হানিমুনে গিয়ে স্ত্রীর ষড়যন্ত্রে খুন স্বামী! ‌একটি চাপাতির সূত্র ধরে কীভাবে রহস্যের জট ছাড়াল মেঘালয় পুলিশ?

হানিমুনে গিয়ে স্ত্রীর ষড়যন্ত্রে খুন স্বামী! ‌একটি চাপাতির সূত্র ধরে কীভাবে রহস্যের জট ছাড়াল মেঘালয় পুলিশ?


বিশেষ প্রতিবেদন: প্রবৃত্তির তাড়নায় অপরাধে লিপ্ত হয় মানুষ। এবং পুরুষের তুলনায় নারী কম হিংস্র ও অপরাধমনস্ক- মনোবিজ্ঞান বা অপরাধবিজ্ঞান তা কখনও দাবি করে না। যদিও অপরাধের বিচারে ভারতীয় আইনব্যবস্থা এখনও লিঙ্গ নিরপেক্ষ হতে পারে নি বলে পুরুষদের তরফে ইদানিং এমন অভিযোগ জোড়ালো হয়ে উঠেছে। প্রেমিকের সঙ্গে যোগসাজশ করে স্বামীকে হত্যার একাধিক ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে ঘটেছে। এখন দেশের মিডিয়া জগত ও সামাজিক মাধ্যম তোলপাড় রাজা রঘুবংশীর রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘিরে। যতই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্যের পর্দা ফাঁস হচ্ছে, তত‌ই চমকে উঠছেন ঘটনার তদন্তে নিয়োজিত আধিকারিকেরা।

মেঘালয়ে হানিমুনে গিয়ে খুন হয়েছেন ইন্দোরের ৩০ বছরের যুবক রাজা রঘুবংশী। গত ২ জুন রাজ্যটির ওয়েই সাওডং জলপ্রপাতের কাছে সোহরা এলাকার একটি খাদ থেকে রাজা রঘুবংশীর পচাগলা দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্ত থেকে জানা যাচ্ছে, ২৩ মে রাজাকে খুন করা হয়। রাজা যে তাঁর নববিবাহিত স্ত্রীর ষড়যন্ত্রের বলি, এটা বের করতে রীতিমতো ঘাম ছুটে গেছে পুলিশের গোয়েন্দাদের। 

রঘুবংশী দম্পতি নিখোঁজ হওয়ার ১০ দিন‌ পর গত ২ জুন ওয়েই সাওডং জলপ্রপাত সংলগ্ন সোহরা এলাকার একটি খাদের ভেতর থেকে রাজা রঘুবংশীর পচাগলা দেহ উদ্ধার করে মেঘালয় পুলিশ। ২২ মে নংরিয়াত গ্রামের যে হোমস্টেতে রাজা-সোনম উঠেছিলেন, সেখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রাজার দেহ উদ্ধার হয়। টানা ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দৃশ্যমানতা কম থাকায় উদ্ধারকাজ বারে বারে ব্যাহত হয়। শেষে বৃষ্টি একটু কমলে ড্রোনের সাহায্য নিয়ে রাজা রঘুবংশীর মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। রাজার দেহ উদ্ধার হলেও তাঁর স্ত্রী সোনম লাপাতাই থাকে। সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যেই মেঘালয়ের নামে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেলেও ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ বুঝতে পারে, ঘটনার পেছনে অন্য রহস্য আছে।

স্বামী রাজা রঘুবংশীকে খুন করার কাজ শেষ হ‌ওয়ার পর একাই শিলং থেকে গুয়াহাটি চলে যায় সোনম। গুয়াহাটি থেকে উত্তরপ্রদেশের গাজিপুরে। রবিবার (৮ জুন, ২০২৫) গভীর রাতে গাজিপুরের নন্দগঞ্জের একটি ধাবা থেকে সোনমকে গ্রেফতার করে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। হেফাজতে নিয়ে সোনম রঘুবংশীকে ডলা দিতেই সত্য সামনে আসে। প্রেমিক বছর কুড়ির রাজ সিংহ কুশ‌ওয়াহার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেই স্বামীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে সোনম। রাজা রঘুবংশীকে খুন করতে তিনজন ভাড়াটে খুনির সাহায্য নেয় রাজ। রাজাকে খুন করার পর ইন্দোরে ফিরে যায় রাজ সিংহ কুশ‌ওয়াহার। সোমবার ইন্দোর থেকেই তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোনমের বাবা দেবী সিংহের একটি সানমাইকার কারখানা আছে। কারখানার গোডাউনের কর্মচারী রাজের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে জেরায় স্বীকার করেছে সোনম।

বিয়ের পোশাকে নিহত রাজা রঘুবংশী ও তাঁর স্ত্রী সোনম রঘুবংশী। মেঘালয়ে হানিমুনে গিয়ে উধাও হয়ে যায় সদ্যবিবাহিত দম্পতি। বরকে খুনের অভিযোগে নন্দগঞ্জ থেকে সোনমকে গ্রেফতার করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। সংগৃহীত ফটো

বিয়ের চারদিন পর আচার পালনে বাপের বাড়িতে ফিরেই সোনম প্রেমিকের সঙ্গে মিলে সদ্য বিয়ে করা স্বামীকে খুন করার পরিকল্পনা করে বলে জানা গেছে। গত ১৮ মে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলে দু’জনে মিলে। মেঘালয়ে হানিমুন করার ব্যাপারে স্বামী রাজা রঘুবংশীকে রাজি করায় সোনম‌ই। এমনটাই জানিয়েছেন ইন্দোরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রাজেশ দান্ডোতিয়া। রাজাকে খুনের জন্য আকাশ রাজপুত (২১), বিশাল সিং চৌহান (২২) ও আনন্দ কুর্মীকে (২৩) ভাড়া করে রাজ সিংহ কুশ‌ওয়াহার। 

রাজা রঘুবংশীর খুনের কিনারা করতে হিমসিম খাচ্ছিল ঘটনার তদন্তে গঠিত মেঘালয় পুলিশের ‘সিট’। রাজাকে খুন করে প্রায় পার পেয়েই গিয়েছিল তাঁর সদ্যবিবাহিত স্ত্রী সোনম ও তার প্রেমিক রাজ। কিন্তু একটি চাপাতি তদন্তকারীদের সত্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। যেখান থেকে রাজা রঘুবংশীর দেহ উদ্ধার হয়েছিল, গত ৪ জুন তার আশেপাশে তল্লাশি চালিয়ে একটি লেডিজ শার্ট, ওষুধের স্ট্রিপ, মোবাইল হ্যান্ডসেটের নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি স্ক্রিন ও স্মাট ওয়াচ সহ অনেক জিনিস খুঁজে পায় পুলিশ।

খুঁজে পাওয়া জিনিসের মধ্যে একটি চাপাতিও ছিল। যা রাজা রঘুবংশীকে হত্যায় ব্যবহার করা হয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা। এই ধরণের চাপাতি স্থানীয় দুর্বৃত্তরা ব্যবহার করে না।  তদন্তকারীদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আততায়ীরা বাইরে থেকে এসেছিল। সোনমের প্রেমিক যে তিনজন ভাড়াটে খুনিকে এনেছিল, তাদের কেউ ভুল করে ঘটনাস্থলে চাপাতিটি ফেলে গেছে বলে পুলিশের সন্দেহ। তখন‌ই রঘুবংশী দম্পতির ‘কল রেকর্ড’ ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন তদন্তকারীরা। 

বামে নিহত রাজা রঘুবংশী। মধ্যে ও ডানে গ্রেফতারের পর সোনম ও তার প্রেমিক রাজ সিংহ কুশ‌ওয়াহা। ছবি: এন‌এনডিসি

রাজা রঘুবংশী খুন হ‌ওয়ার আগের দিন‌ও সোনম ভাড়াটে খুনিদের একজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। কল রেকর্ড ঘেঁটেই নিখোঁজ হওয়ার আগ মুহূর্তে সোনম কোথায় অবস্থান করছিল, তা জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। তিন ভাড়াটে খুনি আকাশ, বিশাল ও আনন্দকে সোমবার (৯ জুন, ২০২৫) মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর ও সান্তনা এবং উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রবৃত্তির বশে নারীও যে কত ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, নিরীহ স্বামীকে খুন করে তা আরও একবার প্রমাণ করল সোনম সিং।

Feature graphic is representational and created by the NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *