মোসাদের একের পর এক চালে বিপর্যস্ত হিজবুল্লাহ, নাসরুল্লাহ মরতেই ভয়ে লুকোলেন 'মেন্টর' খামেনি!

মোসাদের একের পর এক চালে বিপর্যস্ত হিজবুল্লাহ, নাসরুল্লাহ মরতেই ভয়ে লুকোলেন ‘মেন্টর’ খামেনি!


পক্ষান্তরে ইজরায়েলের মারে ইরান জর্জরিত বললে ভুল হবে না। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একটা ছায়াযুদ্ধ বা ‘প্রক্সি ওয়ার’ ইরান দীর্ঘদিন ধরেই চালিয়ে আসছে। সেই যুদ্ধ ইরান চালাচ্ছে গাজা উপত্যকায় হামাস আর দক্ষিণ লেবাননে শিয়াপন্থী মিলিশিয়া হিজবুল্লাহর মাধ্যমে। ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইজরায়েলের অভ্যন্তরে হামাসের দুঃসাহসিক ও বিধ্বংসী অভিযানের পর থেকে কার্যত একদিনের জন্য‌ও থেমে নেই বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। গাজা উপত্যকা এখন ধ্বংসস্তূপ। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে গোটা এলাকা। হামাসের সামরিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করার পাশাপাশি ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব শূন্য করার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। গত ৩০ জুলাই রাতে তেহরানে নিজের সুরক্ষিত বাসভবনে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া।

ইরানকে ঘরে ঢুকে মারছে ইজরায়েল!

ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তেহরানে গিয়ে প্রাণ হারান হানিয়া। হানিয়ার শয়নকক্ষে দূর নিয়ন্ত্রিত বোমাটি রাখা ছিল এবং হানিয়াকে এইভাবে হত্যার পরিকল্পনা বহু আগে থেকেই মোসাদ করেছিল বলে জানা গেছে। রাজধানী তেহরানের উত্তরে যে এলাকায় ইসমাইল হানিয়া থাকতেন, তা নিরাপত্তার দিক দিয়ে অত্যন্ত সুরক্ষিত। সেখানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য অনেকগুলি আবাসন বানিয়েছে ইরান সরকার। এ’রকম একটি ‘হাই সিকিউরিটি’ আবাসনেই হামাস প্রধানের জন্য ফ্ল্যাট বরাদ্দ করেছিল ইরান। হানিয়ার হত্যা প্রমাণ করে ইরানের অভ্যন্তরে মোসাদের জাল কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত! ইরানের মোসাদাতঙ্ক এতটাই প্রবল যে গত মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পরেও গুঞ্জন উঠেছিল- মোসাদ মেরে দিল না তো!

তেহরানে নিজের শোয়ার ঘরে বিস্ফোরণে নিহত হন হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া। চাইলে ইরানে ঢুকেও যে শত্রু নিধন করতে পারে মোসাদ, হানিয়ার মৃত্যু তার‌ প্রমাণ। ছবি- এন‌এনডিসি

সুযোগ পেলেই ইরানের সামরিক নেতৃত্বকে খতম করা ইজরায়েলের ঘোষিত মিশন। এবং যতবার ইরানের কোন‌ও শীর্ষস্থানীয় মিলিটারি কমান্ডার ইজরায়েলের হাতে মারা যায়, ততবার জায়নিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে কঠিন বদলা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয় তেহরানের থিয়োক্রেটিক রেজিম। যদিও শেষ পর্যন্ত তা বাগাড়ম্বরেই সীমাবদ্ধ থাকে। ২০২০-এর ৩ জানুয়ারি ইরাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে ইজরায়েল। সোলাইমানি ছিলেন ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডের সবথেকে এলিট উইং ‘কুদস’ ফোর্সের প্রধান। এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলের হাতে ইরানের যে ক’জন সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সোলাইমানির স্থান সবার উপরে।

জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যুর পর লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব বর্তেছিল সোলাইমানির ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেনারেল সাইদ রাজি মৌসাভির উপরে। ২০২৩-এর ২৫ ডিসেম্বর দামাস্কাসের জেইনাবিয়া এলাকায় বিমান হামলা চালিয়ে মৌসাভিকেও মেরে ফেলে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। এরপর চব্বিশের পয়লা এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে খোদ ইরানের দূতাবাসে মিসাইল মারার নির্দেশ দিতে দ্বিধা করেন নি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সেই হামলায় নিহত হন রেভোলিউশনারি গার্ড কপর্সের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার মহম্মদ রেজা জাহেদি ও এক কূটনীতিক সহ মোট নয়জন। জেনারেল কাসেম সোলাইমানির পর জেনারেল জাহিদিই হলেন ইজরায়েলের হাতে নিকেশ হ‌ওয়া ইরানের সর্বোচ্চ সামরিক আধিকারিক। এই হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতেই ১৩ এপ্রিল রাতে ইজরায়েলের ভূখণ্ড তাক করে দুশোটি দুরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন পাঠিয়েছিল তেহরান। যে হামলার খবর আগেই জানতে পেরে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের সরাসরি সামরিক অভিযান বলতে এইটুকুই।

হিজবুল্লাহর ঘরে মোসাদের বাসা!

গাজায় হামাসকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করার পর এখন ইজরায়েল নজর লেবাননে হিজবুল্লাহর উপর। শিয়াপন্থী এই মিলিশিয়া বাহিনী হামাসের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং তাদের লেবাননের নিয়ন্ত্রকশক্তি বললে অতিশয়োক্তি হবে না। ইজরায়েলের হিজবুল্লাহ বিরোধী চলতি অভিযানের সবথেকে বড় ঘটনাটি ঘটে গেছে শুক্রবার রাতে। বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর প্রধান ৬৪ বছরের হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন। গত ৩০ বছর ধরে গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন নাসরুল্লাহ। নাসরুল্লাহর মৃত্যু ইরানের জন্য একটা বিরাট আঘাত। ভয়ে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে গোপন স্থানে সরিয়ে ফেলেছে ইরান সরকার। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনিই ইরানের প্রকৃত রাষ্ট্রপ্রধান। তেহরানের ‘থিয়োক্রেটিক রেজিম’-এর ভয়, যে কোনও মুহূর্তে খামেনিকে খতম করে দিতে পারে ইজরায়েল।

ইজরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত। সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশকেই মেরে ফেলেছে ইজরায়েল। সংগৃহীত ফটো

হিজবুল্লাহকে ইরানের সামরিক বাহিনীর একটি শাখা হিসেবেই দেখে ইজরায়েল সরকার। ২০০৬-এর পর হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে এত বড় সামরিক অভিযানে নামে নি আইডিএফ। সে’বার দক্ষিণ লেবাননে স্থল অভিযান চালিয়েছিল ইজরায়েলের সামরিক বাহিনী।‌ এ’বার এখনও পর্যন্ত স্থল অভিযানের ব্যাপারে বিশেষ কোনও উচ্চবাচ্য করে নি তেলআভিভ। তবে এ’বারে ইজরায়েলের রণকৌশল দেখে তাজ্জব সবাই। ইতিমধ্যেই হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর নেতৃত্বদানকারী কাউন্সিলের অর্ধেক সদস্যকে সাফ করে দিয়েছে ইজরায়েল। তাদের মজুত অস্ত্রভাণ্ডারের বড় অংশ বোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হিজবুল্লাহর সর্বোচ্চ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করতেন। তাঁর গতিবিধি গোপন থাকত। তিনি প্রকাশ্যে আসতেন না। টেলিভিশনে বক্তৃতা দিয়ে অনুগামীদের উদ্বুদ্ধ করতেন। নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর ধারণা করা হচ্ছে, যে নিরাপত্তা বেষ্টনী হিজবুল্লাহ প্রধানকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সবসময় রক্ষা করত, তা ভাঙতে সক্ষম হয়েছে মোসাদ। নাসরুল্লাহর দেহরক্ষীদের ভেতরেই মোসাদের চর লুকিয়ে ছিল বলে সন্দেহ করছে হিজবুল্লাহ ও ইরান।

মোসাদ যে হিজবুল্লাহর অনেক গভীরে ঢুকে গেছে, তার প্রথম প্রমাণ পাওয়া গেছে পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে। ইজরায়েলের গোয়েন্দারা লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলবে, এই ভয়ে মোবাইল ত্যাগ করেছে হিজবুল্লাহর মিলিশিয়ারা। এর আগে মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে কয়েকজন হিজবুল্লাহ কমান্ডারকে হত্যাও করেছে ইজরায়েলের বাহিনী। কিন্তু হিজবুল্লাহ সদস্যদের হাতে থাকা কয়েক হাজার পেজার ও রেডিও হ্যান্ডসেটকে মোসাদ কীভাবে নিয়ন্ত্রণে নিল, তা ভেবে পাচ্ছেন না দুনিয়ার সব দুঁদে গোয়েন্দারাও। লেবাননে পেজার সহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বিস্ফোরণে ৩২ জন নিহত ও দেড় হাজারের বেশি হিজবুল্লাহ গেরিলা আহত হয়েছে। ইজরায়েলের বহুমুখী আক্রমণে হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন ও ‘কমান্ড সিস্টেম’ বড় রকমের ক্ষতিগ্রস্ত। ২০২৪-এ এখন পর্যন্ত ইজরায়েলের হামলায় সর্বোচ্চ নেতা নাসরুল্লাহ সহ হিজবুল্লাহর সবথেকে শীর্ষ ও অভিজ্ঞ নয় নেতার মধ্যে আটজন‌‌ই নিহত।

বাঙ্কার বাস্টার দিয়ে নাসারুল্লাহকে মারল ইজরায়েল

কীভাবে নিহত হলেন অত্যন্ত গোপনে হিজবুল্লাহর সুরক্ষা বলয়ের ভেতরে থাকা হাসান নাসরুল্লাহ? ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, দক্ষিণ বেইরুটের একটি আবাসিক এলাকায় একটি ভবনের নিচে গোপন বাঙ্কারে হিজবুল্লাহ প্রধান যখন বৈঠকে ব্যস্ত তখন বিমান থেকে বোমা মেরে বাঙ্কারটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬০ ফুট নিচে বাঙ্কারটি অবস্হিত। বাঙ্কারটি ধ্বংস করতে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ জাতীয় ভয়ঙ্কর শক্তিশালী বোমাই ব্যবহার করেছে ইজরায়েলের বিমান বাহিনী। বাঙ্কার সহ নাসরুল্লাহকে উপড়ে ফেলতে কম করে ৮০ টন বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে। বৈঠকে হাজির হিজবুল্লাহর বাকি কমান্ডাররাও খতম বলে দাবি করেছে আইডিএফ প্রধান জেনারেল হারজি হালেভি। বৈঠকে হিজবুল্লাহ প্রধান দলবল নিয়ে ইজরায়েলের উপর হামলার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন জেনারেল হালেভি।

২০০০ পাউন্ডের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা মেরে নাসরুল্লাহর বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়েছে ইজরায়েল। ছবি এক্স হ্যান্ডেল থেকে সংগৃহীত

ইজরায়েলের বিমান হামলার মুহূর্তে হাসান নাসরুল্লাহ যেখানে অবস্থান করছিলেন, সেটা ছিল হিজবুল্লাহ বাহিনীর গোপন আস্তানা, ভবন ও বাঙ্কারটিকে অতি গোপনীয়তার সঙ্গে সদর দফতর হিসেবেই ব্যবহার করতেন নাসরুল্লাহ। গোপন বাঙ্কারে ইজরায়েলের বোমায় নাসরুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনাকে হিজবুল্লাহর জন্য বিরাট আঘাত ও সামরিক সংগঠনটির গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের শোচনীয় ব্যর্থতা বলেই মনে করছেন সুইডিশ ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির প্রবীণ হিজবুল্লাহ বিশেষজ্ঞ ম্যাগনাস র‍‍্যানস্টর্প। হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াকে পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রহীন সামরিক বাহিনী বলে মনে করা হয়। হিজবুল্লাহর নেটওয়ার্কের ভেতরে ঢুকতে মোসাদ গত বিশ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে বলে রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। লেবাননে ইজরায়েলের হিজবুল্লাহ বিরোধী অভিযানে একের পর এক চমকপ্রদ সাফল্য দেখে সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মোসাদ তাদের মিশনে অনেকটাই সফল হয়েছে।

বাঙ্কার বাস্টার বোমায় নাসরুল্লাহ নিহত হতেই ভয়ে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনিকে গোপন আস্তানায় সরিয়ে নিয়েছে ইরান। ছবি- সংগৃহীত

প্রক্সি বাহিনী হিজবুল্লাহর বিপর্যয়ে ইরান সন্ত্রস্ত ও ক্ষুব্ধ। হাসান নাসরুল্লাহর নিধনে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরান সরকার। প্রাণের ভয়ে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি অজ্ঞাত স্থানে। এ’বার‌ও ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুঙ্কার ছেড়েছেন খামেনি। যদিও ইরানের এমন হুঙ্কারকে ফাঁকা আওয়াজ ভাবতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মহল।

Feature graphic is representational and created by NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *