙ্গে পদ্মের পালে হাওয়া লাগে। ২০১৪ থেকে ২১- মাত্র সাত বছরে কার্যত বিনা মেহনতে মসনদ জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ায় বঙ্গ বিজেপির নেতারা মানুষের আস্থার মূল্য দিতে শেখেন নি।
নিজের তাগিদেই লড়ে যাচ্ছেন এক মাত্র শুভেন্দু
শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে না এলে এখন তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী থাকতেন। শুভেন্দুর মনে কী আছে একমাত্র শুভেন্দু আর অন্তর্যামী জানেন। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর বাম আমলে মাটি কামড়ে লড়ার অভিজ্ঞতা আছে। বিজেপিতে এসে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন শুভেন্দু। ভোটের লড়াইয়ে হেরে হতোদ্যম হয়ে ঘরে বসে যাওয়া কিম্বা দলের মধ্যে অন্যের পেছনে কাঠি করা কোনও কাজের কথা নয়। রাজনীতিতে কেউ ধোয়া তুলসী পাতা নয়। নিজের জমি রক্ষায় গোষ্ঠী কোন্দলে সবাই দড়। শুভেন্দুও। কিন্তু শুভেন্দু পরিশ্রমী। প্রদেশ কংগ্রেসে চিরকালই গোষ্ঠী গোষ্ঠীতে গুঁতোগুঁতি। কিন্তু অন্য নেতারা যখন গিলে করা পাঞ্জাবি পড়ে ঠান্ডা ঘরে বসে চামচা পরিবৃত হয়ে আসর মাতাতেন মমতা তখন রাস্তায় থাকতেন। কংগ্রেসে থাকতে মমতাও গোষ্ঠীবাজি খুব একটা কম করতেন না কিন্তু তার সাথে করতেন বাম বিরোধী আন্দোলনটাও। বিজেপিতে শুভেন্দু অধিকারীও গোষ্ঠীবাজি নিশ্চয় করছেন কিন্তু তার সঙ্গে করছেন সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করার কাজটাও। নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই বিজেপির ভেতরে শুভেন্দুই সর্বাধিক মমতা ও তৃণমূল বিরোধী। সুকান্ত-শুভেন্দু সংগঠন গোছাতে চাইলেও বিপক্ষ গোষ্ঠী তাদের সেই সুযোগ দেবে বলে মনে হয় না। রাজ্য বিজেপিতে আর যা কিছুর অভাব থাকুক গোষ্ঠীর অভাব নেই। মুরলীধর সেন লেনের গেরুয়া গৃহে যখন যেই গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের অপদস্থ করতে বিবদমান গোষ্ঠীগুলি এক হয়ে যায়।
৩০ শতাংশ ভোটের মূল্য কিন্তু অনেক
আসানসোল লোকসভার উপনির্বাচনে বিজেপি খুব খারাপ ফল করলেও ৩০.৪৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা সিপিএম বেশ ভাল ফল করেও ৩০.০৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বিরোধী শক্তির জন্য তিরিশ শতাংশ ভোটটা হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিরিশ শতাংশ ভোট ধরে রাখতে পারলে তা ঠেলে চল্লিশ-বেয়াল্লিশেও ওঠানো সম্ভব। সিপিএম তিরিশ শতাংশ ভোটের মূল্য বোঝে। তাই একটি মাত্র বিধানসভা কেন্দ্রের ফলই রাজ্যের বাম নেতৃত্বকে উজ্জীবিত করেছে। রাজ্য জুড়ে বিজেপির তিরিশ শতাংশ সমর্থন কি এখনও আছে? যদি থাকে বঙ্গের পদ্ম শিবিরে হতাশার কারণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বঙ্গ বিজেপি তিরিশ শতাংশ জন সমর্থন তবেই ধরে রাখতে পারবে যদি তারা বিরোধী দলের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে শেখে। রাজ্য বিজেপির সদা কোন্দলপরায়ণ অপরিণামদর্শী নেতারা দলকে সেই সুযোগ দেবেন এমন ইঙ্গিত কিন্তু মিলছে না।
ফিচার ফটো প্রতীকি।