স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বিকল থাকায় ধীরে চলছিল ট্রেন, তারপরেও কীভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘায় মালগাড়ির ধাক্কা?

স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বিকল থাকায় ধীরে চলছিল ট্রেন, তারপরেও কীভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘায় মালগাড়ির ধাক্কা?


শিলিগুড়ি: রেলের যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলে দিল সোমবারের ট্রেন দুর্ঘটনা। সোমবার সকালে নিউ জলপাইগুড়ির কাছে নীচবাড়ি ও রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা শিয়ালদহগামী ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে মালগাড়ি। সংঘর্ষের জেরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পেছনের দুটি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে পাশে ছিটকে পড়ে। মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপরে উঠে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার শেষ কামরাটি। ট্রেনটির শেষের দিকের চারটি কামরা ক্ষতিগ্রস্ত। মালগাড়ির চালক সহ কমপক্ষে নয়জন যাত্রী নিহত। আহত তিরিশের বেশি।

মালগাড়ির ধাক্কায় শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘার শেষের দিকের চারটি বগি বিধ্বস্ত। দুর্ঘটনার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়।

কয়েকদিন ধরেই উত্তরবঙ্গে টানা বৃষ্টি চলছে। ঘটনার সময়‌ও মুষলধারে বৃষ্টি চলছিল। বৃষ্টির কারণে স্বাভাবিকভাবেই দৃশ্যমানতা কম ছিল। এটা দুর্ঘটনার একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু সিগন্যাল না পেয়ে রাঙাপানি ও নীচবাড়ি স্টেশনের মাঝে ডাউন লাইনে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস যখন দাঁড়িয়ে ছিল তখন সেখান মালগাড়ি পৌঁছে গেল কীভাবে? এনজেপি স্টেশন থেকে রাঙাপানি স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। এনজেপি থেকে ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাঙাপানি পৌঁছে যায় যে কোনও ট্রেন। সদাব্যস্ত এনজেপি স্টেশনে ঢোকার মুখে আপ লাইনের অনেক ট্রেন‌ই সিগন্যাল না পেয়ে রাঙাপানিতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সোমবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিট নাগাদ ডাউন লাইনে শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস কেন নীচবাড়ি ও রাঙাপানির মাঝে সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তা স্পষ্ট নয়।

একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, রানিপাত্র থেকে ছত্তরহাট পর্যন্ত ‘অটোমেটিক সিগন্যালিং’ ব্যবস্থা ভোর থেকেই খারাপ ছিল। ওইটুকু পথ স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে ‘ম্যানুয়াল মেমো’ নিয়ে ট্রেন চালাচ্ছিলেন চালকেরা। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রানিপাত্র থেকে ছত্তরহাট পর্যন্ত লাইনে সিগন্যাল ‘রেড’ হয়েছিল । চালকদের ‘রেড সিগন্যাল’ উপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, ম্যানুয়াল মেমো পাওয়ার পরেও কেন দাঁড়িয়ে পড়লেন কাঞ্চনজঙ্ঘার চালক। রেলের কোন‌ও কোন‌ও মহল দাবি করছে, দাঁড়িয়ে নয়, ধীরে চলছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিন্তু সেই সময় এক‌ই লাইনে ‘গুডস ট্রেন’ চলে এল কীভাবে? কাঞ্চনজঙ্ঘা ও মালগাড়ির মধ্যে ১৫ মিনিটের ব্যবধান ছিল বলে জানা গেছে। ‘ম্যানুয়াল মেমো’ দিয়ে ট্রেন চালানো হলে ট্রেনের গতিবেগ ১০ কিলোমিটারের বেশি না তোলার নির্দেশ দেওয়া থাকে চালকদের। তারপরেও কেন মালগাড়ি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল?

কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ও মালগাড়ি- দুটোই অল্প সময়ের ব্যবধানে এক‌ই অভিমুখে এনজেপি থেকে ছেড়ে এসেছে। ডাউন লাইনে সিগন্যালিং ব্যবস্থা খারাপ আছে জেনেও‌ কেন এনজেপি স্টেশন থেকে তড়িঘড়ি মালগাড়িকে র‌ওনা করতে বলা হল? গুরুত্বপূর্ণ ওই লাইনে ট্রেনের গতি সবসময়‌ই নিয়ন্ত্রিত থাকে। নজরদারি‌ও থাকে যথেষ্ট। তারপরেও দুর্ঘটনা কেন ঘটল? যখন কোনও লাইনে এক্সপ্রেস ট্রেন চলে, তখন সেই লাইনে পণ্যবাহী ট্রেন চালানো হয় না। মালগাড়িকে দাঁড় করিয়ে এক্সপ্রেস ট্রেনকে পাস করানোই নিয়ম। এনজেপি স্টেশন থেকে এক‌ই অভিমুখে র‌ওনা দিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা ও মালগাড়ি। এক‌ই লাইন দিয়ে মালগাড়িটি কাঞ্চনজঙ্ঘার পেছন পেছন আসছিল। নীচবাড়ি ও রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে মালগাড়িটি।

দুর্ঘটনার পরপর মালগাড়ির মৃত চালকের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছে রেল কর্তৃপক্ষ। বলা হচ্ছে, লাল সিগন্যাল দেখতে না পেয়ে ট্রেন চালিয়ে গিয়েছেন মালগাড়ির চালক। দৃশ্যমানতার অভাবে চালক হয়তো সিগন্যালের রঙ ঠিকভাবে বুঝতে পারেন নি। কিন্তু এক‌ই লাইনে দুটি ট্রেন চলে আসার পরেও সংঘর্ষ এড়ানো গেল না কেন? বহুচর্চিত ‘অ্যান্টি কলিশন’ ডিভাইস বা ‘কবজ’ ব্যবস্থা কাজ করলে তো দুটি ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটার কথা নয়। রেলের লোকোমোটিভের ভেতরেই সংঘর্ষ প্রতিরোধী স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি থাকে। তবে কি মালগাড়িটির ইঞ্জিনের মধ্যে ‘কবচ’ ব্যবস্থা ছিল না?

মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপর উঠে গেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার পার্শেল ভ্যান। অ্যান্টি কলিশন প্রযুক্তি বা কাজ করল না কেন?

সমন্বয়ের অভাব না যান্ত্রিক ত্রুটি নাকি চালকের দোষ- ঠিক কী কারণে এনজেপি সংলগ্ন রাঙাপানি এলাকায় সোমবারের ট্রেন দুর্ঘটনা, তা স্পষ্ট নয়। ২০২১ থেকে ২০২৪-এর ২৭ জুন পর্যন্ত দেশে রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। মৃত্যু হয়েছে ৩৭১ জনের। রেল মন্ত্রকের ‘জিরো অ্যাক্সিডেন্ট” নীতি কোথায় গেল? অনেকেরই অভিযোগ, বন্দেভারতের মতো বিলাসবহুল ও সেমি হাইস্পিড ট্রেন নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে যাত্রী নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করছে ভারতীয় রেল। সাধারণ যাত্রীবাহী ট্রেনগুলির সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। ২০১৪ থেকে নিয়োগ বন্ধ রেলে। চালক সহ ‘রেলওয়ে ট্র্যাফিক’ নিয়ন্ত্রণের কাজে যুক্ত অনেক পদ শূন্য। চালকদের উপর বাড়তি কাজের বোঝা। পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাবে চালকেরা অনেক সময় ক্লান্ত অবস্থাতেই ট্রেন চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।

সোমবার সকালের ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য রেলের অবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন, “আগে উদ্ধারকার্য পরে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান। তদন্ত শেষে সব‌ই জানা যাবে।”

Feature image: Collected.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *