উত্তরবঙ্গের হিমালয় সংলগ্ন জেলাগুলিতে রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনা রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম। কিন্তু বিষয়টা নেতাদের ভাল লাগছে না। সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন শান্তিতে থাকলে তাঁদের হয়তো গাত্রদাহ হয়। নইলে কোচবিহারে যেচে অশান্তি ডেকে আনার কারণ কী? দিনহাটার তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী। কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, সাথে আরও একটা দফতরও সামলান। উদয়নের মতোই নিশীথও দিনহাটারই ছেলে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অশান্তির কারণে দিনহাটা বারংবার ‘হেডলাইন’ হয়েছে। যে এলাকার দু’জন জনপ্রতিনিধি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সেই এলাকায় এত অশান্তি হয় কীভাবে?
নিশীথের মুখ দিয়ে আকথা-কুকথা সচরাচর শোনা যায় না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র এবং ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি আগের তুলনায় আরও বেশি সংযত। উদয়ন গুহ মেপে কথা বলেন, উদয়নের অতি বড় শত্রুও তাঁকে এই অপবাদ দিতে পারবে না। কিন্তু মন্ত্রীত্ব লাভের পরে উদয় গুহ স্বীয় জিহ্বাকে খানিক নিয়ন্ত্রণে আনবেন, এই আশা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের সেই গুড়ে বালি পড়েছে। নিজের দলের প্রতিপক্ষ শিবির হোক আর বিরোধীপক্ষ এমনকি সীমান্ত রক্ষী বাহিনী- সমালোচনা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দিনহাটার বিধায়ক কতবার শিষ্টাচারের শ্রাদ্ধ করেছেন, সেই হিসেব মিডিয়ার ফাইলে আছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের মেরে হাত-পা ভেঙে দেওয়া, বাড়িঘর তুলে দেওয়া এমনকি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এলাকায় ঢুকলে তাঁর গোঁফদাড়ি উপড়ে ফেলার হুমকি দিতেও মুখে বাধে না উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর।
দিন কয়েক আগেই উদয় গুহ হুমকি দিয়েছেন, সিতাই ও দিনহাটা ব্লকের কোথাও বিজেপি কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে পারবে না। যদি এই দুই ব্লকের কোনও বুথ থেকে বিজেপির কর্মসূচি পালনের কোনও খবর উদয়নের কানে আসে, তাহলে তৃণমূলের বুথ সভাপতিকেই সরিয়ে দেবেন তিনি। রাজ্যের একজন মন্ত্রী, একটি গণতান্ত্রিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কীভাবে এমন হুমকি দিতে পারেন? উদয়ন গুহের পরের কর্মসূচিটি আরও মারাত্মক বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বিএসএফ-এর গুলিতে স্থানীয় এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় নিশীথ প্রামাণিকের বাড়ি ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছিলেন উদয়ন গুহ। রাজ্যের এক মন্ত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়ি ঘিরে ফেলার ডাক দিচ্ছেন! এমন আজব ঘটনা আগে কেউ কখনও শুনেছেন? রাজ্যের একজন মন্ত্রী কীভাবে পায়ে পা দিয়ে নৈরাজ্য ডেকে আনতে পারেন? তাও নিজের এলাকায়!
শনিবার উদয়ন গুহের ডাকা কর্মসূচির জেরেই কোচবিহারের দিনহাটার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। দিনহাটার সাহেবগঞ্জ থানার বুড়িরহাটে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের কনভয়ে হামলার ঘটনা ঘটল। অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। হামলায় লাঠি, বাঁশ,তির, দা, বোমা এমনকি বন্দুক-পিস্তল পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর গাড়ির সামনের কাঁচ ভেঙেছে। নিশীথ প্রামাণিককে অক্ষত অবস্থায় রক্ষা করেছেন দেহরক্ষীরা, যাঁরা কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ান। রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের পুলিশ কী করল? তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছিলেন উদয়ন গুহ। পুলিশ তো জানত, নিশীথ প্রামাণিক এলাকায় ঢুকলেই তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা বাধা দিতে পারে। তাহলে আগে থেকেই কেন সতর্ক হল না পুলিশ? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কনভয় থেকে বিক্ষোভকারীদের নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পুলিশ ব্যর্থ হল কেন? নিশীথ প্রামাণিক চোট পেলে প্রশাসনের সম্মান কি খুব সম্মান বাড়ত?
যে জনপ্রতিনিধিরা প্ররোচনা দিয়ে জনপদের শান্তি বিঘ্নিত করেন, তাঁদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। মারব, ধরব, মেরে হাত পা ভেঙে দেবো, দাড়িগোঁফ উপড়ে নেবো, লাশ ফেলে দেবো, বউকে সাদা থান পড়াব, বাড়ি ঘেরাও করব- এইসব সংসদীয় রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। এইসব ভাষা আমদানি করে যাঁরা রাজনীতিকে কলুষিত করছেন তাঁরা আদতে গণতন্ত্রের জন্য আবর্জনা। আবর্জনার অন্তিম ঠাঁই ভাগাড়ে সভ্য সমাজে নয়। দুয়ারে পঞ্চায়েত নির্বাচন। মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে আমরা বেশি কিছু চাই না। বিনীত প্রার্থনা একটাই- প্রকাশ্যে অথবা আড়ালে প্ররোচনা দেওয়া বন্ধ রেখে মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিন।
Feature Image source- collected.