পৃথক আইন নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে, আগে আরজি কর রহস্যের অবসান চায় জনগণ

পৃথক আইন নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে, আগে আরজি কর রহস্যের অবসান চায় জনগণ


সমাজের যে সুবিধাবাদী সেলিব্রেটিরা একটু গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের উপর গণঘৃণা বর্ষিত হচ্ছে। অনেকে ইচ্ছে না থাকলেও স্রেফ লজ্জার খাতিরে আরজি করের ঘটনায় প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। লিখলেন উত্তম দেব-

আরজি করে মহিলা ইন্টার্নিকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার এক মাস গড়াতে চলল। এখনও রহস্যের কিনারা হয়েছে বলা চলে না। তবে ঘটনার ২৫ তম দিনে ১৪ দিনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সোমবার আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে ঘটনার পর দিন‌ই গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। সিবিআই হেফাজতে কাটিয়ে সঞ্জয় এখন জেলে। আরজি কর কান্ডের জেরে রাজ্য জুড়ে যে জন-বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে তাকে বিক্ষোভ না বলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ বলা চলে। এবং এই গণক্ষোভ প্রশমিত হ‌ওয়ার কোন‌ও লক্ষণ নেই। কারণ আরজি করের চিকিৎসক থেকে সাধারণ মানুষ- সকলের দৃঢ় ধারণা, এই ধর্ষণ ও খুনের পেছনে অনেক বড় রহস্য আছে। এই রহস্যের উন্মোচন না হ‌ওয়া পর্যন্ত জনগণ শান্ত হবে না।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, মানুষ কেমন তেতে আছে। মেডিকেল কলেজগুলিতে জুনিয়র ডাক্তারেরা প্রতিবাদের পাশাপাশি কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে আরজি কর সহ রাজ্যের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত রোগীরা। আরজি করে চিকিৎসক ও পড়ুয়াদের নিরাপত্তায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিআইএস‌এফ মোতায়েন করা হয়েছে। হাসপাতালগুলিতে ঠিকমতো চিকিৎসা না পাওয়ায় সাধারণ মানুষ ভীষণ দুর্ভোগে পড়েছেন কিন্তু তা মেনে নিয়েও আরজি করের নির্যাতিতার বাবা-মাকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেওয়ার দাবিতে রাজপথে পড়ে আছেন সকলে মিলে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ স্লোগান মুখে আন্দোলনে সামিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বেও এমন নাগরিক আন্দোলন চোখে পড়ে নি। সমাজের যে সুবিধাবাদী সেলিব্রেটিরা একটু গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের উপর গণঘৃণা বর্ষিত হচ্ছে। অনেকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে ইচ্ছে না থাকলেও প্রতিবাদে পথে নেমেছেন।

মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভায় ‘অপরাজিতা নারী ও শিশু পশ্চিমবঙ্গ অপরাধ সংশোধনী বিল ২০২৪’ (Aparajita Woman and Child West Bengal Criminal Laws Amendment Bill 2024) পেশ করেছে সরকার। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সদ্য চালু ভারতীয় ন্যায় সংহিতাতে যে সব শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তা যথেষ্ট কঠোর নয়, এই যুক্তিতে রাজ্যের তরফে আরও কঠোর আইন আনতেই এই বিল উত্থাপন করা হয়েছে বলে বিধানসভায় জানিয়েছেন মমতা। রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও বিলটিকে সমর্থন করেছে বিরোধী দল বিজেপি। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, আরজি কর কান্ডের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি মেরামত করতেই তড়িঘড়ি ‘অপরাজিতা বিল-২০২৪’ এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আসলে আরজি করে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুলিশ যে ‘ন্যারেটিভ’ সামনে আনছে, তা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকছে না। ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন না মৃত্যুদণ্ড কী হ‌ওয়া উচিত, এই বিতর্কের থেকেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে এই মুহূর্তে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আরজি করের নারকীয় ঘটনার পেছনে কারা জড়িত, তা জানা। শুধু তাই নয়, প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দিতে কোনও চেষ্টা হয়েছিল কিনা এবং হয়ে হয়ে থাকলে সেই নির্দেশ কোথা থেকে বা কার কাছ থেকে এসেছিল; তা উদ্ঘাটনের জোরালো দাবি জানাচ্ছে জনগণ। আরজি করের নৃশংস ঘটনা ঘিরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি পর্যন্ত উঠে গেছে। নিঃসন্দেহে ক্ষমতায় আসার পর এতবড় চ্যালেঞ্জের সামনে আর কখনও পড়েন নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই মাস আগেই লোকসভা নির্বাচনে বিরাট জয় পেয়েছে তৃণমূল। উপনির্বাচনেও বিজেপিকে দুরমুশ করেছে শাসকদল। বিধানসভা নির্বাচন দু’বছর পরে। কিন্তু তারপরেও মানুষের মুড দেখে তৃণমূলের নেতারা বিচলিত।

ভিডিও: ধৃত সন্দীপ ঘোষকে ঘিরে আদালত চত্বরে প্রবল বিক্ষোভ। এক্স হ্যান্ডেল থেকে সংগৃহীত

মুখ্যমন্ত্রী দলের নেতাকর্মীদের ফোঁস করতে বলার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের মুখ বেশ বেলাগাম হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ আন্দোলনকারীদের ধমকি-ধামকা দিচ্ছেন। কিন্তু মানুষ তাতে ডরেছে, এমন প্রমাণ নেই। উল্টে নবান্ন অভিযানের ডাক দেওয়া ছাত্র নেতাদের গ্রেফতার করে হাইকোর্টের পর সুপ্রিম কোর্টেও মুখ পুড়েছে রাজ্যের। শাসকদল যেন মনে রাখে, ভয় ভেঙে যাওয়ার পর মানুষকে ভয় দেখাতে যাওয়া শাসকের জন্য বিপজ্জনক। সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে মঙ্গলবার যখন আলিপুর আদালতে তোলা হয়, তখন জনতার রোষানল থেকে ধৃতকে রক্ষা করতে হিমসিম খেয়ে যায় পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী। চোর চোর, ধর্ষক ধর্ষক চিৎকারে আদালত চত্বর মুখরিত হয়ে ওঠে। যখন আদালত থেকে সন্দীপ ঘোষকে বের করে আনা হচ্ছিল, সে’সময় কেউ একজন পেছন থেকে তাকে থাবড়া লাগায়। ধৃত আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষকে আট দিনের সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। আরজি করে নানা অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই সিবিআইকে পৃথক একটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। তদন্তে নেমে সন্দীপ ঘোষের তিন শাগরেদ বিপ্লব সিং, সুমন হাজরা ও আফসার আলিকেও গ্রেফতার করেছে সিবিআই।

আরজি করের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে মহিলা চিকিৎসককে খুন-ধর্ষণের যোগ থাকতে পারে বলে গুঞ্জন। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সন্দীপ ঘোষের নাম। ধর্ষণ ও খুনের ব্যাপারে সন্দীপ অনেক কিছুই জানেন বলে মনে করছে একটি মহল। মহিলা চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের ঘটনা ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জোর চেষ্টা হয়েছিল বলে রাজ্যের চিকিৎসক সমাজ ও আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারদের বৃহদংশের অভিযোগ। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ লোপাটের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও সব চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে আরজি কর কান্ডের জট ছাড়াতে ব্যর্থ হলে সিবিআইয়ের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেরি করবে না বাংলার মানুষ।

Feature image source- NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *