পাকিস্তান : সংখ্যালঘুদের অন্ধকূপ ! - nagariknewz.com

পাকিস্তান : সংখ্যালঘুদের অন্ধকূপ !


নএনডিসি বিশেষ প্রতিবেদন : পাকিস্তান । যার অর্থ হল পবিত্রভূমি । তবে ৭৪ বছর আগে ভারত ভেঙে জন্ম নেওয়া এই ভূমি সংখ্যালঘুদের জন্য পবিত্র তো‌ নয়‌ই বরং নরক বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই । সংখ্যালঘু নাগরিকদের জন্য দেশটি অন্ধকূপ ছাড়া কিছুই নয় । পাকিস্তানের হিন্দু-খ্রিস্টান-শিখদের সামনে  হয়  অসম্মানের সঙ্গে বাঁচা নয় বেঘোরে মরার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার দুটি মাত্র বিকল্প খোলা । একটি ধর্মান্তর আরেকটি দেশান্তর । 

মহম্মদ আলি জিন্নাহর  পাকিস্তানের সংবিধানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য সমানাধিকারের কথা বলা আছে । ৭৪ বছর ধরে সমানাধিকারের ঠ্যালায় পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা আক্ষরিক অর্থেই মাইক্রোস্কোপিক মাইনোরিটিতে পরিণত হয়েছে । পাকিস্তানে এই মুহুর্তে হিন্দু ও শিখদের সংখ্যা কত তা পাকিস্তান সরকার‌ও জানে না । যাতে জানার দরকার‌ই না পড়ে সেই ব্যবস্থাও করে রেখেছে তারা । ৯৯৮ সালের পর থেকে ধর্মভিত্তিক জনগণনার পাট তুলে দিয়েছে পাকিস্তান সরকার । ৯৯৮ সালে শেষবারের মতো হ‌ওয়া  ধর্মভিত্তিক জনগণনা অনুযায়ী পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার .৬ শতাংশ । আর মাথা গুণে শিখ পাওয়া  গিয়েছিল সাকুল্যে  হাজার ৪৬ জন ! ২০ সালের জনগণনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে দাবি করা হয় পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা ২. শতাংশ । যদিও এই সংখ্যা সরকারিভাবেই স্বীকৃত নয় । কেননা পাকিস্তান ব্যুরো‌ অব স্ট্যাটিসটিক্স ( Pakistan Bureau of Statistics ) নামে যে সংস্থা জনগণনা পরিচালনা করে, আজ পর্যন্ত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী গুলির বিষয়ে কোন‌ও সুনির্দিষ্ট তথ্য দাখিল করতে ‌পারে নি তারা ।

৯৪৭ সালে দেশভাগের বছর পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে হিন্দুর প্রকৃত সংখ্যা কত ছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে । একটি হিসেব বলছে  ভারতের পশ্চিম অংশের যে ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান তৈরি , সাতচল্লিশে সেখানে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ২০.৫ শতাংশ । একাধিক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে ধারণা করা হয় দেশভাগের সময় পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে । সাতচল্লিশের আগে সিন্ধ প্রদেশের রাজধানী বন্দরনগরী করাচির মোট জনসংখ্যার অর্ধেক‌ই ছিল হিন্দু । পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরের তিরিশ শতাংশ বাসিন্দাই ছিলেন হিন্দু ।  দেশভাগের পরপরই  পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের গণ‌অভিবাসন নিয়ে আর নতুন করে বলার কিছু নেই । জন্মের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই  সংখ্যালঘুদের ভার ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে সফল হয় পাকিস্তান । ৯৫র‌ প্রথম জনগণনাতেই ফল মেলে হাতেনাতে । দেখা যায় ইসলামের পবিত্রভূমিতে ( পশ্চিম অংশে )  হিন্দুর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র .৩ শতাংশ ! 

পাকিস্তানের একটি পরিত্যক্ত হিন্দু  মন্দির: এ রকম ৪০৮টি পরিত্যক্ত মন্দির আছে পাকিস্তান জুড়ে।

        

হিন্দু-খ্রিস্টান-শিখ সহ পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা পৃথিবীর সবথেকে দ্রুত  বিলীয়মান নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠী গুলির একটি । এবার হোলি উপলক্ষে দেশের হিন্দুদের বাধাই দিতে গিয়ে স্বজাতির কাছেই উপহাসের খোরাক হয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান । অনেকেই হেসে বলেছেন দেশে যে‌ ক’জন হিন্দু আছে তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে মেঠাই সহ হোলি কা বাধাই  দিয়ে এলেই তো পারেন ইমরান ভাইজান । এই সামান্য সংখ্যক হিন্দুর‌ও সম্ভ্রম ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ ইসলামিক  রিপাবলিক অব পাকিস্তান ।  এদের পৃথক ধর্মীয় পরিচয় দ্রুত মুছে ফেলতে পারলেই বরং স্বস্তি পায় পাকিস্তান রাষ্ট্র । সরকারি চাকরি , অনুদান , ব্যাঙ্ক ঋণ , জমি-জায়গা , বসতবাড়ি থেকে‌ শুরু করে  সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক প্রকল্পের সুবিধা লাভ – সমস্ত কিছু থেকেই বঞ্চিত পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা । এমনকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়কালে হিন্দুদের ত্রাণ থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ‌ও উঠেছে ।   সবকিছু বাদ দিলেও থাকে নিরাপত্তা – যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত নির্বিশেষে সকল নাগরিককে দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য ।  যে ক’জন হিন্দু দেশে আছে তাদের ধর্মান্তরিত না করা পর্যন্ত বেহস্তে গিয়েও আরাম পাবে না এমন লোকের সংখ্যা পাকিস্তানে কম নয় । বলপূর্বক ধর্মান্তরণ সেদেশে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে বললে অতিশয়োক্তি হয় না । 


হিন্দু পরিবার গুলি যাতে স্বধর্মে কন্যা পাত্রস্থ করেও রেহাই না পায় সেই‌ ব্যবস্থাও করে রেখেছে পাকিস্তান সরকার ! আত্মপ্রকাশের পর ৭০ বছর‌ পর্যন্ত হিন্দুদের বিবাহ আইনত নিবন্ধনের কোন‌ও ব্যবস্থাই ছিল না পাকিস্তানে । অর্থাৎ হিন্দু বিবাহের কোন‌ও আইনি স্বীকৃতিই ছিল না দেশটিতে । ২০ সালে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে হিন্দু বিবাহ আইন পাশ হলেও আইনে ফাঁক রাখতে ভোলেন নি পবিত্রভূমির  আইন প্রণেতারা । 


পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরিত করার সবথেকে সুলভ রাস্তা মেয়েদের অপহরণ করে নিকাহ । প্রশাসনের নীরবতা অথবা প্রচ্ছন্ন মদতে এই উপায়ে হিন্দু-খ্রিস্টান-শিখ কিশোরীদের ধর্মনাশ সামাজিক রেওয়াজে পরিণত হয়েছে পাকিস্তানে। দ্য হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তানের ( HRCP ) একটি প্রতিবেদন বলছে মাসে ‌গড়ে ২০ থেকে ২৫ টি করে সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোরীকে অপহরণ করে বিয়ের ঘটনা ঘটে দেশ জুড়ে । দ্য গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্সের ( GHRD ) তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে বছরে এক হাজারের অধিক হিন্দু ও খ্রিস্টান কিশোরীকে অপহরণ করে ইসলামে  ধর্মান্তরণ ও বিবাহের  ঘটনা ঘটে থাকে । বলা বাহুল্য প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্ষোভে -দুঃখে দেওয়ালে মাথাঠোকা ছাড়া আর কোন‌ও উপায় থাকে না অপহৃতাদের হতভাগ্য বাবা-মায়েদের । পরিস্থিতি এমন‌ই যে থানার সামনে গিয়ে বুক চাপড়ে কাঁদলেও তাঁদের অভিযোগ কানে তোলে না পুলিশ । হিন্দু পরিবার গুলি যাতে স্বধর্মে কন্যা পাত্রস্থ করেও রেহাই না পায় সেই‌ ব্যবস্থাও করে রেখেছে পাকিস্তান সরকার ! আত্মপ্রকাশের পর ৭০ বছর‌ পর্যন্ত হিন্দুদের বিবাহ আইনত নিবন্ধনের কোন‌ও ব্যবস্থাই ছিল না পাকিস্তানে । অর্থাৎ হিন্দু বিবাহের কোন‌ও আইনি স্বীকৃতিই ছিল না দেশটিতে ২০ সালে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে হিন্দু বিবাহ আইন পাশ হলেও আইনে ফাঁক রাখতে ভোলেন নি পবিত্রভূমির   আইন প্রণেতারা । আইনটির ২’র তিন ধারায়‌ বলা হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর কোন‌ও একজন অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে বিবাহটি বাতিল বলে গণ্য হবে ( a marriage will be annulled if any of the spouse converts to another religion )। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কোন মহৎ উদ্দেশ্যে হিন্দু বিবাহ আইনে এই পবিত্র ছিদ্রটি মেহেরবানি করে রেখেছেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের মহান আইন প্রণেতারা ।

অপহরণ করে বিয়ে ও বলপূর্বক ধর্মান্তরণ পাকিস্তানের হিন্দু  কিশোরীদের ললাটলিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে । 

                        

পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সংখ্যালঘু নিপীড়নের আর‌ও একটি মোক্ষম হাতিয়ার হল কুখ্যাত ব্লাসফেমি আইন । কখন কোথায় কীভাবে ধর্ম অবমাননায় ফেঁসে গিয়ে জান যায় এই ভয়ে সদা কুঁকড়ে থাকেন পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা । ব্লাসফেমি আইনে অভিযোগ প্রমাণিত হলে  শাস্তি একটাই আর সেটা মৃত্যুদণ্ড । তবে আদালত কবে অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ড দেবে এই অপেক্ষায় বসে থাকার বান্দা অনেকেই নয় । ধর্ম অবমাননার গুজব ‌তুলে শিকারকে মেরে ফেলাই রেওয়াজ পাকিস্তানে । ৯৮৭ থেকে ২০ – এই সময়সীমার মধ্যে পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ৭৫ জনকে বিচারবহির্ভূত ভাবে হত্যা করা হয়েছে । বলা বাহুল্য ব্লাসফেমি ভিকটিমদের  নব্বুই শতাংশ‌ই  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ । হিন্দুদের জমি-জায়গা-মকান দখলে নিতে ধর্ম অবমাননার  চেয়ে সহজ রাস্তা আর কিছু নেই পাকিস্তানে ।  মানবাধিকার সংস্থা গুলির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে ৯৮৭ থেকে ২০র মধ্যে পাকিস্তান জুড়ে ব্লাসফেমি আইনে মামলা দায়ের হয়েছে হাজার ৫৪৯ টি । বোঝাই যাচ্ছে আইনি পথে হোক আর বেআইনি পথে সংখ্যালঘুদের বুকে পাড় দিয়ে জিভ বের করে ফেলতে জিন্নার মুলুকে ধর্ম অবমাননার জুড়ি নেই । 


বলপূর্বক  হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরণ বন্ধ কর : পাকিস্তানি হিন্দু জননীদের আর্তনাদ !

         

পাকিস্তানের হিন্দু জনগোষ্ঠী সংখ্যা এবং সম্পদ – দু’দিক দিয়েই নিঃস্ব। সংখ্যাগুরুদের কাছ থেকে নির্যাতন এবং অবহেলা তাদের নিত্যদিনের পাওনা । অভিভাবকেরা মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে ভয় পান । বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাবা-মায়ের চোখের সামনে থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা । সেখানে পথেঘাটে কীসের নিরাপত্তা ! প্রথমে দমন তারপরে দয়া –  পাকিস্তানে দরিদ্র-দুর্বল  হিন্দুদের ধর্মান্তরণের এই হল সবথেকে জনপ্রিয় ফর্মুলা । ধর্ম বাঁচাতে কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে বাঁচেন । ভিসা নিয়ে ভারতে এসে অনেকেই আর ফিরে যান না পাকিস্তান নামক অন্ধকূপে । ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পেশ করা একটি তথ্য অনুযায়ী ২০র ডিসেম্বর থেকে ২০ এর‌ মার্চ – এই মাসেই  হাজার জন পাকিস্তানি হিন্দু ও শিখ দীর্ঘ মেয়াদী ভিসায় ভারতেই  থেকে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন । ইউরোপ- আমেরিকাতেও আশ্রয় জুটে যায় দু’চারজন ভাগ্যবানের । কিন্তু পাকিস্তানের অধিকাংশ দরিদ্র-লাঞ্ছিত সংখ্যালঘুর‌ ভবিষৎ পরিণতি ‌ভয়াবহ ! 

ক্রমবর্ধমান দমনের মুখে অস্তিত্ব রক্ষায় স্বধর্ম ত্যাগ ছাড়া তাদের সামনে আর কোন‌ও উপায় আছে বলে মনে হয় না । সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্ম প্রচারকেরা যখন দাওয়াত নিয়ে দুয়ারে হানা দেয় তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে দিনের পর দিন মনুষ্যতর  জীবনযাপনের চেয়ে ইসলাম কবুল পাকিস্তানের হিন্দুদের কাছে  বাঁচার একমাত্র রাস্তা অথবা এসকেপ রুট হয়ে দাঁড়ায় । পাকিস্তানে ধর্মান্তরণ কোন‌ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । প্রত্যেক মাসেই দেশের কোনও না কোনও এলাকায় সংখ্যালঘুদের গণ ধর্মান্তরণ  বা মাস কনভার্শানের খবর পাওয়া যায় । কোভিড অতিমারিকালে ধর্মান্তরণের গতি আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে । কারণ সহজবোধ্য । কোভিড পরিস্থিতি পাকিস্তানের দরিদ্র সংখ্যালঘুদের আরও দরিদ্র করেছে ।পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে সিন্ধুনদের দেশ থেকে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির নাম-নিশান মিটিয়ে দিতে আগামী দেড় দশকের বেশি লাগবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের মনে হচ্ছে না । ভালোই হল । বিধর্মীদের তোহারে বাধাই জানানোর অপ্রিয় কাজ ও গুণাহ  থেকে রেহাই মিলবে পাকিস্তানের ইমানদার ভাবী রাষ্ট্রপ্রধানদের ।


Photo Courtesy – opiindia.com , agniveer , northline and NewsGram  


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *