ইনফোয়ানা ফিচার: বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। যাঁর নাম শুনলেই রাগে মাটিতে পা ঘষতেন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ। নেহাত বরাত জোরে সে’দিন যমের দক্ষিণ দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন হার্ডিঞ্জ সাহেব। বোমাটা ছুঁড়েছিলেন বসন্ত বিশ্বাস। কিন্তু পুরো পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন রাসবিহারী বসু। বসন্ত বিশ্বাস ধরা পড়েছিলেন। তাঁর ফাঁসি হয়েছিল। তবে রাসবিহারীর নাগাল পায় নি বড়লাটের পুলিশ! বাঙালির হাতে ঘোল খেয়েছিল ধূরন্ধর ইংরেজ। বিপ্লবী রাসবিহারীর নামের আগে একটি বিশেষণই উপযুক্ত- দুর্ধর্ষ! ‘পথের দাবীর’ নায়ক সব্যসাচীর মধ্যে রাসবিহারীকেই এঁকেছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর বর্ণময় সংগ্রামী জীবন উপন্যাসকেও হার মানায়। কিংবদন্তি রাসবিহারীর লড়াইয়ের গল্প আরেকদিন। এই কাহিনী শুধুই বঙ্গসন্তান রাসবিহারী আর জাপানিকন্যা তোশিকোকে ঘিরে। ইনফোয়ানা ইউটিউব চ্যানেল থেকে এমবেডেড করা নিচের ভিডিওতে পুরো গল্পটি আপনারা চাইলে শুনে নিতে পারেন। গল্প ভাল লাগলে চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করার অনুরোধ রইল-
তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কাঁপছে বিশ্ব। সেই সুযোগে ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি’র ভারতীয় সিপাইদের বিদ্রোহের মাধ্যমে দেশ থেকে ইংরেজ শাসন অবসানের বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বিপ্লবীরা। এই পরিকল্পনারও অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন বাঙালি রাসবিহারী বসু। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে শেষে মুহূর্তে ভেস্তে যায় সেই পরিকল্পনা।
ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো রাসবিহারীর খোঁজে গোটা দেশ চষে ফেলে ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু ইংরেজ ‘ইন্টেলিজেন্স’কে কলা দেখিয়ে ‘প্রিয়নাথ টেগোর’রের ছদ্মবেশে ১৯১৫-র ১২-ই মে চিরদিনের জন্য ভারত ছাড়েন রাসবিহারী। যে জাহাজে চেপে কলকাতা বন্দর থেকে জাপানের কোবে শহরে পৌঁছেছিলেন রাসবিহারী বসু, তার নাম ছিল ‘সানুকি মারু’।
চোখে ধুলো দিয়ে রাসবিহারী বসু জাপানে- এই খবর জানতে পেরে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে ব্রিটিশ সরকার। রাসবিহারীকে হাতের মুঠোয় পেতে জাপান সরকারকে চাপ দিতে থাকে ব্রিটেন। একদিকে জাপানি পুলিশ আরেক দিকে ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা রাসবিহারীকে খুঁজতে থাকে হন্যে হয়ে। সেই বিপদের দিনে বিপন্ন বাঙালি বিপ্লবীকে রক্ষা করলেন ‘সামুরাই’ নেতা মিৎসুরু তোয়ামা।
পুলিশের নজর এড়াতে রাসবিহারীর দরকার ছিল একটা নিরাপদ আশ্রয়। মিৎসুরু তোয়ামার অনুরোধে নিজের বেকারিতে রাসবিহারীকে আশ্রয় দিলেন আইজো সোমা। টোকিওর শিনজুকু এলাকায় অবস্থিত সেই বিখ্যাত বেকারির নাম ‘নাকামুরায়া’। নিয়োতিই যেনো ২৯ বছরের বাঙালি বিপ্লবীকে ঠেলে পাঠালেন নাকামুরায়ায়।
নাকামুরায়া বেকারির মালিক আইজো সোমা ও তাঁর স্ত্রী কোকো- দু’জনেই ভালবেসে ফেলেছিলেন রাসবিহারীকে। মা যেভাবে সমস্ত বিপদ থেকে ছেলেকে রক্ষা করেন, সেভাবেই এক ভিনদেশী যুবককে রক্ষা করেছেন কোকো সোমা। নাকামুরায়া বেকারির পেছনে ছোট্ট একটি কুঠুরিতে সারাদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন রাসবিহারী। অন্তরালবাসেই জাপানি ভাষা শিখে ফেলেছিলেন তিনি।
আইজো ও কোকোর আশ্রয় রাসবিহারীকে জাপানি পুলিশ ও ব্রিটিশ চরদের নজর থেকে সাময়িক রক্ষা করতে পারলেও বিপদ সম্পূর্ণ কাটল না। কীভাবে জাপানের মাটিতে নির্ভয়ে বাস করতে পারবেন এই ভারতীয় বিপ্লবী? উপায় বাতলে দিলেন সামুরাই নেতা মিৎসুরু তোয়ামাই। কোনও জাপানি কন্যাকে বিয়ে করে জাপানের নাগরিকত্ব লাভেই একমাত্র মুশকিল-আসান। কিন্তু, কে করবে নির্বাসিত, নিঃসম্বল এক পরদেশী পুরুষকে বিয়ে!
সোমা দম্পতির বড়মেয়ে তোশিকো সোমা তখন বছর কুড়ি। যে কোনও জাপানি পুরূষের হৃদয় কেড়ে নিতে পারে রূপে-গুণে-স্বভাবে অনন্যা তোশিকো। আইজো ও কোকোর কাছে রাসবিহারীর জন্য তোশিকোকেই পাত্রী হিসেবে চাইলেন তোয়ামা।
তোয়ামার প্রস্তাব শুনে রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বিখ্যাত নাকামুরায়া বেকারির মালিক আইজো সোমা ও তাঁর স্ত্রী কোকো। দু’জনেই পুত্রস্নেহে আগলে রাখতেন সেই ভিনদেশী বিপ্লবী যুবককে। ছেলেটির মায়ার বন্ধনেও পড়ে গেছেন দু’জনে। কিন্তু তা বলে তার হাতেই আদরের কন্যাকে সমর্পণ!
রক্ষণশীল জাপানি সমাজ। ভিন্ন জাতের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাঁরা আত্মীয় মহলে মুখ দেখাবেন কীভাবে? মেয়েই বা রাজি হবে কেন চালচুলোহীন রাসবিহারীকে বিয়ে করতে? জাপানের প্রবীণ সামুরাই নেতা মিৎসুরু তোয়ামা। তাঁকে শ্রদ্ধা করেন সোমা দম্পতি। তোয়ামার কথা ফেলতে পারলেন না আইজো ও কোকো। বললেন, মেয়ে যদি রাজি হয়, এই বিয়েতে আপত্তি নেই তাঁদের।
বাবামাকে অবাক করে দিয়ে মেয়ে কিন্তু রাজি হয়েছিল। ধনীর দুলালী বলতে যা বোঝায়, আক্ষরিক অর্থেই তোশিকো সোমা ছিলেন তাই। কিন্তু এক পলাতক ভারতীয় বিপ্লবীর অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে দ্বিধা করেন নি তিনি। সেই অকুতোভয় বাঙালি যুবককে দূর থেকে দেখতেন তোশিকো। তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর পৌরুষ, মাতৃভূমির জন্য তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, তাঁর মায়া ভরা বড় বড় দুটি চোখ কখন যে তোশিকোর হৃদয় দখল করে বসেছিল, তোশিকো নিজেই জানতেন না।
আর রাসবিহারী! তাঁর জীবনে প্রেম মানেই দেশপ্রেম। কৈশোর থেকেই একমাত্র স্বপ্ন ভারতকে স্বাধীন করা। ঘর বাঁধার কথাই কখনও ভাবেন নি। বিপ্লবীর জীবনে ফাঁসির মঞ্চে পা রাখাই যে সবথেকে বড় অভিসার। কিন্তু প্রজাপতির নির্বন্ধ রোধ দুর্ধর্ষ বিপ্লবীরও অসাধ্য। প্রবাসে পরিস্থিতি বাঙালি বিপ্লবীকে বাধ্য করল এক জাপানি কন্যার পাণিগ্রহণে। ১৯১৮-র ৯ জুলাই, জাপানের রাজধানী টোকিওতে মিৎসুরু তোয়ামার গৃহে গোপনে বিয়ে হয়ে গেল রাসবিহারী বসু ও তোশিকো সোমার।
বিয়ের পর বিপ্লবী রাসবিহারী উপলব্ধি করলেন, তোশিকো তাঁর জীবনে ঈশ্বরের পাঠানো উপহার। ধনীর দুহিতা। কিন্তু বাঙালি বোহেমিয়ান বিপ্লবীর সংসার এসে কী দুঃখ-কষ্টটাই না ভোগ করলেন সেই জাপানি কন্যা। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯২৩ সালের ২ জুলাই বৈবাহিক সূত্রে জাপানের নাগরিকত্ব লাভ করেন রাসবিহারী বসু।
পুলিশের নজর এড়াতে এই পাঁচ বছরে ১৮বার বাসা বদল করেছেন রাসবিহারী-তোশিকো। সংসারে অভাব-অনটন, পুলিশের তাড়ায় বারে বারে বাসা বদল- তারপরেও দুর্ভেদ্য মানব প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে বাঙালি স্বামীকে আগলে রেখেছেন তোশিকো।
জাপানের নাগরিকত্ব লাভে রাসবিহারীর অজ্ঞাতবাস পর্ব কাটল। ততদিনে বসু দম্পতির ঘর আলো করে দুটি ফুটফুটে সন্তান এসেছে। রাসবিহারী-তোশিকোর সংসারে একটু সুখের বাতাস লাগল বটে কিন্তু সুখ তাদের কপালে সইলো কই! বিয়ের পর থেকেই স্বামীকে নিয়ে উৎকণ্ঠা- প্রবল মানসিক চাপে ভেতরে ভেতরে ভাঙতে থাকে তোশিকোর শরীর। দেহে বাসা বাঁধে যক্ষ্মা। তার উপর নিউমোনিয়া। জোড়া আঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন রাসবিহারীর জীবনসঙ্গীনি।
রাসবিহারী বুঝলেন, স্ত্রীর শিয়রে শমন দাঁড়িয়ে। প্রিয়তমার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ আসন্ন। শেষক’টা দিন তোশিকোর মাথার কাছ থেকে নড়েন নি রাসবিহারী। স্ত্রীর হাতে হাত রেখে বসে থাকতেন; এ’ভাবেই সকাল গড়িয়ে বিকেল হত, বিকেল গড়িয়ে রাত। মুমূর্ষু স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নিয়ে শোনাতেন উপনিষদের মহামন্ত্র। ১৯২৪-এ ভুগতে ভুগতে যখন তোশিকো সোমা বসুর জীবনদীপ নিভে গেল, তখন তাঁর বয়স মাত্র আটাশ।
বাঙালি বিপ্লবীর জাপানি বউ তোশিকো সোমা বসু। বাঙালি বরের সঙ্গে মাত্র ছয় বছরের সংসার তোশিকোর। শ্বশুরবাড়িতে পা দেওয়ার সৌভাগ্য হয় নি। কিন্তু জাপানে বসেই স্বামীর কাছে শিখেছিলেন বাংলা। রাঁধতে পারতেন বাঙালির রান্না। কিমোনোর পাশাপাশি অভ্যস্ত হয়েছিলেন শাড়িতেও।
পত্নী বিয়োগের পর আরও ২১ বছর বেঁচেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। স্ত্রীর মৃত্যুর পর শ্বাশুড়ি কোকো সোমার শত অনুরোধেও দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন নি রাসবিহারী। বলেছিলেন, ‘‘তোশিকো ছাড়া আর কাউকে ভালবাসা আমার পক্ষে এ জীবনে অসম্ভব। তোশিকো সারা জীবন আমার কাছেই থাকবে। আর কিছু চাই না আমি।” টোকিওর তামা শ্মশানে একই সমাধিতে লীন হয়ে আছেন দু’জন। প্রেমের আরেক নাম যদি হয় সমর্পণ, তবে রাসবিহারী-তোশিকো তার সবথেকে বড় উদাহরণ।
Feature and other Image source: archives.