ভোট কুরুক্ষেত্রের ত্রাতা মধুসূদন নন প্রশান্ত কিশোর || তৃণমূলে জট ছাড়ানোর বদলে জট লাগিয়েছেন পিকে - nagariknewz.com

ভোট কুরুক্ষেত্রের ত্রাতা মধুসূদন নন প্রশান্ত কিশোর || তৃণমূলে জট ছাড়ানোর বদলে জট লাগিয়েছেন পিকে


                                   উত্তম দেব

প্রশান্তকিশোর । শর্টফর্মে পিকে । ৪৩ বছর বয়স্ক বিহার নিবাসী এই ভদ্রলোকের পেশা ‘ রাজনৈতিক কৌশলবিদ  ।’ ইংরেজিতে পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট । তিনি নিজে নির্দিষ্ট কোন‌ও রাজনৈতিক দলের সভ্য  নন। কিছুদিন অবশ্য জনতা দল ইউনাইটেড  করেছেন।  গতবছর বিরক্ত হয়ে  খেদিয়ে দিয়েছেন  নীতিশকুমার। প্রশান্তকিশোরের কাজ হল কোন‌ও রাজনৈতিক দলকে ভোটে জিতিয়ে দেওয়ার ঠিকা বা কন্ট্রাক্ট  নেওয়া । রাজনৈতিক ঠিকাদারি আরকি । এইগুলো আগে ছিল না । রাজনীতি মানেই কৌশল । পার্টির ভেতরে থাকা পাকা মাথার নেতাদের কৌশল‌ই ভোট বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল । 

১৯৯৬-৯৭ সালের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে কর্পোরেটাইজেশনের হাওয়া লাগল । সেফোলজিস্ট ,  পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট এই ধরণের ভারি ভারি টার্ম এবং পেশা বাজারে ভেসে উঠতে শুরু করল  । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জমকালো রাজনীতিতে এইসব পেশা এবং ধরণ ধারণ বহু আগে থেকেই চালু ছিল । ভারতে যখন এসব আমদানি হল পন্ডিতেরা বলতে লাগলেন এ হল রাজনৈতিক পেশাদারিত্ব বা পলিটিক্যাল প্রফেশনালিজম ।

বহুদলীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন ক্ষমতা দখল করার একটা যুদ্ধ ।‌ অন্যান্য যুদ্ধের মতো ভোটযুদ্ধেও  জিততে এবং শত্রুকে  পরাস্ত করতে  উপযুক্ত কৌশল দরকার । ইন্দিরা গান্ধি , জয়প্রকাশ নারায়ণ , জ্যোতি বসু , এনটি রামারাও , রামকৃষ্ণ হেগড়ে , এমজি রামচন্দ্রণ , বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং , বাজপেয়ী – আদবানি জুটি। এঁদের ভোটে জেতার জন্য বাইরে থেকে কৌশলবিদ বা স্ট্র্যাটেজিস্ট ভাড়া করতে হয় নি । এঁদের নাম বললাম । কারণ এঁরা প্রত্যেকেই ভোট নামক ম্যাচ কীভাবে বের করে আনতে হয়  এই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন কোন‌ও না কোনও সময় ।‌

ইন্দিরা-জেপি-রামারাও-হেগড়ে — ভোটযুদ্ধে জিততে কোনও ভাড়াটে সেনাপতি লাগে নি এঁদের


জনজীবনে  ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে রাজনৈতিক প্রচারের চরিত্র‌ও পাল্টে যেতে শুরু করে দু’হাজার সালের পর থেকে । তখন থেকেই বাইরের অ্যাড অ্যান্ড মার্কেটিং এজেন্সি বা পেশাদার বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের সাহায্য নিতে শুরু করে বড় বড় রাজনৈতিক দল গুলো। যদিও এই ট্রেন্ডের শুরু নব্বুইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই । ইন্টারনেট  মানুষের ঘরে ঘরে ঢুকতে শুরু করে ২০০৯-১০ থেকে । আর হাতে হাতে  চলে আসে ১৩-১৪ থেকে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের ঘাড়ে চড়ে । 

কীভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আর‌ও ঝকঝকে  প্রচার চালাতে হয় । কীভাবে ভোটের প্রচারকে ডিজিটালাইজড করা যায় তা নিয়ে রাজনৈতিক দল গুলোর প্রথম দিকে অভিজ্ঞতার অভাব ছিল সত্যি । এই সুযোগের প্রথম সদ্ব্যবহার করেন বিহারের ছেলে প্রশান্ত কিশোর । যে কোনও পণ্যের‌ই কিছু বিপণন কৌশল থাকে । ভোটের বাজারে পলিটিক্যাল পার্টিকেও  একটা ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারজাত করার কৌশল নিয়ে মাঠে নামেন প্রশান্ত কিশোর । ২০১১ তে গুজরাটের ভোটে তাঁর সাহায্য নেন নরেন্দ্র মোদী । নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যাবর্তন হয় । পিকের প্রথম ঠিকাদারি সফল হয় । পিকের দক্ষতার ওপর আস্থা বাড়ে মোদীর‌ও । সাজিয়ে-গুছিয়ে ব্র্যান্ডিং , প্যাকেজিং ব্যাপারটা নরেন্দ্র মোদীর ভীষণ প্রিয় । ২০১৪র লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীই  হলেন বিজেপির মুখ । গুজরাটের ব্র্যান্ড মোদীকে জাতীয় পর্যায়ে বিপণন করার দায়িত্ব পড়ল প্রশান্ত কিশোরের ওপরেই ।‌ যদিও  নরেন্দ্র মোদীর একটা ইমেজ দেশে তৈরি হয়েই ছিল । 

১৪’র ভোটে মোদি তথা বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয়  পিকের বাজার‌ও ফাঁপিয়ে তোলে । ভোটে জিততে শুধু নিজেদের তাকত‌ই যথেষ্ট নয় বাইরে থেকে একজন ভোট কৌশলী বা ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট‌ও  ভাড়া করা দরকার – রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে এই ধারণা দৃঢ় হল । পিকের বাজারদর চড়ল । তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হল ।  নিজের সংস্থা আইপ্যাক  গঠন করে গুছিয়ে ব্যবসায় নামলেন প্রশান্ত কিশোর । কখনও বিহারে নীতিশকুমার তাকে ভাড়া করল । কখনও পাঞ্জাবে কংগ্রেসের ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং । আবার কখনও অন্ধ্রে ওয়াইএস‌আর কংগ্রেসের জগনমোহন রেড্ডি  । এককথায় দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ – পিকের খরিদ্দার জুটে গেল । 

একটা ব্যাপার পরিস্কার ।  যে দলের ভোটে জেতার সম্ভাবনা আছে তারাই সম্ভাবনাটাকে আরও জোরালো করার জন্য প্রশান্ত কিশোরকে হায়ার করে থাকে । কোনও রাজ্যে  ভোটে কারা জেতে ? হয় শাসকদল নয় প্রধান বিরোধীদল । শাসক বা প্রধান বিরোধী যেকোনও একজনের  কন্ট্রাক্ট  নেন পিকে । যেকোনও দলকে ভোটে জিততে চাইলে চাই জনসমর্থন । এই জনসমর্থন দু’ধরণের। নেতিবাচক ও ইতিবাচক । ক্ষমতায় ফিরতে হলে সরকারি দলের জন্য চাই ইতিবাচক জনসমর্থন । আর সরকারি দলের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে হলে বিরোধী দলের চাই নেতিবাচক সমর্থন। যেটাকে রাজনীতির ভাষায় বলা অ্যান্টি ইনকাম্বেসি ফ্যাক্টর বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হেতু । জনগণ কখন‌ও সরকারের কাজে বিরক্ত হয়ে বিরোধী দলকে ভোট দিয়ে জেতায়। কখনও সরকারের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে শাসক দলকেই ক্ষমতায় ফেরায় । এখন ধুরন্ধর পিকে কখনও সরকারি দলের টাকা খায় । কখনও বিরোধী দলের । উদ্দেশ্য একটাই কাস্টমারকে জিতিয়ে দেওয়া । কিন্তু ‌পিকের হাতে এমন কোনও যাদু চিরাগ নাই যার দৌলতে যেই দলের জেতার কোনও সম্ভাবনাই নাই তাকে জিতিয়ে আনবে । ভোটে বাজিমাত করতে গেলে তো শুধু জনসমর্থন‌ই যথেষ্ট নয় দরকার মজবুত সংগঠন । আবার শুধু সংগঠন দিয়েও ভোটে লড়া যায় না দরকার প্রচুর টাকা। কোটি কোটি টাকা খরচা না করে নির্বাচনে বিজয়লক্ষ্মীর মুখ দেখার দিন বহু আগেই গত হয়েছে । 

পিকের ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট , মেকানিজম,  প্রচার কৌশল কখনও সফল হয়েছে কখনও হয় নি । ২০১৫ সালে প্রশান্ত কিশোরের বুদ্ধি ছাড়াই দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে সত্তরে সাতষট্টি স্কোর করেছিলেন কেজরিওয়াল ।  আবার ২০২০ তে পিকের আইপ্যাককে ভাড়া করে সত্তরে বাষট্টি তোলেন কেজরি । অর্থাৎ পিকে প্লাস কি মাইনাস বড় কথা নয় ভোটে জেতা-হারার অনেক গুলো প্যারামিটার থাকে । সেসব  ঠিকঠাক ক্লিক করে গেলে  পিকে থাকুক আর নাই থাকুক জেতা সম্ভব । ২০১৭তে  প্রশান্ত কিশোরের শরণ নিয়েও ইউপির ভোটে শোচনীয় বিপর্যস্ত হয়েছিল রাহুল গান্ধির কংগ্রেস । কারণ যে প্রতিযোগিতায় আনফিট , অযোগ্য তাকে জেতানোর মুরোদ পিকে কেন পিকের পিতৃদেবের‌ও নেই । 

২০০৯ এর লোকসভা । ২০১১র বিধানসভা । ২০১৪’র লোকসভা এমনকি ২০১৬’র বিধানসভা । পরপর চারটি নির্বাচন জিততে  পাটনা থেকে বহিরাগত ‘ চুনাও কৌশলী ‘  হায়ার করে আনতে হয় নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে । উনিশের লোকসভায় ধাক্কা খাওয়ার তিন-চার মাসের মধ্যেই তৃণমূল সুপ্রিমোর  কনফিডেন্স লেভেলের গুরুতর পতন এবং  তাঁর ধারণা জন্মালো পিকের মতোন একজন ভোট বিশেষজ্ঞকে ভাড়া না করলে একুশে নীলবাড়ি  হাতছাড়া অবধারিত । 

তৃণমূলের ঠিকা নেওয়ার পর প্রশান্ত কিশোর তৃণমূল এবং তৃণমূলের সুপ্রিমোর  মধ্যে যেসব ঘষামাজা , সংস্কার , পরিবর্তন আনলেন তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও পারতেন । কিন্তু পিকে তৃণমূলের ক্ষতি যেটা করলেন তার কাছে এইসব ঘষামাজা , শুদ্ধিকরণ , সংস্কার সব জলে যাওয়ার পথে । তৃণমূল দলটা কীভাবে তৈরি , তৃণমূল দলটা কীভাবে চলে এই নিয়ে পিকের হোম ওয়ার্কে যথেষ্ট ভুল আছে ।  অভিষেকের সৌজন্যে দলের অন্দরে আইপ্যাকের একটি ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠার গল্প তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাই ভালভাবে নেন নি । এর ফলে তৃণমূলের ভেতরে পারস্পরিক সন্দেহ , অবিশ্বাস আরও  গভীর হয়েছে  । তৃণমূলের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং নেতাদের ম্যানেজ করার কৌশল বিহারি প্রশান্তকিশোরের জানা নেই । জানার কথাও নয় । পিকে আর যাই হোন মুকুল রায় নন। 

প্রশান্তকিশোর – তৃণমূলে জট ছাড়াচ্ছেন না জট বাড়াচ্ছেন ?

বাংলার রাজনীতির ধরণ-ধারণ খুব জটিল । একেবারে বুথ স্তর থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দলের ভেতরের প্রতিটি স্তর সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা  তদুপরি সংগঠনের শীর্ষ থেকে নিম্ন পর্যন্ত শতাধিক গোষ্ঠীর ওপর পর্যাপ্ত  নিয়ন্ত্রণ না থাকলে তৃণমূলের মতো ব্যক্তি সর্বস্ব দলের গোষ্ঠী কোন্দল চাপা দেওয়া কার‌ও পক্ষে সম্ভব নয় ।পিকের কল্যাণে  তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল যে বেড়েছে ব‌ই কমে নি চলমান ঘটনাবলী‌ই তার প্রমাণ । বরং ভোটের আগে  কখন তা চরমে ওঠে সেইদিকে‌ই সবার এখন দৃষ্টি । বাকি র‌ইল পিকের প্রচার কৌশল । ওটা এমন কোনও  ব্রহ্মাস্ত্র  নয় যে সেটাকে ভোঁতা করার মতো অস্ত্র প্রতিপক্ষ শিবিরের নেই ।‌ পরিস্থিতি দেখে মনে হয়  তৃণমূল সুপ্রিমো এখন পিকেকে না পারছেন গিলতে না ওগরাতে । 


ছবি- নাগরিক আর্কাইভস


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *