মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক হিংসা: ধরা পড়ছে পাড়ার ছেলেরা, বহিরাগত তত্ত্ব কি তবে কাঁচা ঢপ?

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক হিংসা: ধরা পড়ছে পাড়ার ছেলেরা, বহিরাগত তত্ত্ব কি তবে কাঁচা ঢপ?


মুর্শিদাবাদে অশান্তি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে প্রশাসনের দাবি। এতে নিঃসন্দেহে স্বস্তিতে রাজ্যের সাধারণ মানুষ। ওয়াকফ সম্পত্তি সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ঘিরে চার-পাঁচদিনের জন্য মুর্শিদাবাদ জেলায় কোন‌ও আইনের শাসন ছিল না। কেউ কেউ ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করলেও অনেকেই এর সঙ্গে সহমত নন। কারণ, দাঙ্গা হয় দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে। কিন্তু প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে তেমন কিছু ঘটে নি।
শমসেরগঞ্জ, সুতি ও ধুলিয়ানে কী ভয়ঙ্কর তান্ডব ঘটে গেছে, প্রশাসন চেপে যাওয়ার চেষ্টা করার পরেও তার অনেকটাই প্রকাশ্যে এসেছে। আন্দোলনের নামে ভিন্ন সম্প্রদায়ের দোকান-বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট। উপাসনালয়ে হামলা। রাষ্ট্রীয় পরিবহণের একাধিক বাস, পুলিশের গাড়ি, রেলস্টেশন সহ সরকারি সম্পত্তিতে যথেচ্ছ অগ্নিসংযোগ। সরকারি দফতরে ঢুকে ভাঙচুর। সবথেকে মর্মান্তিক শমসেরগঞ্জ থানার জাফরাবাদে সত্তর বছরের বৃদ্ধ বাবা ও তাঁর চল্লিশ বছরের ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা। হরগোবিন্দ দাস ও চন্দন দাসকে তাঁদের বাড়িতে ঢুকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। ঘটনার সময় ধারেকাছে কোন‌ও পুলিশ ছিল না। বারে বারে পুলিশের সাহায্য চেয়েও তাঁরা তা পান নি বলে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন।
মুর্শিদাবাদের হিংসা কবলিত অঞ্চলগুলি থেকে দলে দলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাণের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পাশের জেলা মালদহ এমনকি পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু গৃহবধূরা যে অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন, তা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয়ে দুষ্কৃতীরা বলেছে, স্বামীদের প্রাণের বিনিময়ে তোমাদের ইজ্জত আমাদের হাতে তুলে দাও! ২০২৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদে ছেচল্লিশের নোয়াখালী সিন্ড্রোম! এ‌ও আমাদের দেখতে হবে! শুনতে হবে! এই জন্যই কি ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারত ভাগের সাথে সাথে পৃথক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সৃষ্টি করা হয়েছিল?
রাজ্যের শাসকদলের মুখপাত্র থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- সবাই এখন বলছেন ভিনরাজ্য ও প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বহিরাগতরা ঢুকে মুর্শিদাবাদে গোলমাল পাকিয়েছে। তৃণমূলের অভিযোগের আঙুল বিজেপি-আর‌এস‌এস এমনকি বিএসএফ সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সির দিকে। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের গলায়ও এক‌ই সুর। অথচ নিহত হরগোবিন্দ দাসের স্ত্রীর দায়ের করা এফ‌আইআরে নাম থাকা ৬ অভিযুক্ত‌ই স্থানীয়। এখনও পর্যন্ত যে তিনজনকে (কালু নাদাব, দিলাবর নাদাব ও ইনজামুল হক) গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের সবাই জাফরাবাদের বাসিন্দা। রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতীম সরকার স্বীকার করেছেন, মাস্টারমাইন্ড ইনজামুল হক সহ জাফরাবাদে বাবা-ছেলেকে হত্যার সঙ্গে জড়িতরা সকলেই পাড়ার ছেলে।
রাজনৈতিক নেতারা মুখে যা আসেন, বলে দিতে পারেন। প্রমাণ করার দায়বদ্ধতা তাঁদের নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে বহিরাগত তত্ত্ব, বিজেপি-আর‌এস‌এস ও কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রের কথা বলে দিলেন। কিন্তু তাঁর‌ও প্রমাণ করার দায়বদ্ধতা নেই। অথচ তিনি রাজ্য প্রশাসনের প্রধান। পুলিশ, সিআইডি সব তাঁর হাতে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার সাংবিধানিক দায়িত্ব‌ও তাঁর উপর। মুর্শিদাবাদে পাশের রাজ্য, পাশের দেশ থেকে দুষ্কৃতীরা ঢুকে চারপাঁচ দিন ধরে তান্ডব চালিয়ে, মানুষ খুন করে পালিয়ে গেল, রাজ্যের পুলিশ, গোয়েন্দা দফতর কী করল? এখনও পর্যন্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগ মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে ২৭৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ধৃতদের মধ্যে একজন‌কেও বহিরাগত বলে উল্লেখ করেন নি এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতীম সরকার।
কবি বহু আগেই বলে গেছেন গোপন কথাটি রবে না গোপনে। রাজ্য সরকার রাজনৈতিক কারণে যত‌ই সত্য গোপন করার চেষ্টা করুক না কেন, সবাই বুঝে গেছেন, ঘটনা আসলে কী। ভিন রাজ্য, ভিন দেশের দুষ্কৃতীরা নয় স্থানীয়রাই অশান্তির সঙ্গে জড়িত। আসলে ওয়াকফ আইন বিরোধী বিক্ষোভ-অবরোধ শুরু হ‌ওয়া মাত্র‌ই প্রশাসন শক্ত হাতে মোকাবিলা করলে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না।
যাদের অভিধানে মিছিল-সমাবেশ-বিক্ষোভ মানেই লুটপাট, ভাঙচুর, তারা যখন কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেয়; তখন থেকেই তো প্রশাসনের সতর্ক হয়ে যাওয়ার কথা। এই নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার পরেও প্রশাসনের আধিকারিকরা এতবড় ভুল করলেন কী করে? ওয়াকফ আইন বিরোধী মিছিল-মিটিং যে হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে, এই খবর কি পুলিশের গোয়েন্দাদের কাছে ছিল না? গোয়েন্দারা যদি আঁচ না পেয়ে থাকেন, তবে নিঃসন্দেহে তা তাঁদের ব্যর্থতা। আর গোয়েন্দারা যদি সতর্কবার্তা যথাসময়ে উপর মহলে পাঠানোর পরেও প্রশাসন উপযুক্ত পদক্ষেপ না করে থাকে, তবে দুয়ে দুয়ে চার করে নিতে মানুষের অসুবিধা হবে না।

 

 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *