আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শারদীয়া দুর্গোৎসবের সপ্তমীতেই এমন কান্ড বাংলাদেশে ঘটে গেল যে পুজোর বাকি দিনগুলি কেমন কাটবে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। পুজো মন্ডপে ইসলামিক সঙ্গীতের আসর ঘিরে বিতর্ক বাংলাদেশে। কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে নয়, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি নামকরা পুজোয় গানের মাধ্যমে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিতে দেখা গেল ছয়জনকে। পুজো মন্ডপের ভেতরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য যে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে, সেখানে ইসলামিক সঙ্গীত পরিবেশনের একাধিক ভিডিও ইতিমধ্যেই ভাইরাল।
চট্টগ্রাম জেএম সেন হল পূজা কমিটির মন্ডপে ইসলামিক সঙ্গীত পরিবেশনের যে সব ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেগুলি পরীক্ষা করে ‘অরজিনাল’ বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ভিত্তিক ‘ফ্যাক্ট চেকার’-রা। ভিন্ন ধর্মীদের ইসলাম ধর্মের দাওয়াত দেওয়া বা আহ্বান জানানো ইসলাম ধর্ম পালনের একটি আবশ্যক অঙ্গ। ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। যদিও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ অতিরঞ্জিত বলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল ও মিডিয়ার দাবি। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলি বাড়িয়ে চড়িয়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার খবর প্রচার করছে বলে তাদের অভিযোগ।
কর্মস্থলে, হাটে-বাজারে দ্বীনের দাওয়াতের নাম করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর ধর্মান্তরণের চাপ সৃষ্টি করার ঘটনা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই চাপের মুখে বেশ কয়েকজন হিন্দু ধর্মত্যাগে বাধ্য হয়েছেন বলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সংগঠনগুলির তরফে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু অতীতে হামলা চালিয়ে মন্ডপ ও মূর্তি ভাঙার বহু ঘটনা ঘটলেও পূজা মন্ডপে ঢুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের দাওয়াত দেওয়ার ঘটনা আগে কখনও বাংলাদেশে ঘটে নি বলেই জানাচ্ছেন দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়রা।
দুর্গা পুজোর দিন ঘনিয়ে আসলেই বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষ আতঙ্কে থাকেন। শেখ হাসিনার আমলেও প্রতিমা ভাঙা বন্ধ থাকে নি। ২০২২-এ কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ে একটি পুজো মন্ডপে ‘কোরআন’ অবমাননার আওয়াজ তুলে মহাষ্টমীর দিন দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছিল। সারা বাংলাদেশে অশান্তি ছড়িয়ে পড়লে সে’বছর দুর্গাপুজোর আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য। নোয়াখালি, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক মন্দিরে হামলা হয়। উন্মত্ত জনতা নোয়াখালি শহরে ইসকন মন্দিরে ঢুকে মন্দির জ্বালিয়ে দেয়। মন্দির বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দেন তিনজন সন্ন্যাসী।
পালা বদলের পরিপ্রেক্ষিতে এই বছর সঙ্গত কারণেই দুর্গাপুজো নিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ বিগত বছরগুলির তুলনায় অনেক বেশি। যদিও হিন্দু সম্প্রদায় নির্বিঘ্নে শারদীয়া দুর্গোৎসব উদযাপন করতে পারবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস। এমনকি জামাতে ইসলামির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরও হিন্দুদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও রাজধানী ঢাকার উত্তরা এলাকা সহ একাধিক জায়গায় দুর্গাপুজো বন্ধের দাবিতে বিরাট বিরাট মিছিল বের করেছে ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠন।
বাংলাদেশের পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আজানের সময় ঢাক ও মাইক বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ জাহাঙ্গির আলম চৌধুরী। আজানের পর একঘন্টা মন্ডপ থেকে কোনও আওয়াজ বাইরে আসা চলবে না বলে প্রশাসনের তরফে কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নির্দেশ ঘিরে ক্ষোভ রয়েছে পুজোর উদ্যোক্তাদের। প্রশাসনের নির্দেশকে হাতিয়ার করে বহু জায়গায় শব্দহীন পুজো সারতে উদ্যোক্তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার বাইরে বেশিরভাগ পুজো কমিটিই ভয়ে মাইক বন্ধ রেখেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
তবে সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে সপ্তমীর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জ এলাকার জেএম সেন হলের পুজো মন্ডপে ইসলামিক সঙ্গীত পরিবেশনের ঘটনা। যে ছয়জন শিল্পী ইসলামিক সঙ্গীত পরিবেশন করেন, তাঁরা চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য বলে জানা গেছে। পুজো কমিটির আমন্ত্রণেই তাঁরা সেখানে গান গেয়েছেন বলে কোনও কোনও মহল থেকে প্রচার করা হচ্ছে। যদিও পুজোর আয়োজক সংস্থা ‘পূজা উদ্যাপন পরিষদ’ জানিয়েছে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশনের আশ্বাস দিয়ে মঞ্চে উঠে তাঁরা ইসলামিক সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। গানের মূল কথা- “ইসলাম সর্বজনীন, শুধু মুসলমানের জন্য ইসলাম আসে নি। সকলের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা উচিত।”
Feature Image- NNDC.