এক বছরে বেঘোরে মৃত্যু ১১০ জন স্বচ্ছতাকর্মীর ! এ কোন স্বচ্ছ ভারত ? - nagariknewz.com

এক বছরে বেঘোরে মৃত্যু ১১০ জন স্বচ্ছতাকর্মীর ! এ কোন স্বচ্ছ ভারত ?


নাগরিক প্রতিবেদন : ওরা সুইপার । ওরা স্ক্যাভেঞ্জার ।  ওরা সাফাইকর্মী । ওরা মেথর – জমাদার । ইদানিং খাতির করে ভদ্রলোকেরা এদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী , স্বচ্ছতাকর্মী প্রভৃতি নামেও ডেকে থাকেন ।  কয়েক বছর ধরে দেশ জুড়ে স্বচ্ছ ভারত অভিযান চলছে ঘটা করে । বাংলায় নির্মল বাংলার ঢক্কানিনাদ । বিশেষ বিশেষ দিবসে ঝাড়ু হাতে স্বচ্ছ ভারতের শো অফ করতে রাস্তায় , রেলস্টেশনে  নামতে দেখা যায় মন্ত্রী-আমলা থেকে সেলিব্রেটিদের‌ও । ওইটুকুই আমাদের প্রাপ্তি । ন‌ইলে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের ঠ্যালায়  জনজীবনে কতটা স্বচ্ছতাবোধ এসেছে পথেঘাটে  তার অজস্র নমুনা চব্বিশ ঘন্টাই বিদ্যমান । শখে আর ছবি তুলতে ঝাড়ু ধরা নয় , যারা পেটের তাগিদে ভারতকে স্বচ্ছ রাখতে রোজ নালা-নর্দমা- সেপটিক ট্যাঙ্কে নামেন সরকারের স্বচ্ছ ভারত কিম্বা নির্মল বাংলা অভিযান কিন্তু তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ । 

সমাজে অনেক পেশাই আছে যা জীবনের ঝুঁকি  নিয়ে করতে হয় । অনেকের‌ই হয়তো উপযুক্ত পারিশ্রমিকের পাশাপাশি কর্মস্থলে  যথেষ্ট নিরাপত্তাও জোটে । কারণ তাদের ক্ষেত্রে  সমাজের মানুষ এবং সরকারের মধ্যে এইটুকু অন্ততঃ সচেতনতা থাকে যে কাজটা বিপজ্জনক । আমাদের সাফাইকর্মীরা অতটা ভাগ্যবান নন । একে তো ভারতীয় সমাজে যারা অন্ত্যজদের মধ্যেও অন্ত্যজ বংশানুক্রমিকভাবে তাদের ভাগ্যেই জুটেছে নোংরা-ময়লা-পুরীষ  সাফাইয়ের কাজ । এই সেদিন পর্যন্ত তাদের মনুষ্য পদবাচ্য বলেই গণ্য করত না সমাজের ভদ্দরলোকেরা । এখনও কতটুকু করি , মন থেকে আদৌ  তাদের সহনাগরিক বলে  ভাবি কিনা  বিবেকের কাছে এই প্রশ্ন করার সময় এসে গেছে । নালা-নর্দমার পরিস্কার করার কাজটা যে সময় সময় ভারি বিপজ্জনক আমরা ক’জন তা ভাবি ? তাদের সরকারি-বেসরকারি নিয়োগকর্তারা ভাবেন ? ভেবে থাকলে এই প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক যুগেও কেন ভূগর্ভস্থ নর্দমা কিম্বা সেপটিক ট্যাংক পরিস্কার করার সময় বেঘোরে মরতে হয় সাফাইকর্মীদের ? 

বৃহস্পতিবার সকালে কলকাতার কুঁদঘাট এলাকায় ম্যানহোল খুলে নিকাশি নালা সাফ করতে গিয়ে মৃত্যু হল চারজন সাফাইকর্মীর । মৃতদের তিনজন এক‌ই মায়ের সন্তান । বাইশ থেকে আঠাশ বছরের চার-চারটা জোয়ান ছেলে ভূগর্ভস্থ নালায় কাজ করতে নেমে আর জীবিত ফিরল না ।বিষাক্ত মিথেন গ্যাসের ছোবল প্রাণ কেড়ে নিল তাদের ।  নিকাশি নালা ‌ও সেপটিক ট্যাংক পরিস্কার কালে দেশে সাফাইকর্মীদের মৃত্যু কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও স্বশক্তিকরণ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী রামদাস আথাওয়ালে ২০২০ ‘ র ১১ই  ফেব্রুয়ারি সংসদে যে তথ্য পেশ করেছেন তা চমকে ওঠার মতোই । অবশ্য যদি আমরা মনে করে থাকি যে মেথরদের বেঘোরে মৃত্যুতে‌ও চমকে ওঠার মতো কোন কারণ থাকতে পারে । 


সরকারি পরিসংখ্যান বলছে  নালা-নর্দমা-সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিস্কার করতে নেমে দেশে ২০য়ে প্রাণ হারিয়েছেন মোট ১১জন শ্রমিক । ২০তে সংখ্যাটা ছিল ৬৮ । মাত্র একবছরের ব্যবধানে  কর্মস্থলে সাফাইকর্মীদের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হার ৬২ শতাংশ বেড়ে গেছে !  সবথেকে চিন্তার বিষয়,  সাফাইকর্মীদের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা দিনের পর দিন বাড়ছে এবং এই প্রযুক্তিনির্ভর যুগেও কর্মস্থলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাসের মতো কার্যকর  পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার । একটি হিসেবে দেখা গেছে ভারতে গত এক দশকে  কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন  হাজার ৮৫০ জন সাফাইকর্মী । 

ম্যানহোলে কিম্বা সেপটিক ট্যাংকে নেমে সরকারি কিম্বা বেসরকারি সাফাইকর্মীদের মৃত্যুর খবর ২৪ ঘন্টা পরেই সবাই ভুলে যায় । যারা কাজটি করছে  তাদের সামাজিক অবস্থান এখনও এতটাই খারাপ যে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে যাওয়াটা তাদের কাছে বিলাসিতা মাত্র । পুরসভা – কর্পোরেশনের মতো সরকারি এজেন্সি কিম্বা বেসরকারি ঠিকাদারি সংস্থা – যারাই সাফাইকর্মীদের কাজে লাগায় নিজেদের কর্মীদের সুরক্ষা দিতে তাদের আন্তরিক আগ্রহ থাকলে এক বছরে শতাধিক সাফাই কর্মচারীর বেঘোরে মৃত্যু হত না । 

কোনও রকম সুরক্ষা কবচ ছাড়াই শ্রমিকদের ভূগর্ভস্থ নর্দমা কিম্বা সেপটিক ট্যাংকে নামিয়ে দেওয়া হয় ‌ । ভেতরে মিথেন গ্যাস জমে থাকলে মৃত্যুর হাত এড়িয়ে ফেরা মুশকিল । ভাগ্যের হাতে জীবনকে ছেড়ে কাজে নামেন সাফাইকর্মীরা । বরাত খারাপ থাকলে মরে গিয়ে মিডিয়ায় নাম তোলেন তারা । অথচ তাদের সুরক্ষার জন্য আইন অনেক শব্দ ব্যয় করেছে । ২০‘র Prohibition of Employment as Manual Scavengers and their Rehabilitation Act মানলে উপযুক্ত সুরক্ষাবিধি ছাড়া সাফাইকর্মীদের বিপজ্জনক কোন‌ও নিকাশি নালায় কাজের জন্য নামানোটাই বেআইনি । নিজের আইন নিজেই ভাঙছে সরকার । আর বেঘোরে মরে মূল্য চুকিয়ে চলছে ভারতকে স্বচ্ছ রাখার দলিত কারিগরেরা ।


Photo Credit – Frontline , Business  Standard and the free press journal 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *